ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মারুফ রায়হান

নিষিদ্ধ কনটেন্টে আসক্তি ॥ প্রজন্মকে রক্ষার দায় সবার

প্রকাশিত: ২১:৩১, ১১ জানুয়ারি ২০২২

নিষিদ্ধ কনটেন্টে আসক্তি ॥ প্রজন্মকে রক্ষার দায় সবার

কোভিড-১৯ বিশ^ব্যাপী প্রলয়কা- ঘটিয়েছে, এটি অস্বীকারের নয়। কিন্তু সংগোপনে এই করোনাকালে যে তরুণ-যুব সমাজের নিভৃত বিরাট এক ক্ষতি হয়ে গেছে, সেটি নিয়ে বিশেষ আলোচনা চোখে পড়ে না। বাধ্যতামূলকভাবে গৃহে বসবাসের কালে তারুণ্যশক্তি কড়াকড়ি শিক্ষার্জনের সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেয়ে নিষ্ফলা সময়কে রঙিন করে তুলতে গিয়ে ডিজিটাল মাধ্যমের ওপর আরও বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির কারণ হতে পারে। ছুরি নিরপেক্ষ বস্তু বটে, ব্যবহারের কারণে তার পরিচয় ও উপযোগিতা ভিন্ন হয়ে ওঠে। চিকিৎসক মানুষের জীবন বাঁচাতে বা রোগমুক্তি ঘটাতে শল্য চিকিৎসায় ছুরি ব্যবহার করেন। অন্যদিকে অপরাধপ্রবণ ব্যক্তি ছুরি বসায় মানুষের গলায় তার প্রাণসংহার করতে। ব্যবহারের ওপরেই বস্তুর বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয়। কে কিভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করবে তার ওপরেই ব্যক্তির ও সমাজের লাভক্ষতি নির্ভর করে। ইন্টারনেট বা অন্তর্জাল এখন মানবসভ্যতায় বিদ্যুতের মতোই নিত্য ব্যবহার্য বিষয়। ইন্টারনেটের স্বল্পকালীন অনুপস্থিতি কিংবা ধীরগতি আধুনিক মানুষের জীবনকে বিরক্তিকর ও পানসে করে তোলে। মানুষের কাজে গতিশীলতা আনা, তার শিক্ষার্জন ও বিনোদন উপভোগের মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেটের চাহিদা শীর্ষে। আবার এটির অপব্যবহারই মানবজীবনকে করে তোলে ব্যাধি ও বিপদগ্রস্ত, সে পতিত হয় এক চোরাবালিতে, তারপর শুরু হয় তার হাঁসফাঁস। যার পরিণতিতে সমাজই বিপন্নতার শিকার হয়। আলোচনায় প্রবেশের আগে আমরা তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সত্য ঘটনা জেনে নিতে পারি। এ থেকে আমরা সমাজচিত্র হয়ত কিছুটা অনুমান করতে পারব। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার স্বার্থেই এখানে আসল নাম ব্যবহার করা হয়নি। আসক্তির তিনটি ধরন এবং পাশর্^প্রতিক্রিয়া কেস স্টাডি এক. ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে পড়া অনুর্ধ আঠারো বছর বয়সী সন্তান ফারহানের মা ছেলেকে নিয়ে গর্বই করতেন মনে মনে। ভাবতেন ছেলে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে পড়ালেখা করে। কেননা সকালে অনেক বেলা করেই তার ঘুম ভাঙ্গে, আর দিনের অনেকটা সময় পর্যন্ত তার ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ মায়ের নজর এড়ায় না। তিনি ভাবেন ছেলে দিনে একটু ঘুমাক, সমস্যা কী। তার প্যাটার্ন হয়ত এমনই- রাতে নিরিবিলি শান্ত পরিবেশে তার পড়ায় বেশি মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয়। কিন্তু ছেলের টেস্টের রেজাল্ট পেয়ে একেবারেই ভেঙ্গে পড়েন মা। এমন খারাপ রেজাল্ট কিভাবে করল তার সন্তান! বাধ্য হয়ে স্বামীকে জানান বিষয়টি। ফারহানের বাবা ধীরস্থির শান্ত মানুষ। অফিসের কাজে একটু বেশিই ব্যস্ত থাকেন। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকেন। তারপর ফোনে এক আইটি এক্সপার্টকে ডাকেন। লোকটির হাতে তুলে দেন পুত্রের ল্যাপটপ। অল্প সময়ের ভেতরেই পর্যবেক্ষণের ফল প্রিন্ট আউট করেন সেই এক্সপার্ট। তাতে যে চিত্র উঠে আসে সেটি দেখে বাবা-মা দুজনেই আপসেট। ছেলে রাত জেগে বিভিন্ন পর্নোসাইট দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কখনও কখনও দেখে এডাল্ট মুভি। সেই সঙ্গে যৌন সাইটের লাইভ চ্যাটেও সে অংশ নিয়ে থাকে অনিয়মিতভাবে। প্রথম থেকেই যদি ছেলের দিকে দৃষ্টি দিতেন, রাত জাগা বন্ধ করতেন, সেই সঙ্গে ছেলের ঘরে একটু যাতায়াত রাখতেন, পাশে বসে থাকতেন, তাহলে হয়ত ছেলের এমন সর্বনাশ হতো না। কেস স্টাডি দুই. লোকমান সাহেব ব্যবসায়ী পিতার সুদর্শন স্মার্ট সন্তান। মেধাবীও বটে। কিন্তু তার রয়েছে গোপন এক শারীরিক ব্যাধি। বিয়ের আগে এ ব্যাধির কথা কেউ জানতে পারেনি, সেটিই স্বাভাবিক। বাইরে থেকে দেখতে এমন চমৎকার একজন ব্যক্তি বিশ্রি মানসিক প্রবণতা, বলা ভাল এক ধরনের বিকৃতির কারণেই আজ প্রকৃতপক্ষে যৌন প্রতিবন্ধী। স্ত্রী এক বিশ^স্ত বয়স্ক বন্ধুর সহায়তায় শারীরিক ও মানসিক উভয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সে অনুযায়ী স্বামীর চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সুফল মেলেনি। স্ত্রীটি ডিভোর্স নিয়ে অন্যত্র সংসার রচনা করতেই পারেন। কিন্তু লোকমান সাহেবের সুন্দর স্বাভাবিক জীবন তো তছনছ হয়ে গেল। বিয়ের আগে বছরের পর বছর যদি তিনি নীল ছবিতে আসক্ত না থাকতেন তাহলে তার এমন চরম পরিণতি ঘটত না। কেস স্টাডি তিন. ইরফান সাহেবের ভিন্ন রোগ, তিনি মধ্যরাতে পরিচিত স্বল্প পরিচিত ও আত্মীয় নারীদের ইনবক্সে (ম্যাসেঞ্জারে ও হোয়াটসএ্যাপে) অশ্লীল কনটেন্ট পাঠান। কখনও দুতিনটি বাক্যে নিজের ডিজায়ারও প্রকাশ করেন। সোজা কথায় যাকে বলতে পারি ইনডিসেন্ট প্রপোজাল। এই সংগোপন বিকৃত প্রবণতা হয়ত সামনে আসত না, লোক জানাজানি হতো না, কিন্তু পর পর দুটি সামাজিক অনুষ্ঠানে বন্ধু, পরিচিত, আত্মীয় নারীরা যখন প্রায় এক যোগে ইরফানকে এড়িয়ে চলতে থাকে তখনই বিষয়টি অস্বাভাবিক ঠেকে অন্যদের কাছে। এরপর এ কথায় সে কথায় ফাঁস হয়ে যায় ইরফানের অগ্রহণযোগ্য অস্বাভাবিক ভার্চুয়াল আচরণের বিষয়টি। অথচ তাকে দেখলে কেউই বিশ^াস করতে চাইবে না এমন একজন ভাল মানুষের চেহারাধারী ব্যক্তির পক্ষে অমন কুৎসিত আচরণ সম্ভব! আমরা