ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাদাসিধে দাম্পত্যের গল্প

প্রকাশিত: ০০:১৭, ৭ জানুয়ারি ২০২২

সাদাসিধে দাম্পত্যের গল্প

একটা গল্প বলি শোনো। কয়েকদিন আগে পুরো ফ্যামিলি নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম এক বন্ধুর বাড়ি। উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবার। সুবিশাল দুই তলা বাড়ি। সামনে বিস্তৃত আঙিনা। বন্ধুর স্বামীটি পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বহুজাতিক একটি কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। খুব আন্তরিক স্বভাবের, মিশুক মানুষ। বন্ধুটি কোমল মনের গোছানো গৃহিণী। ছোট্ট শিশুসন্তান নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে সুখী এক ছিমছাম পরিবার। -তা, এই কনজোগাল লাইফ স্টোরি আমাকে শুনতে হবে কেন? -আগে শোনো তো, তারপর না-হয় এর এনালাইসিস কর। -ওকে। ফাইন। বলুন। -ওই বাড়িটিতে স্বামীর দিকের এক বৃদ্ধ পিসিমা ছাড়াও আছে আগস্ট’ নামে একটি আদুরে কুকুর। -কুকুরের নাম আগস্ট? আজব নাম তো? -তাদের ভাষ্য, আগস্টও তাদের পরিবারের সদস্য। ফি বছর ঘটা করে তার জন্মদিনও পালন করে তারা। -কুকুরেরও আবার জন্মদিন? তা এই ডিসেম্বর মাসে আগস্টে জন্মদিন কেন? -কুকুরটিকে তারা বাড়িতে কিনে আনে আগস্ট মাসে। কুকুরের জন্মের হদিস কে রাখে বলো? তাই আগস্টেই আগস্টের জন্মদিন ঠিক করা হলো। যাই হোক, তুমুল আড্ডায় ও খাওয়া-দাওয়ায় বেশ সুন্দর একটি সময় কাটলো আমাদের। -তারপর? -স্বামীটির একটি বিচিত্র শখ আছে। অফিস শেষে কিংবা ছুটির দিনে বাড়ির একটি ঘরে কাঠের কাজ করা। নানা রকম আসবাব তৈরি করা আর কি! -ছুতারের কাজ? বড়লোকের গরিবি রোগ যাকে বলে। -তা বলতে পার! নিজেকে কাঠমিস্ত্রি পরিচয় দিতে বেশ অহংবোধ করেন দেখলাম। বলাটায় এক ধরনের স্বচ্ছন্দ আছেÑ দেখে ভালই লাগল। এক রকম জোর করেই আমাকে নিয়ে গেলেন তার সেই কাজের ঘরটিকে দেখাতে। -আপনি গেলেন সেখানে? আপনার না ডাস্ট এ্যালার্জি আছে? -যেতে চাইনি। কিন্তু কী করব বল? বেড়াতে গিয়েছি। লজ্জায় কিছু বলতেও পারছিলাম না। শুরুতে নিমরাজি ছিলাম সত্যি। তবে ঘরটিতে গিয়ে আমি তো রীতিমতো থো। -কেন, কেন? -ঘরটি জিনিসে ঠাসা। নানা সাইজের কাঠ। বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি। দেশ-বিদেশ থেকে করাত-হাতুড়ি ইত্যাদি কেনা তার শখের অংশ। এই ধরনের ঘর সাধারণত নোংরা হয়। বসার অযোগ্য থাকে। তাই যেতে ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আমার ধারণার চুলোয় জল। দেখলাম, ঘরটি বেশ পরিপাটি করে গোছানো। শুনলাম, বন্ধুটি তার স্বামীর এ ঘরটিকে প্রায় দিনই গুছিয়ে রাখে। -বাহ! ভাল তো। -কথাগুলো বলছি অন্য একটি কারণে। তুমি তো জান, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’। তবে প্রবাদটি সম্পূর্ণতা পায় পরের লাইনটি যুক্ত হলে। -সেটা কী? -‘যদি গুণবান পতি থাকে তার সনে’। যদিও অনেকে সেটি উল্লেখ করে না। পুরোটা চাপিয়ে দেয় নারীদের ওপরই। -তা ঠিক। -কথা হলো, গুণবতী বা গুণবান হলেই কি সংসারে সুখ আসে? সুখ তো কোন বীজগণিতের অঙ্ক নয়, যে কষলেই ফল আসবে? এক্ষেত্রে আমার একটা পর্যবেক্ষণ আছে। সবার সঙ্গে সেটা নাও মিলতে পারে। -সেটা কেমন? -একটি কথা কী