ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

টুটুল মাহফুজ

গবেষণায় বাড়বে শিক্ষার মান

প্রকাশিত: ০০:২৫, ৯ জানুয়ারি ২০২২

গবেষণায় বাড়বে শিক্ষার মান

বর্তমান বিশ্ব হচ্ছে জ্ঞানভিত্তিক। মানসম্পন্ন শিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত ও কার্যকর জ্ঞান অর্জন করতে হয়। যারা যত বেশি প্রায়োগিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে; তারাই প্রতিযোগিতামূলক সমকালীন বিশ্বে টিকে থাকার যোগ্যতা অর্জন করে। ফলে দেশে দেশে উচ্চশিক্ষা অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সক্ষমতা ও মানোন্নয়নে জোর দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা হতাশাজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ হলো গবেষণা। কিন্তু দেশের সরকারি-বেসরকারি উভয় ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণায় খুব একটা মন নেই। অথচ উচ্চশিক্ষার মান বাড়াতে গবেষণা অন্যতম পূর্বশর্ত। উন্নত দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা খাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে গবেষণার মতো অত্যাবশ্যকীয় খাতে এমন অর্থ ব্যয় করা হয়, যা উল্লেখ করার মতো নয়। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে নামকাওয়াস্তে গবেষণা পরিচালনা করা হয়। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এক-তৃতীয়াংশই নিজেদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে মনে করে। এগুলোর দুই-তৃতীয়াংশই নামকাওয়াস্তে গবেষণা খাতে খরচ দেখায়। মাত্রাতিরিক্ত ব্যবসায়িক মনোভাবের কারণে এসব প্রতিষ্ঠান গবেষণা নিয়ে চিন্তা করে না। ফলে দেশের উচ্চশিক্ষার মান এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এর প্রমাণ হলোÑ বিশ্বের এক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় স্থান পায়নি আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ৪৭তম বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা কার্যক্রমের চরম দুরবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে। ২০২০ সালে ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ১০৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিল। এর মধ্যে আটটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ২৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় এক টাকাও ব্যয় করেনি। এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩১, পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৩। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ বেসরকারি। বার্ষিক প্রতিবেদনে আরো দেখা গেছে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় নামকাওয়াস্তে গবেষণা খাতে কিছু টাকা খরচ করে দায় সেরেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় ৬৫ লাখ টাকা খরচ করলেও ২০২০ সালে একটি প্রকাশনাও প্রকাশ করতে পারেনি। হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় এক কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় করলেও তাদের প্রকাশনা ছিল মাত্র একটি। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র দুটি করে প্রকাশনা প্রকাশ করেছে। তবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ৭০ লাখ টাকা এবং রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তিন লাখ ৪৩ হাজার টাকা ব্যয় করলেও একটি করে প্রকাশনা প্রকাশ করেছে। ২০২০ সালে গবেষণায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ৫৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা। তাদের প্রকাশনার সংখ্যা ছিল ৩৭৮। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গবেষণায় সবেচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ছয় কোটি ৬১ লাখ টাকা। তাদের প্রকাশনার সংখ্যা ছিল ৪৪৫ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাঙ্খিতমানের গবেষণা কার্যক্রম না থাকায় সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে আমরা দিন দিন পিছিয়ে পড়ছি। দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠছে না। শিক্ষিতরা দেশের বাইরে গিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে গবেষণা এগিয়ে নিয়ে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কাক্সিক্ষত মানে নিয়ে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদেরও নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞান চর্চার অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে মনোযোগ দিতে হবে। গবেষণা ছাড়া এমন পরিবেশ সম্ভব নয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাক্সিক্ষত মানের গবেষণার জন্য সরকারকে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাধ্য করতে হবে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ খরচ করতে, যাতে মেধাবী যারা গবেষণার জন্য বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা শেষে ফের দেশে এসে দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করতে আগ্রহী হন। এ জন্য প্রয়োজন তাদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দেশে রাখার উদ্যোগ নেয়া। ইউজিসিকেও গবেষণার বিষয়ে কঠোর নজরদারি করতে হবে, যাতে কেউ গবেষণা কার্যক্রমে উদাসীন থাকার অবকাশ না পায়। তা হলেই দেশের উচ্চশিক্ষার মান কাক্সিক্ষত পর্যায়ে ফিরে আসতে পারে।
×