ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পাঁচজনের যাবজ্জীবন বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেশের মানুষকে ব্যথিত করেছে। এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেজন্যই আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হয়েছে রায়ে আবরারের বাবা-মায়ের সন্তোষ, দ্রুত রায় কার্যকর দাবি

২০ আসামির মৃত্যুদণ্ড ॥ চাঞ্চল্যকর আবরার হত্যা মামলা

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ৯ ডিসেম্বর ২০২১

২০ আসামির মৃত্যুদণ্ড ॥ চাঞ্চল্যকর আবরার হত্যা মামলা

স্টাফ ও কোর্ট রিপোর্টার ॥ বুয়েটছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে ২০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক। এছাড়া ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায় দিয়েছেন তিনি। মামলাটিতে মোট ২৫ জন আসামি ছিল। বিচারক আবু জাফর মোঃ কামরুজ্জামান মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার আগে পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, শিবির সন্দেহে মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে আবরারকে হত্যা করা হয়েছে। নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেশের মানুষকে ব্যথিত করেছে। আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে আর কখনও না ঘটে তা রোধকল্পে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মামলার রায়ে বাদী নিহত আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। মামলার রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিল ২২ আসামি। আর বাকি তিনজন পলাতক। বুধবার সকাল ৯টা ২০ মিনিটে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাদের আদালতে হাজির করা হয়। দুপুর ১২টায় বিচারক এজলাসে প্রবেশ করেন। এরপরই রায় পড়া শুরু করেন। এর আগে বেলা ১১টা ৪২ মিনিটে এ হত্যা মামলার ২২ আসামিকে আদালতের এজলাসে হাজির করা হয়। রায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিরা হলো, বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল (সিই বিভাগ, ১৩তম ব্যাচ), সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ), তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির (ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), উপ-সমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশারফ সকাল (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য মুনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ), সদস্য মুজাহিদুর রহমান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), সদস্য এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাজেদুল ইসলাম (এমএমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর (মেকানিক্যাল, ১৭তম ব্যাচ), মাহমুদুল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), এ এস এম নাজমুস সাদাত (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ)। এরা সবাই হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে রয়েছেন, মিজানুর রহমান (ওয়াটার রিসোসের্স, ১৬তম ব্যাচ), শামসুল আরেফিন রাফাত (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং), উপ-দফতর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল) এবং মাহামুদ সেতু (কেমিকৌশল)। এদের নাম এজাহারে ছিল না। বুয়েট ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে, সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪তম ব্যাচ, সিই বিভাগ), মোয়াজ আবু হোরায়রা (সিএসই ১৭তম ব্যাচ), আকাশ হোসেন (সিই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), আইন বিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং), গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (মেকানিক্যাল, তৃতীয় বর্ষ)। এদের মধ্যে অমিত ও মুন্নার নাম হত্যা মামলার এজাহারে উল্লেখ ছিল না। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন বিচারক। অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদ- হবে তাদের। আবরার হত্যাকা-ের এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যে পলাতক রয়েছেন তিনজন। তারা হলেন, এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাহমুদুল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ) এবং মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল)। রায় শুনতে আদালতে আবরারের বাবা ॥ নিজ পুত্র হত্যার রায় শুনতে আদালতে উপস্থিত হয়েছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ। রায় শুনতে কুষ্টিয়া থেকে আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ গত সোমবার ঢাকায় আসেন। রায়ে তিনি মামলার সব আসামির মৃত্যুদ- প্রত্যাশা করেছিলেন। একইসঙ্গে এবার কোনভাবেই রায় ঘোষণার তারিখ না পেছানোর দাবিও ছিল তার। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সব আসামির ফাঁসি না হলেও রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানান তিনি। রায় কার্যকর হলে আবরারের আত্মা শান্তি পাবে। আবরারের বাবা প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, বিচারক ও আইনজীবী এবং পুলিশ বাহিনীকে ধন্যবাদ জানান। গণমাধ্যম সব সময় তার পাশে থাকায় তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান। রায় ঘোষণা শেষে আবরারের বাবা বরকত উল্লাহর চোখ মুখে ছেলে হত্যার কষ্ট প্রকাশ পায়। তিনি বলেন, যে হারায় সে বুঝে, ছেলেকে হারানোর পর যে কষ্টে বেঁচে রয়েছি, তা ভাষায় বোঝানো যাবে না। রায়ে দেশ কলঙ্কমুক্ত ॥ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে করা মামলায় ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণায় দেশ কলঙ্কমুক্ত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী বলেন, প্রতিনিয়ত আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হলে এমন নির্যাতন চলে। আবরার হত্যা মামলার এ রায় তাদের জন্য একটি মেসেজ। আববারের মা ও ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া ॥ হত্যা মামলায় দেয়া আদালতের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আবরারের মা রোকেয়া খাতুনসহ পরিবারের সদস্যরা। সেই সঙ্গে রায় দ্রুত কার্যকর চান তিনি। দুপুরে আদালতের রায়ের সংবাদ জানতে পারেন আবরারের পরিবার। এ সময় কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই রোডের বাসায় আবারের মা রোকেয়া খাতুন ও ছোট ভাই আবরার ফায়াজ ছাড়াও প্রতিবেশীরা উপস্থিত ছিলেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তারা বলেন, সব আসামির ফাঁসির রায় দেয়া হলে আমরা আরও খুশি হতাম। তবে আদালতের রায় পর্যালোচনা করে দেখব, পূর্ণাঙ্গ রায় থেকে অন্যদের ফাঁসির জন্য আবেদন জানাব উচ্চ আদালতে। তবে আদালত যে রায় দিয়েছে আমরা সন্তোষ প্রকাশ করছি সেই সঙ্গে এ রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানাচ্ছি। আদালত পাড়ায় উৎসুক জনতার ভিড় ॥ বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যা মামলার রায় ঘোষণা ঘিরে আদালত পাড়ায় উৎসুক মানুষের উপচেপড়া ভিড় ছিল। সকালে আবরারের বাবা ও আসামিদের স্বজনেরা আদালত প্রাঙ্গণে এসে হাজির হন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোচিত এ রায়কে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ, আইনজীবী, পুলিশ, সাংবাদিকদের উপস্থিতিও বাড়তে থাকে। সব ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এড়াতে আদালত প্রাঙ্গণসহ আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। রায় ঘোষণা পর্যন্ত উৎসুক জনতা রায় শোনার জন্য অধীর আগ্রহে আদালতের বাইরে অপেক্ষা করেন। আবরার হত্যা মামলার রায় ঘিরে আদালত পাড়ায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ানো হয়। আদালত পাড়ার প্রধান ফটক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিভিন্ন চুক্তি নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন আবরার ফাহাদ রাব্বী। এর জের ধরে পরদিন ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র ও তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরারকে তার কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে যায় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েক উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মী। তারা আবরারের ১০১১ নম্বর রুমে গিয়ে রাতে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তার ল্যাপটপ, দুটি মোবাইল ফোনসহ ২০১১ নম্বর রুমে নিয়ে আসে। এরপর ওই কক্ষে আবরারকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার পরদিন ৭ অক্টোবর চকবাজার থানায় আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে ১৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন আদালত। মোট আসামির মধ্যে ২২ জনকে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার করা হয়। বর্তমানে তারা কারাগারে। পলাতক রয়েছে তিনজন। তারা সবাই বুয়েট ছাত্রলীগ কর্মী। বিচার চলাকালে ৬০ সাক্ষীর মধ্যে ৪৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত। ২১টি আলামত ও ৮টি জব্দ তালিকা আদালতে জমা দেয়া হয়। আবরার হত্যাকা-ে স্বীকারোক্তি দিয়েছে ৮ জন। তারা হলো, মেহেদী হাসান রবিন, অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ সকাল, মনিরুজ্জামান মনির, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মুজাহিদুর রহমান মুজাহিদ, এ এস এম নাজমুস সাদাত এবং খন্দকার তাবাখ্খারুল ইসলাম তানভীর।
×