ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সম্ভাবনার হাতছানি

নাটেশ্ব¦রে প্রত্নতত্ত্ব অনুসন্ধান ও খনন শুরু

প্রকাশিত: ০০:৩০, ৮ জানুয়ারি ২০২২

নাটেশ্ব¦রে প্রত্নতত্ত্ব অনুসন্ধান ও খনন শুরু

স্টাফ রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ ॥ টঙ্গীবাড়ি উপজেলার আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের নাটেশ্বরে মাটির নিচে আবিষ্কৃত হাজার বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ নগরীতে শুক্রবার নতুন করে খনন কাজ শুরু হয়েছে। গবেষকরা মনে করছেন, আরও নতুন আবিষ্কারে সমৃদ্ধ হবে বাংলার ইতিহাস। মাটির নিচ থেকে আরও নতুন প্রত্ন নিদর্শন বের করতে ১০ম বছরের মতো খননকাজ শুরু হয়েছে। শুক্রবার সকালে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এই খনন কাজের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আবুল মনসুর। উদ্বোধন শেষে সম্পূর্ণ খনন এলাকা পরিদর্শন করেন অতিথিবৃন্দ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আলোচনা সভায় অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের সভাপতি ড. নূহ- উল-আলম লেনিনের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের মহাপরিচালক রতন চন্দ্র পন্ডিত, প্রকল্পের গবেষণা পরিচালক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড.সুফি মুস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ। পরে সদর উপজেলার রঘুরামপুরে বিক্রমপুরী বৌদ্ধ বিহার উন্মুক্ত জাদুঘরে ভোজনালয় উদ্বোধন করেন অতিথিবৃন্দ। পর্যটকদের সুবিধার্থে এই ভোজনালয় উদ্বোধন করা হয়। এর আগেই হাজার বছরের প্রাচীন ও দুষ্পাপ্য নিদর্শন আবিষ্কার করা হয়। পুরাকীর্তি বের করে আনার এই আয়োজন দেখতে আসছেন কৌতূহলী অনেকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হতে যাচ্ছে বিক্রমপুরের প্রত্নসম্পদ। বিক্রমপুরকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের রাজধানী উল্লেখ করে শুক্রবার খননকাজ উদ্বোধনের পর সংস্কৃতি সচিব বলেন, বিক্রমপুর ঘিরে প্রত্নশিল্পে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে। এখানকার প্রায় ১০ একর জায়গাজুড়ে চলছে এই প্রত্নখনন। ৭৮০ থেকে ১২২৩ খ্রিস্টাব্দ সময়ের নানা প্রত্ন নিদর্শন এরইমধ্যে আবিষ্কার হয়েছে। আরও নতুন নিদর্শনের সন্ধানে এভাবেই চলছে খনন কাজ। সম্ভাবনার হাতছানি ॥ প্রাচীন সভ্যতার জনপদ বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জ বৌদ্ধবিহার ও মন্দিরের সমন্বয়ে গড়া ছিল এক পরিকল্পিত জনপদ। বিক্রমপুর অঞ্চলে চলমান প্রতœতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণায় এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত স্থাপনা ও তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে গবেষকরা এ তথ্য জানিয়েছেন। এ জনপদকে ঘিরে প্রাচীন নিদর্শন প্রাপ্তির সম্ভাবনার দ্বার খুলছে। নাটেশ্বরে এখন সম্ভাবনার হাতছানি। গবেষকরা মনে করছেন, বৌদ্ধদের তীর্থস্থান তথা বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হতে যাচ্ছে নাটেশ্বর। এ পর্যন্ত ইট নির্মিত একাধিক বৌদ্ধ মন্দির, অষ্টকোণাকৃতির স্তূপ, ইট নির্মিত রাস্তা, ড্রেন, বিভিন্ন পরিমাপের কাজের কক্ষ এবং নানা রকম স্থাপত্য নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। নতুনভাবে উৎখননে আরও প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কারের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বিক্রমপুর অঞ্চলে নতুন বছরের উৎখনন উদ্বোধন হয়েছে। প্রায় ১১শ’ বছর আগের এই জনপদ ছিল বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারক ও পন্ডিত শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থান। আধুনিক যুগে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন রূপ হলো বৌদ্ধবিহার, যেখানে ধর্মশাস্ত্রের পাশাপাশি জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা করা হতো। আর স্তূপ হলো বৌদ্ধদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বিশেষ স্থান। প্রাচীন বিক্রমপুর অঞ্চল একসময় ছিল সমতটের রাজধানী। চীনা পরিবার্জক হিউয়েন সাঙ তার লেখায় এই অঞ্চলে ৩০টি বৌদ্ধবিহারের কথা উল্লেখ করেছেন। গবেষকদের মতে, ওই ৩০টি বিহারের অনেকটাই ছিল প্রাচীন বিক্রমপুরে। অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এবং পরিচালনায় ২০১০ সাল থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র ‘ঐতিহ্য অন্বেষণ’ বিক্রমপুর অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা কাজ শুরু করে। ২০১৩ সাল থেকে টঙ্গীবাড়ি উপজেলার নাটেশ্বর দেউলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চলমান রয়েছে। প্রায় ১০ একর ঢিবিতে উৎখনন কাজ চলছে। উদ্বোধনী আয়োজনটিতে সভাপতিত্ব করবেন এই খনন কাজের উদ্যোক্তা অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও বিক্রমপুর অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা কর্মসূচীর কর্মসূচী পরিচালক ড. নূহ-উল-আলম লেনিন। বিক্রমপুর অঞ্চলে প্রতœতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা কর্মসূচীর গবেষণা পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান আয়োজনটি পরিচালনা করবেন। গেল বছর উৎখননের পর বর্ষা মৌসুমের আগে বিশেষভাবে ঢেকে দেয়া হয়। শুষ্ক মৌসুম আসায় আবার নতুন করে খনন করার উপযোগী করা হয়েছে। উদ্বোধনী দিন থেকে খনন কাজে নিয়োজিত হবেন গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীসহ উৎখননে অভিজ্ঞ কর্মীরা। এর আগে এই খনন কাজে চীনা অধ্যাপকসহ বেশ কয়েকজন চীনা গবেষকও যৌথভাবে অংশ নেন। তবে এ বছর এখনই চীনা গবেষকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়নি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান আশা প্রকাশ করেন, নতুন এই উৎখননে এ বছরও প্রাচীন নিদর্শন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নাটেশ্বর দেউলে হাজার বছরের প্রাচীন নানা নিদর্শন মাটি চাপা পরে আছে। নাটেশ্বর ঘিরে নতুন পর্যটন জোন হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ইতিহাস ॥ পূর্বে বিক্রমপুরের অধিকাংশ স্থাপনা কীর্তিনাশা পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া আশঙ্কা করা হতো। সর্বপ্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক নলিনীকান্ত ভট্টশালীর লেখায় বিক্রমপুরের (উয়ারী-বটেশ্বর ও নাটেশ্বর) প্রত্নতাত্ত্বিক অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। ২০১০ সালে রামপাল ও বজ্রযোগিনী ইউনিয়নের তিনটি গ্রামের ৯টি স্থানে পরীক্ষামূলক খনন শুরু হয়। যার ধারাবাহিকতায় রামপালের রঘুরামপুরে ৯৯০-১০৫০ খ্রিস্টাব্দে বৌদ্ধবিহার আবিষ্কৃত হয়। এরপর ২০১২-১৩ সালে নাটেশ্বরে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু হয়। ২০১৪ সালে চীনের হুয়ান প্রাদেশিক প্রত্নতাত্ত্বিক ইনস্টিটিউটের গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাটেশ্বরের খনন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়। ২০১২-১৩ সাল থেকে নাটেশ্বর দেউলে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় মাটির নিচ থেকে নাটেশ্বরে প্রাচীন মানব বসতির চিহ্ন আবিষ্কৃত হয়। ২০১৩ সালেই নাটেশ্বরে বৌদ্ধমন্দির, অষ্টকোণাকৃতি স্তূপ, ইট নির্মিত রাস্তা ও নালা প্রভৃতি নিদর্শন বেরিয়ে আসে। এছাড়া অষ্টকোণাকৃতির স্তূপের পাশে অষ্টম-নবম শতকে নির্মিত ১০০ বর্গমিটার আয়তনের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। ২০১৩ থেকে ২০১৯ এ সময়ে প্রায় ছয় হাজার বর্গমিটারের বেশি এলাকায় প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণা চলে। প্রাচীন এ জনপদে হাজার বছর আগের আলোকিত সভ্যতার হাতছানি দেয় প্রতœতত্ত্ব এ গবেষণায়।
×