ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

টাকা নেই বলে বের করে দেয়ায় শিশুর মৃত্যু ॥ মালিক গ্রেফতার

হাসপাতাল নয়, যেন কসাইখানা!

প্রকাশিত: ২২:৪৭, ৮ জানুয়ারি ২০২২

হাসপাতাল নয়, যেন কসাইখানা!

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কী অমানবিক! হাসপাতাল নয় যেন কসাইখানা! টাকা দিতে না পারায় এনআইসিইউ থেকে চিকিৎসাধীন দুই যমজ শিশুকে বের করে দেয়ায় একজনের মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় শুক্রবার গ্রেফতার করা হয় রাজধানীর শ্যামলীর ‘আমার বাংলাদেশ হাসপাতালের’ মালিক গোলাম সারওয়ারকে। এ ঘটনায় র্যা ব সদর দফতরের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, এই হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে দেখা গেল চরম অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও অরাজকতা। যেমন নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালটিতে দুটি আইসিইউ থাকার কথা। কিন্তু সেখানে ৬টি আইসিইউ অর্থাৎ ৪টি আইসিইউ বেশি। এরমধ্যে ভেন্টিলেটর রয়েছে মাত্র দুটিতে। ৯টি এনআইসিইউ থাকলেও ইনকিউবেটর মাত্র একটি। করোনাকালে আইসিইউর চাহিদা বেশি থাকার সুযোগে অধিক মুনাফার ফাঁদ হিসেবেই অনুমোদন ছাড়াই চলছিল অতিরিক্ত চারটি আইসিইউ। শুধু তাই নয়, ৩০টি সাধারণ বেড থাকার কথা থাকলেও রয়েছে ১৫টি। পরিচালনার বিধি মোতাবেক ৬ জন নার্স থাকার কথা থাকলেও নার্স রয়েছে মাত্র দুজন। আর তিনজন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও একজনের দায়িত্বে চলছিল আমার বাংলাদেশ হাসপাতালটির সার্বিক ব্যবস্থাপনা। যদিও সেই নার্স ও চিকিৎসক আইসিইউ ও এনআইসিইউ পরিচালনার মতো অভিজ্ঞ ছিলেন না। সাধারণ নার্স ও চিকিৎসক তারা। তিনি জানান, সরকারী হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে আমার বাংলাদেশ হাসপাতালে ভর্তি করার পর বিলের ফাঁদে জিম্মি করা হতো। আদায় করা হতো মোটা অঙ্কের টাকা। বনিবনা না হলে বের করে দেয়া হতো। শুক্রবার র্যা ব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাজধানীর শ্যামলীতে বেসরকারী ‘আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল’ এ সম্পূর্ণ বিল পরিশোধ না করায় চিকিৎসাধীন যমজ শিশুকে জোর করে বের করে দেয়ার ফলে যমজ এক শিশুর মৃত্যু ও অপর শিশুর আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়। নির্মম ও অমানবিক এ ঘটনায় দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় র্যা ব তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের পাশে দাঁড়ায়। যমজ সন্তান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় ভুক্তভোগী মোহাম্মদপুর থানায় আমার বাংলাদেশ হাসপাতালের মালিক ও পরিচালককে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার পর র্যা ব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় র ্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা এবং র ্যাব-২ ও র ্যাব-৩ এর যৌথ অভিযানে শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে আমার বাংলাদেশ হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ গোলাম সারোয়ারকে গ্রেফতার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার গোলাম সারওয়ার জানায়, আমার বাংলাদেশ হাসপাতালে রোগী ভর্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারী হাসপাতালে দালাল নিয়োগ করা আছে। দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বেসরকারী ওই হাসপাতালটিতে গত ২ জানুয়ারি যমজ শিশুকে ভর্তি করা হয়। ভর্তির পর থেকে বিল পরিশোধের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয় অন্যথায় চিকিৎসা করা হবে না বলে জানায়। ভিকটিম ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করে। তবে অতিরিক্ত আরও টাকা দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। টাকা না দেয়ায় চিকিৎসা বন্ধ রাখা হয় বলে ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন। একপর্যায়ে অর্থ না পাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ভুক্তভোগীর যমজ সন্তানকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হয়। গ্রেফতার সারওয়ার র ্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সে দীর্ঘ ২০-২২ বছর যাবত রাজারবাগ, বাসাবো, মুগদা, মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী এলাকায় ৬টি হাসপাতাল পরিচালনা করে আসছে। সেগুলো হলো ঢাকা ট্রমা, বাংলাদেশ ট্রমা হাসপাতাল, মমতাজ মেমোরিয়াল ডায়াগনস্টিক, আরাব ডায়াগনস্টিক, মোহাম্মদিয়া মেডিক্যাল সার্ভিসেস ও আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল। এরমধ্যে আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল বাদে সবই বন্ধ করেছেন নানা অনিয়ম ও প্রতারণার অভিযোগ ওঠার পর। প্রায় এক বছর যাবত শ্যামলীতে ‘আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল’ খুলে পুনরায় ব্যবসা শুরু করেন। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি আমার বাংলাদেশ হাসপাতালের সঙ্গে দালাল সিন্ডিকেট জড়ান। বিভিন্ন সরকারী হাসপাতাল হতে রোগীদের ফুঁসলিয়ে নিজের হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসতেন। গ্রেফতার আমার বাংলাদেশ হাসপাতালের মালিক গোলাম সারওয়ার জানান, হাসপাতাল পরিচালনার বিধি মোতাবেক সার্বক্ষণিক ৩ জন চিকিৎসক ডিউটিরত থাকার কথা থাকলেও সার্বক্ষণিক একজন ডিউটিতে থাকত। হাসপাতালটিতে ২টি আইসিইউসহ ৩০টি বেডের প্রাধিকার রয়েছে। তার হাসপাতালে ৬টি আইসিইউ অর্থাৎ ৪টি আইসিইউ বেশি। তন্মধ্যে ভেন্টিলেটর রয়েছে ২টির। ৯টি এনআইসিইউ থাকলেও ইনকিউবেটর ছিল ১টি ও ১৫টি সাধারণ বেড রয়েছে। মূলত আইসিইউ কেন্দ্রিক ব্যবসার ফাঁদ তৈরি করে সে অবৈধ ব্যবসা করে যাচ্ছে। র্যা ব জানায়, অনুমোদন পাওয়ার শর্ত না মেনেও কি করে হাসপাতালটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন পেয়েছে সে বিষয়ে কোন তথ্য র্যা ব পেয়েছে কিনা জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, বিগত সময়ে যখনই অনিয়ম-প্রতারণা ও রোগী জিম্মির বিষয়টি সামনে এসেছে তখনই তিনি হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি বন্ধ করেছেন। এরপর নতুন নামে ফের আরেকটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন। তিনি যখন অনুমোদন পান তখন হয়তো সে ধরনের শর্ত পূরণের বিষয় ইন্সপেকশনে দেখিয়েছেন। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা অভিযানের সময় ছিলেন, তারাও নিশ্চয় বিষয়টি পর্যালোচনা করবেন। আমরা জিজ্ঞাসাবাদে বিষয়টি জানার চেষ্টা করব। অবহেলাজনিত মৃত্যুর ঘটনায় মামলা দায়ের হয়েছে। যেহেতেু জোরপূর্বক নির্যাতন করে বের করে দেয়ায় যমজ এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এতে হত্যার অভিযোগ আনা হবে কিনা জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, বিজ্ঞ তদন্ত কর্মকর্তা বিষয়টি দেখবেন। যেহেতু এখানে ময়নাতদন্তের বিষয় আছে। ভুক্তভোগী মাও অভিযোগ করেছেন মামলায়, তাকেসহ যমজ শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। তদন্তে ও ময়নাতদন্তে তা উঠে আসলে অবশ্যই হত্যার বিষয়টিও অভিযোগপত্রে আসবে। উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিল দিতে না পারায় এনআইসিইউতে চিকিৎসাধীন দুই শিশুকে বের করে দেয়া হয়। সেখান থেকে অন্য হাসপাতালে নেয়ার পথে দুই শিশুর একজনের মৃত্যু হয়। মারা যাওয়া শিশুর নাম আহমেদ বয়স ৬ মাস। আরেক শিশু আব্দুল্লাহকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ওই দুই শিশুর মা আয়েশা বেগম বলেছিলেন, ১ জানুয়ারি বাচ্চা দুটি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের দুজনকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করি। সেখানে আইসিইউ না থাকায় পরদিন দালাল কম টাকায় ভাল চিকিৎসার কথা বলে শ্যামলীর আমার বাংলাদেশ হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওই হাসপাতালে ৭২ ঘণ্টায় ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা বিল আসে। আমি গরিব মানুষ- এত টাকা দিতে পারব না জানালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে মারধর করে। তাদের পায়ে ধরলে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। আমার কাছে থাকা ৪০ হাজার টাকা নিয়ে অসুস্থ বাচ্চাসহ আমাকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয় তারা। পরে ফার্মেসিতে বাকি থাকা ওষুধের টাকা নেয়ার জন্য শাহিন নামের একজনকে আমার সঙ্গে ঢাকা মেডিক্যালে পাঠায়। আসার পথে আমার ছেলে আহমেদ মারা যায়। আমার সঙ্গে কেউ নেই, আমি একা। আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংবাদিকদেরকে শিশুর মা আয়েশা বেগম অভিযোগ করে বলেন-ঠা-াজনিত কারণে ৩১ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করি দুই বাচ্চাকে। রবিবার সেখান থেকে বলা হয়েছে, তাদেরকে এনআইসিইউতে নিতে হবে। সেখানে এনআইসিইউতে সিট পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে যখন সিদ্ধান্ত নেই, সাভারে নিয়ে যাব। তখন হাসপাতালে এক এ্যাম্বুলেন্স চালক সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে আমাকে কৌশলে আমার বাংলাদেশ হসপিটালে নিয়ে যান। ওই হাসপাতালে শিশু দুটি চিকিৎসা নিচ্ছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছয় দিন ভর্তি দেখিয়ে আমাদের কাছে ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা দাবি করে। তিনি বলেন-এরই মধ্যে কয়েক বার ৫০ হাজার ৫শ’ টাকা দিয়েছি। আর পারিনি। হাত-পায়ে ধরেও লাভ হয়নি। বৃহস্পতিবার বেলা ৩টার দিকে আমাদের জোর করে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হয়। হাসপাতালের কর্মী শাহিনকে দিয়ে দুই শিশুসহ আমাদের ঢাকা মেডিক্যালে পাঠানো হয়। এখানে আনার আগেই এক শিশুর মৃত্যু হয়। আয়েশা বেগম জানান, শিশুদের বাবা দুই মাস আগে সৌদি গেছেন। সেখানে তিনি মরুভূমিতে কাজ করেন। সেখান থেকে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে নিয়ে টাকা পাঠিয়েছিলেন। সব টাকাই হাসপাতালে দিতে হয়েছে। তাদের বড় ছেলে পাঁচ বছর বয়সী আরব আলী কুমিল্লায় নানার কাছে থাকে।
×