আলোচনা করতে চাইছি নিষিদ্ধ কনটেন্টের কুপ্রভাব নিয়ে। এ সবই আসলে ডিজিটাল আসক্তি, যার তিনটি ধরন রয়েছে। যথা ফোন আসক্তি, ইন্টারনেট আসক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি। স্মার্ট ফোনে ইন্টারনেটের ডেটা নেয়া যায়, তার মানে সেটি ওই একই নিষিদ্ধ কনটেন্ট আসক্তির মধ্যেই পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক এখন তো শীর্ষ আসক্তিরূপেই রয়েছে। আর ইউটিউবের মাধ্যমেই নিষিদ্ধ ভিডিও দেখা চলে। কৈশোর এক আশ্চর্য বয়স এটি অবিশ্বাস্য শোনালেও পরিসংখ্যান বলছে সব বয়সের মানুষের মধ্যে এ আসক্তি দেখা দিলেও কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীরা এ আসক্তিতে বেশি আক্রান্ত। আমরা এ প্রসঙ্গ অল্প কথায় সারব। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, চার থেকে ১৭ বছর বয়সী অন্তত ৬০ লাখ শিশু-কিশোর বর্তমানে ‘এডিএইচডি’তে (এ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার এ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার) আক্রান্ত। মাত্রাতিরিক্ত ইন্টারনেট ও মোবাইলের প্রতি আসক্তি এডিএইচডি নামক মানসিক রোগের সৃষ্টি করে। এই ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি নির্দিষ্ট কোন কাজে পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে না। গত দুই দশকে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে এবং মোবাইল ডিভাইসে অতিরিক্ত আসক্তিকেই এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। শিশুদের কল্পনাশক্তি এবং চিন্তাশক্তিও কমে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ভিডিও গেমের প্রতি শিশু-কিশোরদের আগ্রহ নতুন কিছু নয়। তবে এই আসক্তিকে ‘মানসিক রোগের’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বহুদিন ধরে বলছিলেন, ভিডিও গেমের অতিরিক্ত আসক্তিতে একদিকে যেমন শিশু-কিশোরদের সামাজিকীকরণ বাধাগ্রস্ত হয় তেমনি মেধা বিকাশেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিষয়টিকে নজরে নিয়ে ব্রিটেনসহ কয়েকটি দেশ বিশেষ ক্লিনিক স্থাপনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত মনিটরিং শুরু করলেও এক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে বাংলাদেশ। জেনে বিস্মিত হয়েছিলাম যে প্রতিনিয়ত এসব ভিডিও গেম খেললে শরীরে এক ধরনের হরমোন নিঃসরণ হয়। এতে শিশু-কিশোররা সব কিছু নিয়েই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে যায়। মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়। প্রথম কেস স্টাডি থেকে আমাদের দুর্ভাবনা জাগাটাই স্বাভাবিক। সন্তান পর্নোগ্রাফিতে বা এডাল্ট কনটেন্টে আসক্ত কিনা তা বুঝতে একটু সচেতন হতে হবে। হৈ-হুল্লোড় করে বেড়ানো, প্রাণবন্ত সন্তান হঠাৎ একটু কি চুপচাপ হয়ে গেছে? কিংবা হঠাৎ করে কিছু একটা আড়াল করার আভাস কি তার চোখে-মুখে দেখতে পান? আপনার সন্তানের মধ্যে এমন কিছু পরিবর্তন এলে সচেতন হোন। কিশোর বয়সে নিষিদ্ধ কিছুর নেশায় জড়ালে পরিচিত মানুষদের সামনে কিছু ভাবভঙ্গির পরিবর্তন আসে। আপনার সন্তান সব সময় ফোন বা কম্পিউটারে থাকে কিনা খেয়াল রাখুন। তার ব্যবহৃত ফোন সব সময়ই পাসওয়ার্ড দেয়া থাকে কিংবা আপনাকে ধরতে দিতে চায় না, এমনটা কি হয়? অন্যান্য গোপনীয় বিষয়ের জন্যও তার এমন আচরণ হতে পারে। কিন্তু তার সঙ্গে পর্নো ছবি দেখা বা পর্নো সাইট ব্যবহারের দিকটিও উড়িয়ে দেয়া যাবে না। অনেক রাত পর্যন্ত সন্তান ফোন ব্যবহার করলে তা পড়াশোনার বাইরে অন্য কোন কারণে কিনা তা খতিয়ে দেখুন। অন্য কাউকে ঘরে ঢুকতে দেখলেই কি সন্তান ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয় বা কম্পিউটারে দ্রুত অন্য কোন পেজ খোলে? তার ভাবভঙ্গি দেখে তা বোঝার চেষ্টা করুন। আবেগজনিত বিচ্ছেদ দ্বিতীয় কেস স্টাডি থেকে শঙ্কা জাগে স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনের অনুপস্থিতিতে বা অপারগতায় সমাজের কত নারীই না বঞ্চিত হচ্ছে। ক’জনাই বা আর নিজের চাওয়া পাওয়া বিসর্জন দিয়ে থাকে! ক’জনারই বা সাধ্য বা সাহস আছে ডিভোর্স দিয়ে নতুন করে বিয়ে করার। তাই সমাজে নারী-পুরুষের সমতা ও স্বাভাবিক সুস্থ দাম্পত্য জীবন চাইলে এই দিকটিকে আমাদের গুরুত্ব দিতেই হবে। বিজ্ঞানীগণ দাবি করেন যে, অতিমাত্রায় পর্নোগ্রাফি দেখা অস্বাস্থ্যকর হতে পারে, যদি ব্যক্তিগত ও সামাজিক কারণে কোন ব্যক্তির জন্য এটি সমস্যার কারণ হয়ে ওঠে, যার মধ্যে অন্যান্যের সঙ্গে যোগাযোগ বিনিময়ের পরিবর্তে পর্নোগ্রাফি দেখার পেছনে অতিমাত্রায় সময় ব্যয় করা অন্তর্ভুক্ত। ব্যক্তি বিশেষ তাদের অতিরিক্ত পর্নোগ্রাফি দেখার ফলে নিজ সামাজিক জীবনে অবনতিস্বরূপ মানসিক অবসাদ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, পেশাজীবনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, নিম্নমুখী উৎপাদনশীলতা অথবা অর্থনৈতিক সমস্যার শিকার হতে পারেন। পর্নোগ্রাফিতে অতিমাত্রায় আসক্তগণ অধিকহারে একাকিত্ব অনুভব করেন এবং যৌন অভিজ্ঞতাবিহীন পর্নো ভোক্তারা পর্নোগ্রাফিতে প্রদর্শিত ব্যক্তির সঙ্গে নিজেদের শরীর ও যৌন ক্ষমতার তুলনা করে আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগেন। হ্যালিফ্যাক্সে ইস্টওয়াইন্ড হেলথ এ্যাসোসিয়েটসের দুজন সাইকোথেরাপিস্ট তাদের ডাক্তারি অভিজ্ঞতা থেকে বলেন যে, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা অতিরিক্ত পর্নোগ্রাফি দেখার কারণে নিজ সঙ্গীদের সঙ্গে তাদের আবেগজনিত বিচ্ছেদ ঘটতে থাকে। এটি খুবই মারাত্মক। (আগামীকাল সমাপ্য) ০৯ জানুয়ারি ২০২২ [email protected]
×