ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মনরিুল ইসলাম রফকি

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সৎপথে জীবন পরিচালনা কতটুকু সম্ভব

প্রকাশিত: ২১:৩৮, ৭ জানুয়ারি ২০২২

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সৎপথে জীবন পরিচালনা কতটুকু সম্ভব

ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের চরিত্র দুই ভাগে বিভক্ত। আখলাকে হামিদা, আখলাকে যামিমাহ- সৎ চরিত্র ও অসৎ চরিত্র। সচ্চরিত্র যেমন সততা, ন্যায়পরায়নতা, ক্ষমা, পরোপকার, শালীনতা ইত্যাদি। অসৎ চরিত্র বলতে মিথ্যা বলা, গালি দেয়া, ঝগড়া করা, চুরি করা ইত্যাদি বোঝায়। সততা, আখলাকে হামিদাহ বা মানুষের সৎ চরিত্রসমূহের মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ গুণ ও বৈশিষ্ট্য। কাজে-কর্মে, কথাবার্তায়, লেন-দেনে এক কথায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে ন্যায়নীতি অবলম্বন করাকে সততা বলে। সত্য কথা বলা, সৎ পথে চলা, সুবিচার করা, অঙ্গীকার পালন করা, আমনত রক্ষা করা, প্রতারণা না করা সততার অন্তর্ভুক্ত। সততা একটি মহৎ গুণ। এটা ব্যক্তিকে করে মহিয়ান আর সমাজকে করে স্থিতিশীল ও ইনসাফপূর্ণ। মানব জীবনের সুখ-শান্তি, নিরাপত্তা ও সামাজিক শৃঙ্খলা সততার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সততার গুণেই নবীগণ (আ) মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। নবুয়াতপ্রাপ্তির পূর্বে মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা) এগুণেই সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। হযরত খাদিজার (রা) ব্যবসা বাণিজ্যের গুরুদায়িত্ব পাওয়া এবং পরবর্তীতে উভয়ের মাঝে পবিত্র বিবাহের বন্ধন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মূলে ছিল নবীজীর সততা। সততা মানুষকে আল্লাহ ভীরু করে। সৎ লোক ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে সচেতন থাকে। সৎ ব্যবসায়ী দ্রব্যে ভেজাল দেয় না এবং পণ্যের দোষত্রুটি গোপন রাখে না। সৎ কর্মচারী কাজে ফাঁকি দেয় না। সৎ লোক প্রতারণা করে না, প্রবঞ্চনা করতে পারে না। আমাদের মহানবী হুজুর (সা) ইরশাদ করেছেন- মান গাসসা ফালাইছা মিন্না ...। -‘যে ব্যক্তি প্রতারণা করে সে আমার দলভুক্ত নয়।’ ব্যবসা বাণিজ্যে, লেনদেনে সততার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা) ইরশাদ করেছেন- একজন বিশ্বস্ত সত্যবাদী মুসলিম ব্যবসায়ী শেষ বিচারের দিবসে মহান শহীদগণের সঙ্গী হবেন। অর্থাৎ শহীদগণের সঙ্গে তার হাশর-নাশর হবে। হাদিসের ভাষ্যানুযায়ী বোঝা যায় যে, ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা ও বিশ্বস্ততা রক্ষা করে চলা কঠিন এবং তাই এটা একটি বড় পুণ্যের ও কল্যাণের কাজ। যে ব্যবসায়ী বিশ্বস্ততার সঙ্গে বৈধ, অবৈধ বিবেচনা করে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করেন, শেষ বিচারের দিন তিনি তার প্রতিদানস্বরূপ মহান শহীদানের ন্যায় উচ্চ মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী হবেন। মানুষ সাধারণত অর্থলিপ্সু ও সীমাহীন লোভাতুর হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং অধিক মুনাফার আশায় ক্রেতাকে প্রতারিত করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে অত্যধিক লাভের কামনায় পণ্যে ভেজাল ও মাপে কমবেশি করে থাকে। এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। তাই ইসলামে এরূপ কাজকে মারাত্মক অপরাধমূলক কাজ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সততা মানুষকে বিপদমুক্ত করে। সৌভাগ্য ও সফলতা দান করে। প্রখ্যাত সাহাবী