ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

স্বীকৃতি আদায়ে জোর

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ১০ জানুয়ারি ২০২২

স্বীকৃতি আদায়ে জোর

কাওসার রহমান ॥ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার পথে মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্মম নির্যাতন নিপীড়নের কথা যতবারই শুনেছেন, তার চোখ ভিজে এসেছে। তিনি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন দেশে ফেরার জন্য। দেশে ফেরার পথে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানে বসেই তিনি রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে তার প্রথম পদক্ষেপ ঠিক করে নেন। তার সেই প্রথম ও জোরালো পদক্ষেপই ছিল ব্রিটেনসহ পশ্চিমা বিশ্বের স্বীকৃতি আদায়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকেও শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে ব্রিটেনের সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দানের বিষয়টি উত্থাপন করেন। বিভিন্ন গণামাধ্যমে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর সফরঙ্গীদের সাক্ষাতকার ও প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যাত্রাপথে বঙ্গবন্ধু কখনও কখনও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তবে দেশের মাটিতে পা রাখার আগেই তিনি একজন রাষ্ট্রনায়কের মতো বাস্তববাদী বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে শুরু করেন। বিশেষ করে ঢাকা থেকে ভারতীয় সেনাদের ফিরে যাওয়া দ্রুত করার ব্যাপারে তিনি চিন্তাভাবনা শুরু করেন। দীর্ঘ কারাবাস সত্ত্বেও শেখ মুজিবকে বেশ চাঙ্গা দেখাচ্ছিল। সবকিছুতেই তার মধ্যে প্রচন্ড উৎসাহ কাজ করছিল। বঙ্গবন্ধু নিজেকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। তার যত চিন্তা ছিল বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি জানতেন না তার ভাগ্যে কী আছে। কী ঘটতে পারে, এটা নিয়েও তার চিন্তা ছিল না। পাকিস্তানে বন্দীজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি কোন কথা বলেননি। তার কথাবার্তায় ঘুরেফিরে আসছিল সদ্য জন্ম নেয়া স্বাধীন বাংলাদেশের নানা সমস্যার কথা। উড়োজাহাজে বসেই বঙ্গবন্ধু তার সফরসঙ্গী শশাঙ্ক ব্যানার্জীকে দিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের আগেই তার কাছে একটি খবর পৌঁছে দিতে বলেন। খবরটি হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সদস্যদের ৩১ মার্চ ১৯৭২ সালের মধ্যে ভারতে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ নিয়ে তার কথা হয়েছে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী চলে গেলেই বাংলাদেশের ব্রিটিশ সরকারের স্বীকৃতি পেতে আর কোন বাধা থাকবে না। যাত্রাপথে উড়োজাহাজে বসেই বঙ্গবন্ধু জাতীয় সঙ্গীত কোনটা হবে তা ঠিক করে ফেলেন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি নিয়ে তাকে বহনকারী বিমানটি উড়তে শুরু করলে কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে গাইতে থাকেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’ তার চোখ ভরে উঠেছে জলে। তিনি ঠিক করে ফেলেন এটিই হবে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। দিল্লীতে কয়েক ঘণ্টা অবস্থানকালে উষ্ণ সংবর্ধনার পর ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের দিন তারিখ এগিয়ে আনার আহ্বান জানান শেখ মুজিব। ফলে দেশের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আর কোন প্রশ্ন থাকে না। বিজয়ের ২২ দিন পর মুক্ত বঙ্গবন্ধু ॥ পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলো। কিন্তু পূর্ণ বিজয়ের স্বাদ পাওয়া গেল সেদিন যেদিন হানাদারদের বন্দীদশা থেকে মুক্ত হন বঙ্গবন্ধু। বিজয়ের ২২ দিন পর তার মুক্তির সংবাদের মধ্য দিয়ে জাতি বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করে। জাতির জনক পাকিস্তান থেকে ছাড়া পান ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি ভোররাতে। এদিন বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেনকে বিমানে তুলে দেয়া হয়। ৮ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৬টায় তারা পৌঁছেন লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে। বেলা ১০টার পর থেকে বঙ্গবন্ধু কথা বলেন ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ, তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ আরও অনেকের সঙ্গে। প্রাণপ্রিয় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা হয় তার। পরে ব্রিটেনের বিমানবাহিনীর একটি রাজকীয় বিমানে করে পরদিন ৯ জানুয়ারি সকালে দেশের পথে যাত্রা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবরে বঙ্গবন্ধুর পরিবার, দেশের আপামর জনসাধারণ ও বিশ্ব নেতৃত্বসহ সবার চোখ ছিল লন্ডনে। সবার মুখে এক প্রশ্ন- স্বাধীন দেশে কবে ফিরবেন তিনি? লন্ডনের ক্লারিজ হোটেলের সম্মেলন কক্ষে প্রবেশের সময় বঙ্গবন্ধুকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে অভিনন্দিত করা হয়। জানতে চাওয়া হয় কেমন ছিলেন তিনি, কোথায় ছিলেন? একটি খুব খারাপ স্থানে, কল্পনাতীত একাকিত্বে বন্দীজীবন কাটাতে হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোন রেডিও নেই, চিঠি নেই। বাইরের জগতের সঙ্গে কোন যোগাযোগই ছিল না। মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। যেদিন জেলে নেয়া হলো সেদিন বাঁচব কিনা ধারণা ছিল না। তবে এটা জানতাম বাংলাদেশ মুক্ত হবেই। আমার দেশের লাখ লাখ লোককে হত্যা করা হয়েছে। নিষ্ঠুররা অত্যাচার চালিয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক রাখবে এমন কোন প্রতিশ্রুতি তিনি ভুট্টোকে দেননি উল্লেখ করে বলেন, ‘যখন তার (ভুট্টো) দেশের জনগণ তাকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছে, তখন আমি ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ দায়ে মৃত্যু দন্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কারাগারে বন্দী জীবন কাটাচ্ছি। এই ট্রাইব্যুনালের বিচারের রায় কখনও প্রকাশ করা হয়নি।’ লন্ডন থেকে টেলিফোনে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের প্রতি বঙ্গবন্ধুর প্রথম প্রশ্ন ছিল- ‘বেঁচে আছো তো?’ ২৫ মার্চের দুর্বিষহ কালরাতের এক বছর পর ৮ তারিখ শনিবার সন্ধ্যার একটু আগে হোটেল থেকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আধাঘণ্টা কথা বলেন তিনি। লন্ডনের হোটেলে আসেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথ এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রদূতসহ বাংলাদেশের কয়েকজন নেতা। বঙ্গবন্ধু নয়াদিল্লী হয়ে দেশে ফিরবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দীর্ঘ ফোনালাপে তা নির্ধারিত হয় সেই দিনই। বাংলাদেশ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এসেছিলেন ভারতের কূটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জী। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে শেখ মুজিবের বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেন ইয়ান। আর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার যোগাযোগ করিয়ে দেন আপা বি পন্থ। আধঘণ্টা ধরে ফোনে ইন্দিরার সঙ্গে কথা বলেন মুজিব। মূলত লন্ডনে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে প্রথম কার্যদিবসটিসহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু সময় পার করেন বাঙালীর নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। উপস্থিতি স্বল্প সময়ের হলেও, ব্রিটেনসহ পশ্চিমা বিশ্বের স্বীকৃতি আদায়ে এটি ছিল প্রথম ও জোরালো পদক্ষেপ। প্রভাবশালী সংবাদপত্র দ্য সানডে টাইমসের সংবাদে বলা হয়, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে ব্রিটেনের সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দানের বিষয়টি উত্থাপন করেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী (হিথ) ইতিবাচক ও বন্ধুতার মনোভাব প্রকাশ করেই বলেন, স্বীকৃতি দেয়ার পূর্বে নিয়ম অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকারকে নিশ্চিত হতে হবে, বাংলাদেশে নতুন সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সরকারের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন রয়েছে। বিমান যাত্রায় বঙ্গবন্ধু ॥ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে বহন করা ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ বিমানটি লন্ডন থেকে সাইপ্রাস ও বাহরাইন হয়ে প্রথমে দিল্লীতে নামে। লন্ডন থেকে দিল্লী পর্যন্ত যাত্রাটি ছিল ১৩ ঘণ্টার। এই উড়োজাহাজে যারা তার সফরসঙ্গী ছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন দুই ভারতীয় কূটনীতিক-ভেদ মারওয়া ও শশাঙ্ক ব্যানার্জী। এছাড়া ছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ও তার স্ত্রী হামিদা হোসেন। গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাদা সাক্ষাতকারে তারা এই বিমান যাত্রার স্মৃতিচারণ করেছেন। ওই যাত্রার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তারা জানান, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরতে উদগ্রীব ছিলেন বঙ্গবন্ধু। যাত্রাপথে বঙ্গবন্ধু কখনও কখনও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তবে দেশের মাটিতে পা রাখার আগেই তিনি একজন রাষ্ট্রনায়কের মতো বাস্তববাদী বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে শুরু করেছিলেন। বিশেষ করে ঢাকা থেকে ভারতীয় সেনাদের ফিরে যাওয়া দ্রুত করার ব্যাপারে তিনি চিন্তাভাবনা শুরু করেন সেই বিমান যাত্রাকালেই। ১৯৭২ সালে লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনে প্রথম সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন ভেদ মারওয়া। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যাত্রাপথের স্মৃতিচারণ করে ভেদ মারওয়া বলেন, ‘লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দর থেকে আমরা একটি বিশেষ বিমানে চাপলাম। আমাদের যাত্রাপথ ছিল হিথরো থেকে প্রথমে নিকোশিয়া (সাইপ্রাস), সেখান থেকে বাহরাইন, বাহরাইন থেকে দিল্লী হয়ে ঢাকা। বিমানে আমরা চার থেকে পাঁচজন লোক ছিলাম। শেখ মুজিব, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, তার স্ত্রী হামিদা হোসেন, আমি এবং শশাঙ্ক ব্যানার্জী।’ তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ কারাবাস সত্ত্বেও শেখ মুজিবকে বেশ চাঙ্গা দেখাচ্ছিল। সবকিছুতেই তার মধ্যে প্রচ- উৎসাহ কাজ করছিল। তিনি আমাকে তার পাশের আসনে বসার জন্য ডাকলেন। তিনি যখন বুঝলেন, আমি বাংলা বুঝতে পারি ও বলতে পারি, তখন আমাদের মধ্যে দ্রুত একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়ে গেল। একজন তরুণ হিসেবে শেখ মুজিবের মতো ব্যক্তিত্বের পাশে বসার অভিজ্ঞতা আমাকে সেদিন ভীষণ রোমাঞ্চিত করেছিল। তখন শেখ মুজিবকে কথায় পেয়ে বসেছিল। তিনি আমার সঙ্গে কেবল কথা বলার জন্যই কথা বলেননি। তার বলার ভঙ্গি ছিল অত্যন্ত আন্তরিক। যেন আমি তার কত দিনের চেনা।’ ভেদ মারওয়া জানান, বঙ্গবন্ধু নিজেকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। তার যত চিন্তা ছিল বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি জানতেন না তার ভাগ্যে কী আছে। কী ঘটতে পারে, এটা নিয়েও তার চিন্তা ছিল না। পাকিস্তানে বন্দীজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি কোন কথা বলেননি। তার কথাবার্তায় ঘুরেফিরে আসছিল সদ্য জন্ম নেয়া স্বাধীন বাংলাদেশের নানা সমস্যার কথা। ওই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সে সময় লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব শশাঙ্ক এস ব্যানার্জী জানান, বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানালেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিভাগের কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড ও লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আপা বি পন্থ। তাকে দেখে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ব্যানার্জী, এখানেও আছেন!’ শশাঙ্ক বলেন, ‘বিমানে পাশের আসনে বসলাম। সামনের টেবিলে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় এরিনমোর তামাক, আর সেই বিখ্যাত পাইপ। দেশে ফেরার তর সইছে না উৎফুল্ল মুজিবের। আপ্লুত কণ্ঠে শেখ মুজিব বললেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ। ব্যানার্জী, এবার একটি বিশেষ সহযোগিতা চাই।’ ব্যানার্জী বললেন, ‘আয়ত্তের মধ্যে হলে অবশ্যই চেষ্টা করব।’ ধীরলয়ে মুজিব বললেন, ‘দিল্লীতে ইন্দিরার সঙ্গে বৈঠকের আগেই তার কাছে একটি খবর পৌঁছানো দরকার। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সদস্যদের ৩১ মার্চ ১৯৭২ সালের মধ্যে ভারতে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার এ নিয়ে কথা হয়েছে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী চলে গেলে বাংলাদেশের ব্রিটিশ সরকারের স্বীকৃতি পেতে আর কোন বাধা থাকবে না।’ মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি নিয়ে বিমানটি আবার উড়তে শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধু জানালা দিয়ে মেঘের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর দাঁড়িয়ে গাইতে লাগলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ তার চোখ ভরে উঠেছে জলে। বললেন, ‘ব্যানার্জী, আপনিও ধরুন। রিহার্সেল দিয়ে নিই।’ দুজনে মিলে গানটা গাইলাম। বঙ্গবন্ধু চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করে বললেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আরও কঠোর সংগ্রাম অপেক্ষা করে আছে। বুকে শুধু একটাই বল, আমার দেশের আপামর মানুষ।’ আমাকে অবাক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘এ গানটি হবে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। কেমন হবে বলেন তো?’ আমি বললাম, ‘ইতিহাসে তাহলে প্রথমবারের মতো দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের লেখক হবেন একই ব্যক্তি -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ বিমানের যাত্রাপথে বঙ্গবন্ধুকে কলকাতা হয়ে দেশে ফেরার অনুরোধ জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বার্তা এলো। কলকাতাবাসী বঙ্গবন্ধুকে দেখতে চায়। তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফিরতি বার্তায় জানালেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে কলকাতাবাসীর সহযোগিতা তাকে কৃতজ্ঞ করেছে। কিন্তু দিল্লী হয়ে ঢাকা ফিরতে তার তর সইছে না। তবে শীঘ্রই তিনি কলকাতা যাবেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘পথ তো মনে হয় ফুরাতে চাইছে না। স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত আকাশ, মানুষ, প্রকৃতি আমাকে ডাকছে। এ যে কী অনুভূতি, আমি বোঝাতে পারব না!’ দিল্লীতে বঙ্গবন্ধু ॥ শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম দেখা হওয়ার দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। ওই দিনটি ছিল সোমবার। ব্রিটিশ সরকারের বিমানে করে সকাল আটটা নাগাদ দিল্লীর বিমানবন্দরে অবতরণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। এর ঠিক দুদিন আগেই পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন পৌঁছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমান। দিল্লী বিমানবন্দরে শেখ মুজিবকে স্বাগত জানান ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এরপর ভারতের রাজধানী দিল্লীতে শেখ মুজিবকে বিপুল সংবর্ধনা দেয়া হয়। দিল্লীর রাস্তায় তাদের গাড়ি বহরের ওপর পুষ্পবর্ষণ করা হয়েছিল। তখন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তরুণ কর্মকর্তা ছিলেন দেব মুখার্জী, যিনি পরবর্তীতে ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেদিনের ঘটনা স্মৃতিচারণ করে দেব মুখার্জী গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, এর আগে কয়েক সপ্তাহ শেখ মুজিবকে নিয়ে অনেকে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কারণ পাকিস্তানের কারাগারে তিনি বেঁচে আছেন কিনা - সেটি নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছিল অনেকের মনে। দেব মুখার্জী বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তার জন্য ভারতকে অভিনন্দন জানিয়ে শেখ মুজিব উষ্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিব একই মঞ্চে বক্তৃতা করেন সেদিন। সে ভাষণে শেখ মুজিব বলেন, ‘আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সৈন্য বাহিনী, আপনাদের জনগণ যে সাহায্য এবং সহানুভূতি আমার দুঃখী মানুষকে দেখিয়েছে, চিরদিন বাংলার মানুষ তা ভুলতে পারবে না।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক জনমত গঠনের জন্য ইন্দিরা গান্ধী কূটনীতিকভাবে যে ভূমিকা রেখেছিলেন সেজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন শেখ মুজিব। দিল্লীর ভাষণে তিনি আরও বলেন, দুদিন আগেও আমি পশ্চিম পাকিস্তানের অন্ধকার সেলের মধ্যে বন্দী ছিলাম। শ্রীমতি গান্ধী আমার জন্য দুনিয়ার এমন কোন জায়গা নাই যেখানে তিনি চেষ্টা করেন নাই আমাকে রক্ষা করার জন্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে কৃতজ্ঞ।’ ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সেটিই ছিল শেখ মুজিবের প্রথম সাক্ষাত। যদিও এর আগের দিন লন্ডনে থাকা অবস্থায় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন শেখ মুজিবুর রহমান। দেব মুখার্জী বলেন, তার আগে তো শেখ মুজিব সম্পূর্ণ পাকিস্তানের প্রাদেশিক নেতা ছিলেন। তারপরে তিনি জাতীয় নেতা হয়ে ওঠেন। তারপরে তো মিলিটারি ক্র্যাক ডাউন শুরু হয়। কাজেই ওনার সঙ্গে তো পূর্বে দেখা হওয়ার কোন সুযোগ হয়নি। দিল্লীতে কয়েক ঘণ্টা অবস্থানকালে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মন্ত্রিসভার সদস্য, তিন বাহিনী প্রধানসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং দেশটির জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা লাভ করেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিবুর রহমান। সংবর্ধনার পর ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের দিন তারিখ এগিয়ে আনার আহ্বান জানান শেখ মুজিব। ফলে দেশের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আর কোন প্রশ্ন থাকে না। বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনার প্রস্তুতি ॥ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সদ্যস্বাধীন দেশের মানুষজন সে সময় তাকে দেখার জন্য, তার কথা শোনার জন্য ব্যাকুল। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিনটি ঘিরে সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করছিল। গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাতকারে সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রখ্যাত গেরিলা যোদ্ধা অভিনেতা কামরুল আলম খান খসরু। তিনি বলেন, ‘৯ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগের দিন আমাকে ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) বিএলএফ’র তিন কমান্ডার তথা ‘নিউক্লিয়াসে’র নেতৃবৃন্দ সিরাজ (সিরাজুল আলম খান) ভাই, রাজ্জাক (প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক) ভাই ও আরেফ (কাজী আরেফ আহমেদ) বললেন, বঙ্গবন্ধু আগামীকাল আসবেন। তারা আমাকে দেরাদুনে ট্রেনিং নেয়া গ্রুপের ছেলেদের নিয়ে এয়ারপোর্টে যেতে বললেন। তবে তাদের কাছে কোন অস্ত্র থাকবে না। শুধু আমার কাছে অস্ত্র রাখতে বললেন।’ তারা বললেন, ‘আগামীকাল সকালে তোমাদের নেয়ার জন্য একটি ট্রাক আসবে। তুমি প্রস্তুত থাকবে। তোমার গ্রুপের ছেলেদের নিয়ে ওই ট্রাকে যাবে। আমি আমার সহযোদ্ধাদের ডেকে বিষয়টি বুঝিয়ে বললাম। সেখানে আমার সেকেন্ড ইন কমান্ড মুরাদ, বেবী, জাহাঙ্গীর, মনিসহ আরও অনেকে ছিলেন।’ ১০ জানুয়ারি সকালে ইকবাল হলের সামনে ট্রাক আসল। ট্রাক যখন চলতে শুরু করল তখন তারা স্লোগান দিতে শুরু করলেন। ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দিতে তারা বিমানবন্দর অভিমুখে যাত্রা করেন। বিমানবন্দরে যাওয়ার পর নিউক্লিয়াস ও বিএলএফ নেতারা তাকে একটি সিঁড়ি দেখিয়ে বললেন, এই সিঁড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধু প্লেন থেকে নামবেন। ওই সিঁড়িতে উঠে তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন। পুরো বিমানবন্দর এলাকায় বঙ্গবন্ধু নামে স্লোগান চলছে, মিছিল হচ্ছে। প্লেনটি ঢাকার তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দরে যখন আসল তখন অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। প্লেনের পাইলট রানওয়ে থেকে সবাইকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানান কন্ট্রোল রুমে। সময়ক্ষেপণের জন্য প্লেনটি আকাশে আরেকবার ঘুরে রানওয়েতে ল্যান্ড করল। সিঁড়িটি সরিয়ে নিয়ে প্লেনের গেটে লাগিয়ে দেয়া হলো। বঙ্গবন্ধু যখন প্লেন থেকে নেমে এলেন সবাই চিৎকার করে, স্লোগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানালেন। হয়ে পড়লেন আবেগাপ্লুত। বঙ্গবন্ধু তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘অনেক কষ্ট করেছিস। তাহলে তোরা পারলি।’ আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। শুধু চোখ দিয়ে আনন্দের জল গড়িয়ে পড়ল। আমার পরেই দাঁড়ানো ছিল মহিউদ্দিন। বঙ্গবন্ধু মহিউদ্দিনের সঙ্গে হাত মেলালেন। তারপর আরেকজন দাঁড়িয়ে ছিল। উনি বঙ্গবন্ধুকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিলেন। ফুলের মালা দেয়ার দৃশ্যের ভিডিওটি এখনও সম্প্রচার করা হয়। এরপর তৎকালীন সেনাপতি শফিউল্লাহ, শেখ কামাল এবং খসরু বঙ্গবন্ধুকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু সালাম গ্রহণ করেন। পরে তারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ট্রাকের কাছে চলে আসেন। খসরু বঙ্গবন্ধুকে ধরে ট্রাকে তুলে নেন। এরপর একে একে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দও ট্রাকে ওঠেন। তবে ট্রাকে আরও অনেকেই উঠতে চাইলেও আর কাউকে উঠতে দেয়া হয়নি।
×