ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিউলী আহ্মেদ

শহুরে শীত

প্রকাশিত: ২১:৩৪, ৯ জানুয়ারি ২০২২

শহুরে শীত

পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে/আয় রে চলে আয় আয় আয়/ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে/মরি হায় হায় হায়। বইছে শীতের হিম শীতল ঠা-া বাতাস। কখনও হাল্কা কুয়াশা, কখনও ঘন সাদা। কখনও বইছে শৈত্যপ্রবাহ, কখনও হাল্কা মিষ্টি উষ্ণ রোদ। পৌষ-মাঘ দুই মাস শীতকাল হলেও হেমন্তের মাঝামাঝি থেকেই হাল্কা ঠাণ্ডা বাতাস বইতে থাকে প্রকৃতিতে। এই সময়ে সকালের হিম হিম বাতাসটা মন ছুঁয়ে যায়। কখনও হাল্কা কুয়াশাও দেখা যায়। যান্ত্রিক এ শহরে হেমন্ত আর শীতের এই আগমনী বার্তা গ্রামের মতো পাওয়া যায় না। তবু যতটা পাওয়া যায় আমাদের মতো যারা প্রকৃতিপ্রেমী, তারা লুফে নেই। শীতের চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে নেই। শহরে গ্রামের মতো নেই নবান্ন উৎসব। নেই শীতের তেমন প্রস্তুতি। কিন্তু বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হেমন্ত আর শীতকে বরণ করা হয়। বিভিন্ন জায়গায় পিঠা-পুলির মেলাও হয়। ফলে শহরে আমরা গ্রামের কিছুটা হলেও আমেজ পাই। শিশুরা আমাদের এত সুন্দর ঋতুগুলো সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানতে পারে। ঘরে ঘরে কম-বেশি পিঠা উৎসব চলে। ছোটবেলায় বইতে যখন নবান্ন উৎসবের কথা পড়তাম, শীতের পিঠাপুলির কথা শুনতাম, ভীষণ পুলক অনুভব করতাম। শহরে জন্ম আর বেড়ে ওঠার কারণে গ্রামের এ উৎসবগুলো আমাদের দেখা হয়নি। বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস পড়ে যতটা জেনেছি, মনের মধ্যে একটা ছবি এঁকে নিয়েছি। তাই এসব উৎসবের দিনগুলো আসার সময় ঘনিয়ে এলেই মনটা কেমন আনচান করে ওঠে। মন চলে যায় কুয়াশাঘেরা গাঁয়ের মেঠো পথে। দু’পাশে ফসলের খেত- ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, শীতের বিভিন্ন রকমের শাক-সবজি, হলুদ শর্ষে খেত লাউ-শিমের মাচা- আরও কত কি কল্পনায় ভাসে! সবুজ ঘাসের ওপর পড়ে থাকা মুক্তা দানার মতো শিশির কণা! হাত বুলিয়ে আলতো করে গালে লাগাতে কি যে ভাল লাগে! সবুজ ধানখেতের মাঝখানে আইল ধরে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। ভোরের শিশির কণাগুলোর শিষ ছুঁয়ে থাকা! পাকা সোনালি ধানের শিষের ভারে নুইয়ে পড়া খেতের পাশে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে কি শান্তি! হিমশীতল ভোরের এই অনুভূতিটা শিহরিত করে মনকে। আমাদের জেলায় একটা ভাত হয়, যেটাকে বলে কাঞ্জির ভাত। বেশ কদিন ধরে কিছু চাল একটা মাটির হাঁড়িতে পানিতে ডুবিয়ে রেখে চুলার পাশে রেখে দিতে হয়। এটা রান্না করলে টক টক ঘ্রাণ আর স¦াদ লাগে। খুব ছোটবেলায় যখন গ্রামে যেতাম আমার জ্যাঠাত বোন এই ভাত রান্না করে আমাদের খাওয়াতেন, নরসিংদীর বিখ্যাত চ্যাপা/পুঁটি শুঁটকি ভর্তা দিয়ে। অমৃতের মতো লাগত। তারপর শুরু হতো পিঠার আয়োজন। আমাদের এলাকায় ম্যারা পিঠা হয়। একে আমরা জাতীয় পিঠা বলি। কারণ, যে কোন উৎসবে অন্যান্য পিঠার সাথে এই পিঠা থাকবেই। চালের গুঁড়ায় লবণ-পানি মাখিয়ে হাতে গোল করে বিভিন্ন রকম আকার দিয়ে ভাঁপে সিদ্ধ করে বানানো হয় এই পিঠা। আমি ছোট করে ঢাকনাসহ হাঁড়ি বানাতাম। আপা এর মধ্যে ছোট ছোট করে ভাত বানিয়ে দিয়ে ঢাকনাটা সুন্দর করে লাগিয়ে দিতেন। পিঠা চুলা থেকে নামানোর পর আমি হাঁড়ি খোঁজার ধান্দায় থাকতাম। ঢাকনাটা খুলে আগে ভেতরের ভাতগুলো খেয়ে নিতাম। আহা! এই ছোট্ট মেয়ের মুখে কি যে তৃপ্তি ছিল সেই ভাতের! সঙ্গে থাকে আরও বিভিন্ন রকমের পিঠা যেমন- ফুলপিঠা (যাকে নক্সী পিঠা বলে), ঝিলিমিলি পিঠা (সিরিঞ্জ দিয়ে পেঁচিয়ে ভাঁজ করে বিভিন্ন আকৃতি দেয়া হয়) পাতা পিঠা (কাঁঠাল পাতা বা কলাপাতায় পাতলা গোলা দিয়ে তাপ দিয়ে রোদে শুকাতে হয়) আর থাকত ভাঁপা পিঠা। চুলার পাশে বসে শীতের দিনে এসব ধোঁয়া ওঠা পিঠা খাওয়ার যে আনন্দ, তা আর কিছুতে নেই। ঘুম থেকে উঠেই দেখতাম উঠানে আগুন জ্বালানো হয়েছে আগুন পোহানোর জন্য। শহরে কোথায় পাব এই শীতের আমেজ! তবে শীতের আগমনীতে শহরের বিভিন্ন জায়গায় ফুটপাথে ভাঁপা পিঠা আর চিতই পিঠা নিয়ে বসে নিম্ন আয়ের মানুষ। সঙ্গে থাকে তেলের পিঠা, কোথাও পাটিসাপটাও পাওয়া যায়। আমরাও উৎসব উৎসব ভাব নিয়ে মেতে উঠি পিঠা খাওয়ায়! সন্ধ্যায় বাইরে কোন কাজ না থাকলেও শুধু পিঠা খাওয়ার জন্য বের হই। এখন অবশ্য চিতই পিঠা সারা বছরই পাওয়া যায়। শহুরে শীত মানেই পথের ধারের এসব পিঠা-পুলির উৎসব। আমরা যারা চাকরিজীবী, তারা অফিস থেকে বের হয়েই সহকর্মীরা মিলে পিঠা খেতে দাঁড়িয়ে যাই। এই হিম হিম ঠাণ্ডায় পথের ধারের এসব ধোঁয়া তোলা পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। যান্ত্রিক এ শহরে শীত আসে বিলাসিতা নিয়ে। আগের মতো তীব্র শীত আর এখন শহরে অনুভূত হয় না। তবু নতুন চাদর-সোয়েটার, কম্বল কেনার ধুম পড়ে যায়। কুয়াশাচ্ছন্ন হিম হিম শীতের ভোরে মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় রেললাইন ধরে হারিয়ে যাই কুয়াশার আঁধারে।
×