ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শত বছর পর জাদুঘর হচ্ছে চট্টগ্রামের সেই অস্ত্রাগার

প্রকাশিত: ২২:০৮, ১০ জানুয়ারি ২০২২

শত বছর পর জাদুঘর হচ্ছে চট্টগ্রামের সেই অস্ত্রাগার

জনকণ্ঠ ফিচার ॥ যুব বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা যুদ্ধ- দুটোই বাঙালীর ইতিহাসে সোনালি অধ্যায়। এই দুই অধ্যায়ের ইতিহাস সংরক্ষণ কাজ চলছে একটি জাদুঘরে, যার নাম ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।’ প্রায় শত বছর পর চট্টগ্রামের দামপাড়া পুলিশ লাইন্সে থাকা সেই অস্ত্রাগারটি সংস্কার করে জাদুঘরে রূপ দেয়া হচ্ছে। সেখানেই সংরক্ষণ করা হবে অগ্নিযুগের বিপ্লবী এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের লড়াকু সৈনিকদের স্মৃতিচিহ্ন। রবিবার দামপাড়া পুলিশ লাইন্সে গিয়ে দেখা যায়, তৎকালীন ব্রিটিশ পুলিশের অস্ত্রাগার ও ব্যারাক সংরক্ষণ করে তৈরি হচ্ছে ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, চট্টগ্রাম’। ব্রিটিশ নির্মিত পুরাতন অস্ত্রাগারের লাল দালানটির অবকাঠামো ঠিক রেখেই ইতিহাস সংরক্ষণের কাজ চলছে। ঐতিহাসিক এই লাল দালানটির সামনে পোড়া মাটির ফলকে সূর্যসেন, প্রীতিলতা ও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য খুদিত করা কাজ শেষ হয়েছে। শহীদ মিনারের সংস্কারের কাজও শেষ। জাদুঘরটির ভেতরে চলছে ইতিহাস সংরক্ষণ যজ্ঞ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই অস্ত্রাগারের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এ উদ্যোগ নেয়ার কথা বলেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। স্বাধীনতা দিবসের আগে এ জাদুঘর সবার জন্য উন্মুক্ত করার আশা প্রকাশ করেছেন তারা। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা চট্টগ্রামের দামপাড়ার পুলিশ ব্যারাক ও অস্ত্রাগার দখল করে নেয়। মহানগর পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, পুরনো অস্ত্রাগারের আদল ঠিক রেখেই সংস্কার করা হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে তৎকালীন পুলিশ ব্যারাকটিও। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের স্মৃতিবিজড়িত এই অস্ত্রাগারটি প্রায় ৯১ বছর পর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে একাধিক সরকারী স্থাপনায় বিপ্লবীদের অভিযানের পর চারদিন ‘স্বাধীন’ ছিল চট্টগ্রাম। ওই বছরের ১৮ এপ্রিল মাস্টার দা’র নেতৃত্বে গঠিত ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’ দামপাড়ার এই অস্ত্রাগার, পাহাড়তলীর রেলওয়ে অস্ত্রাগার, নন্দনকানন টিএ্যান্ডটি অফিসসহ একযোগে একাধিক স্থানে হামলা চালায়। ব্রিটিশ পুলিশের সেই অস্ত্রাগারসহ সকল স্থাপনা সফলভাবে দখলের পর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জালালাবাদ পাহাড়ে অবস্থান নেন বিপ্লবীরা। এরপর ২২ এপ্রিল পর্যন্ত স্বাধীন ছিল চট্টগ্রাম। দুইশ’ বছরের ব্রিটিশ শাসনামলে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে সেই প্রথম বিজয় পতাকা উড়েছিল চট্টগ্রামে। সেই ঘটনায় করা মামলায় মাস্টার দা’র সন্ধান চেয়ে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার। পরে ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মাস্টার দা ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাঁসি দেয়া হয়। চট্টগ্রামে যুব বিদ্রোহের স্মৃতিবিজড়িত কোন জাদুঘর এখনও নির্মাণ করা হয়নি। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ দামপাড়া পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করে পাকিস্তানী বাহিনী। সম্মুখযুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ দামপাড়া পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করে পাকিস্তানী বাহিনী। প্রাণপণ লড়ে যান পুলিশ সদস্যরা। সেই পুলিশ লাইন্সই ৪১ বছর পর বাঙালীর ইতিহাসের আরেক ঘটনার সাক্ষী হয়। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করে পাকিস্তানী বাহিনী। এবারও লড়াই করেন পুলিশ বাহিনীর বাঙালী সদস্যরা। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে চট্টগ্রামে পুলিশ বাহিনীর ৮১ জন সদস্য শহীদ হন। ‘ইতিহাসের খসড়া’র সম্পাদক ও গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হক বলেন, দামপাড়া পুলিশ লাইন্সের রেঞ্জ ইন্সপেক্টর আকরাম হোসেন, কোতোয়ালি থানার ওসি আব্দুল খালেক, তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার এম শামসুল হক, দুর্নীতি দমন বিভাগের উপ-পরিচালক নাজমুল হকসহ আরও অনেকে চট্টগ্রামে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি বলেন, ৫০ বছর পরে হলেও এই জাদুঘরটি নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন করবে। প্রজন্ম ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালীর গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাস জানতে পারবে। জাদুঘর যেমন হবে ॥ ১৬ হাজার বর্গফুট জায়গা নিয়ে গড়ে উঠছে এই জাদুঘর। পুলিশ ব্যারাকের পেছনে একটি স্থাপনা তৈরি করে এর আকার বাড়ানো হচ্ছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিপ্লবীদের ভূমিকা জনগণের কাছে তুলে ধরতে জাদুঘরে মাস্টার দা’র ফাঁসি মঞ্চের আদলে একটি রেপ্লিকা তৈরি করা হবে, রাখা হবে বিপ্লবীদের ছবি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের ভূমিকার কথাও সংরক্ষণ করা হবে। সঙ্গে থাকবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী পুলিশ সদস্যদের স্মৃতিও। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর যে ৮১ জন সদস্য চট্টগ্রামে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, সেই ইতিহাসও তুলে ধরা হবে। জাদুঘরের সীমানা প্রাচীরে ৮১ পুলিশ সদস্যের নাম লেখা থাকবে। পাশাপাশি নতুন করে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির পরিকল্পনাও আছে। এই জাদুঘরে একটি বঙ্গবন্ধু কর্নার থাকবে, যেখানে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের চট্টগ্রামের অংশটির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারক, তথ্য ও চিত্র থাকবে।
×