জানো, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাস, বোঝাপড়া, শেয়ারিং- এসব ভালবাসার উপাদনগুলো সুখের নিয়ামক সত্যি। তার সঙ্গে থাকতে হয় কোমল প্রশ্রয় নামের একটা বোধ। -কোমল প্রশ্রয়? বাহ! সুন্দর তো শব্দটি। আগে শুনিনি। -হুম। হুট করে শব্দটি মাথায় এলো। প্রসঙ্গে আসি। ভালবাসা তো আর নিউটনের সেই আপেল নয়, যে গাছের তলায় বসামাত্রই টুপ করে এসে কোলে পড়বে। ওটা ফলাতে হয়। ওই বন্ধুটিকে আপাত সুখের মনে হওয়ার পেছনে আমার চোখে যে বিষয়টি ধরা পড়েছে, তা হলো সেই কোমল প্রশ্রয়। স্বামীর পাগলামোকে গুরুত্ব দেয়া, সেটার প্রতি শ্রদ্ধা রাখা। এটা খুব জরুরী। -মেয়েরা এমন সেক্রিফাইস অলওয়েস করে। এ আর নতুন কী? এটাই আমাদের ট্রেন্ড। আপনারা পুরুষেরা সেটা বুঝতে চান না। -শুভ্রা, আমি তোমার সঙ্গে আর্গুমেন্ট করছি না। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা সংসারের জন্য অনেক বেশি ছাড় দেয়। তোমার সপক্ষেই বলছি, এখানে স্বামীটির জায়গায় আমার সেই বন্ধুটিও হতে পারত। সেক্ষেত্রেও একই কথা। কজন মানুষই-বা পারে তার সঙ্গীর এমন বিষয়কে নিজের করে নিতে? বিষয়টি একপাক্ষিক হলে যন্ত্রণাদায়ক ও ক্ষণস্থায়ী হয়Ñ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। -শুনে খুশি হলাম মিস্টার। -শোনো, কেবল ভালবাসা দিয়ে কোন একটি সম্পর্ককে চিরস্থায়ী করা যায় না। সম্পর্ক টিকে থাকে কিছু বাস্তব উপাত্তের ওপর। সেই উপাত্তগুলোকে বোঝাতে আমার নিজের তৈরি একটি শব্দ আছে। -তাই নাকি? ফিলোসফার হয়ে পড়ছেন দেখছি! - আরে না না, তেমন কিছু নয়। ওই শব্দটি দিয়ে বরং সম্পর্কের হিসাব-নিকাশ কষি। শব্দটি হলো ‘ফুস’। -ফুস? এ বাবা! এ আবার কী শব্দ? -এ শব্দটির সঙ্গে কম-বেশি পরিচয় আছে আমাদের সবার। তুচ্ছ বা অসার অর্থে এটি ইউজ হয়। কিন্তু তা যদি ইংরেজীতে লেখ, তবে কী দাঁড়াবে? এফ.ইউ.এস.এইচ ঋটঝঐ. -হ্যাঁ। তো? -আপাতদৃষ্টিতে এ শব্দটিও অর্থহীন মনে হচ্ছে, তাই না? কিন্তু এই ইংরেজী শব্দটিকে ভেঙে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাব- ঋ-এ ঋধরঃয (বিশ্বাস বা আস্থা) + ট-তে টহফবৎংঃধহফরহম (বোঝাপড়া বা মতের মিল) + ঝ-এ ঝযধৎরহম (ভাগাভাগি বা অংশগ্রহণ) + ঐ-তে ঐড়হড়ৎ (শ্রদ্ধাবোধ)। একটি খাট কিংবা টেবিলের যেমন চারটি পা থাকে। তেমনি একটি সম্পর্কের চারটি পা আমার কাছে এই শব্দ-চতুষ্কোণ। যদি কোন কারণে খাটের বা টেবিলের চার পায়া’র একটি ভেঙে যায় কিংবা ক্ষয়ে যায়, তবে মুহূর্তেই সেটি কাৎ হয়ে পড়ে। সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তাই। - চমৎকার বিশ্লেষণ। -আমার কাছে ভালবাসা হলো ¯্রফে খাটের ওপর বিছানো সুদৃশ্য বেড-কভার, কিংবা টেবিলের ওপর রাখা সুন্দর টেবিল-ক্লথ ছাড়া কিছু নয়। ওটা সম্পর্কের শরীরকে ঢেকে রাখে। ময়লা হলে ধুতে হয়, পুরনো হলে ফেলে দিয়ে নতুন কিছু পাততে হয়। -মানে? -মানে ভালবাসায় আনতে হয় বৈচিত্র্য, অভিমানকে ঝেরে ফেলে থাকতে হয় পাশে। বেড-কভার বা টেবিল ক্লথের মতো ভালবাসার কাজ হলো সৌন্দর্য বাড়ানো; স্থায়িত্ব টিকিয়ে রাখা নয়। আবেগীয় ভালবাসা দিয়ে সম্পর্ক বেশিদূর এগুনো যায় না। ভালবাসা এক সময় আটকে থাকে ভালবাসাতেই। এটি ছাড়া সম্পর্কটিতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। -কথাগুলো