হযরত ইবনে মাসউদ (রা) হযরতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন- সত্য কথা বলা তোমাদের ওপর অবশ্যই কর্তব্য, কারণ সত্যবাদিতা অবশ্যই নেক ও পুণ্যের দিকে পরিচালিত করে। আর পুণ্য বা নেক অবশ্যই জান্নাতের দিকে চালিত করে। যে ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বলতে থাকে ও সত্যের অন্বেষণ করতে থাকে, সে অবশেষে আল্লাহর নিকট পরম সত্যবাদী (সিদ্দিক) বলে লিখিত হয়। আর অবশ্যই মিথ্যা আচরণ হতে দূরে থাকবে। কারণ, মিথ্যা অবশ্যই অপকর্ম ও পাপাচারের দিকে পরিচালিত করে। আর অপকর্ম ও পাপাচার মানুষকে জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করে। যে ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা বলতে থাকে ও মিথ্যার অন্বেষণ ও অনুসন্ধানে লিপ্ত থাকে, সে অবশেষে আল্লাহর নিকট কায্যাব বা চরম মিথ্যাবাদী বলে লিখিত হয়। (সহী বুখারী ও মুসলিম শরিফ)। সমাজে বিচার-আচার করার ক্ষেত্রেও সততার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তায়ালা পাক কালাম শরিফে ইরশাদ করেছেন- ‘তোমরা ন্যায়ভিত্তিক বিচার সম্পন্ন কর। তা খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী। আর ন্যায়বিচার কর (স্বজনপ্রীতি করো না) যদিও বা কেউ তোমাদের নিকটাত্মীয় হয়।’ সুতরাং আমরা বুঝতে পারলাম সততার বিষয়টি সর্বত্র প্রয়োজন। আর এর অভাবে সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা, সুন্দর, সুশীল পরিবেশ অনেকাংশে ব্যাহত হয়। সততার গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিও সকলের বিশ্বাস অর্জন করে, শ্রদ্ধা লাভ করে, এমনকি পরম শত্রুও তাকে বিশ্বাস করে। বিশ্বের দেশে দেশে সৎ লোকের নেতৃত্ব ও শাসনের কথাটি বর্তমানে বেশ জোরে শোরে উচ্চারিত হচ্ছে। আমাদের দেশেও চলছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান। সৎভাবে চলার জন্য সততা লালনের জন্য পরিবেশ পাওয়া একটি বড় বিষয়। অভাবে যেমন স্বভাব নষ্ট হয় তেমনি পরিবেশের অভাবে সততা অনুশীলন সম্ভব হয় না। কিছু কিছু ব্যাপার ক্ষমতায় বসে সংস্কার করলে তা ফলপ্রসূ হয় বেশি। যেমন আমাদের দেশে এক সময় বিভিন্ন পরীক্ষায় ছিল নকলের ছড়াছড়ি। চিন্তাশীল মহলে এ ব্যাপারে পেরেশানী থাকলেও তারা তা দূর করতে পারেননি। কিন্তু সরকারী পর্যায়ে যখন এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হলো তখন সফলতা এলো। সকলে এতে সহযোগিতাও করছে। সততার সঙ্গে অসততার একটি চিরন্তন দ্বন্দ্ব রয়েছে। অসৎ লোকের সংখ্যা সমাজে বেশি। আলাহর মহান নবী-রাসূলগণ সত্যকে বিজয়ী করতে পেরেছিলেন ঠিক, অসৎদের সঙ্গে তাদের আজীবন দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকতে হয়েছে। আজও সৎ মানুষগুলো বিভিন্ন স্থানে অন্যায় অসুন্দরের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধরত। এ যুগে প্রায় সব সেক্টরে অসৎদের নেতৃতে সৎ মানুষগুলো কোণঠাসা। এমনকি ধর্মীয় উপাসনাগুলোতেও। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অসৎ দায়িত্বশীলদের হাতে ফান্ডের টাকা আত্মসাতের খবর পাওয়া যায়। সততার প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রীয় অভয় আনুকূল্য প্রয়োজন। মানুষ যুগ যুগ ধরে যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে মূল্যবোধ ও সততার শিক্ষায় উজ্জীবিত হয়েছে সেসব মসজিদকে অসৎ নেতৃত্ব থেকে পবিত্র করার একটি বিহিত ব্যবস্থা বর্তমান সরকারের নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে সমাজের অনেক চিন্তাবিদগণ মনে করেন। লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব [email protected]
×