দিয়ে কি আমাকে কিছু মিন করলেন? স্পেশায়ালি আবেগীয় ভালবাসার প্রসঙ্গটি? -তোমার আমার সম্পর্কটি আসলে যে কী, সেটা এখনও আমার মাথায় আসে না। আমার বয়স বায়ান্ন। আর তোমার একুশ। বয়সের ব্যবধান তিরিশের বেশি। আমাকে কোন সম্বোধনে ডাকো না। আবার নাম ধরেও না। তবে আমাদের এই ফেসবুক ইনবক্সের জীবন তো আর কম দিন হলো না। তিন বছর হতে চলল। -তা হয়েছে। আপনার লেখার ফ্যান তো দেশ-বিদেশে অসংখ্য। বইমেলায় আপনার ওপর মেয়েদের হুমড়ি খেয়ে পড়াটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের দেখতে পাই। বড় ন্যাকামি লাগে। -প্রথম প্রথম তো তুমিও পড়েছিলে। -তা তো এখনও পড়ে আছি। আচ্ছা, সম্পর্কের কথা যেন কী বলছিলেন? -সম্পর্কের মধ্যে স্পেস একটা বড় ফ্যাক্টর। নয়তো এক সময় হাঁসফাঁস হয়ে ওঠে সব কিছু। সম্পর্কের শরীর ঘুণে ক্ষয়ে যায়। ভালবাসার চাদরে তা ঢেকে রাখা হয় মাত্র, যা কেবলই লোক-দেখানো। সে আর কত দিন? বাতাস এলে চাদর উড়িয়ে দেয়। বসতে গেলে, নয়তো ওটার ওপর কিছু একটা রাখতে গেলেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে সবটুকু নিয়ে। -আমাদের রিলেশনশিপটিও কি তাই? -সব কথায় নিজের দিকে ইন্ডিকেট করতে নেই। বলতে পার, স্বগতোক্তি। একটা কথা প্রচলিত আছে, কবি’র বউকে কবিমনা না হলে বড় কষ্টের কারণ হয়। যেমনটা ঘটেছিল জীবনানন্দের জীবনে। -জীবনানন্দের দাম্পত্য জীবন অসুখী ছিল শুনেছি। তবে সবাই লাবণ্য দেবীকেই দোষারোপ করেন। এমন একজন স্মার্ট মেয়ের জীবনে জীবনানন্দের মতো ভ্যাবলাকান্ত সঙ্গী হলে, তা অসুখী না হয়ে পারে? -একটি ঘটনার কথা বলি। মৃত্যুর পর জীবনানন্দকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন সেসময়ের প্রতিষ্ঠিত কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। সুধীন দত্তকে দেখে শোক-আবহে লাবণ্য দেবী রীতিমতো বিস্মিত। পাশে বসা তখন ভূমেন্দ্র গুহ, আজ যিনি জীবনানন্দ গবেষক হিসেবে বিখ্যাত। তাকে জিগ্যেস করেছিলেন- ‘আচ্ছা, তোমার দাদা কি অনেক বড়ো লেখক ছিলেন? সুধীন দত্তের মতো মানুষ এলেন!’ -তাই নাকি? শুভ্রার কণ্ঠে বিস্ময়। - সেটাই তো বলছি। কী জানো, লাবণ্য দেবীর জন্য বড়ো করুণা হয়। একবারের জন্যও কি তার কৌতূহল হলো না তার সঙ্গীটি কী করেন, কী লিখেন? ট্রাংকের ভেতর ঠাসাঠাসি করে কী এমন গোপন জিনিস রাখেন? জীবনানন্দ না-হয় অন্তর্মুখী স্বামী ছিলেন সত্যি। কিন্তু লাবণ্য তো বহির্মুখী স্ত্রী ছিলেন। তিনি ‘দেখিতে গিয়াছেন পর্বতমালা, দেখিতে গিয়াছেন সিন্ধু’। অথচ ‘দেখা হয় নাই তাঁর চক্ষু মেলিয়া একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু।’ -তা এক্সট্রোর্ভ লাবণ্য দেবী তো পাহাড়-পর্বতই দেখতে যাবেন। তাই নয় কি? শুভ্রা কথার সপক্ষে বলে। -একটা কথা জেনে রেখো, সঙ্গীকে দেখতে হয় তার ‘ভাল-মন্দ মিলায়ে সকলই’। ভালবাসতে হয় তার নিপাট সুস্থতা ও পাগলামোকেও। নইলে যে ব্যর্থতা গ্রাস করে সংসারে, তার আগুনে বালিশ-তোশকসহ পুড়তে হয় দুজনকে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। -আপনার ঘরের বালিশ-তোশক বুঝি পুড়ছে? শুভ্রা জানতে চায়। এতক্ষণের চ্যাটিং-এ এই প্রথম ধ্রুবজ্যোতি মজুমদার শুভ্রার প্রশ্নের কোন উত্তর করলেন না। একটা রহস্যময় স্মাইল ইমো দিলেন শুধু।
×