ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দশে দশ-এজাজ প্যাটেলের ইতিহাস

প্রকাশিত: ০০:১৪, ৮ ডিসেম্বর ২০২১

দশে দশ-এজাজ প্যাটেলের ইতিহাস

মুম্বাই টেস্টের প্রথম দিনেই ভারতের ৪ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন এজাজ প্যাটেল। সেটা ছিল ১৯৯৩ সালের পর কোন ব্ল্যাক ক্যাপস স্পিনারের প্রতিপক্ষের প্রথম চার ব্যাটসম্যানকে আউট করার ঘটনা। দ্বিতীয় দিন সকালে ঋদ্ধিমান সাহাকে ফিরিয়ে নিউজিল্যান্ডের প্রথম স্পিনার হিসেবে সংখ্যাটাকে ৫-এ নিয়ে যান। পরের বলেই রবিচন্দ্রন আশ্বিন, শিকার সংখ্যা ৬, তখনই সম্ভাবনা উঁকি দেয়। ১০ উইকেট পাওয়া কি সম্ভব হবে? দুর্দান্ত ব্যাটিং করা মায়াঙ্ক আগারওয়াল অক্ষর প্যাটেলকে নিয়ে ২৮ ওভার কাটিয়ে দিলে ‘পারফেক্ট টেনে’র আলোচনা কিছুটা থেমে যায়। ইনিংসের ১০০তম ওভারে ডানহাতি এ ওপেনারকে উইকেটরক্ষকের গ্লাভসে বন্দী করে সপ্তম উইকেট তুলে নিলেন এজাজ। একটু পরই সরিয়ে দিলেন আরেক পথের কাঁটা অক্ষরকে। আম্পায়ার আউট দিতে চাননি। সফল রিভিউয়ে ধরেন আট নম্বর শিকার। পরের ওভারে দ্বিতীয় বলে জয়ন্ত যাদবকে ক্যাচ বানিয়ে নবম। মুত্তিয়া মুরলিধরনের মতো বোলারকেও যেখানে থামতে হয়েছিল, সে বাঁধায় আটকা পড়েননি। আগের বলেই চার হাঁকানো মোহাম্মদ সিরাজের স্লগ এবার আর মিডঅন পার হলো না। ইউরেকা! শেষ পর্যন্ত বড় জয়ে ম্যাচ এবং সিরিজ পকেটে পুড়েছে ভারত, কিন্তু ইতিহাস তো মুম্বাই টেস্টের গল্পে শুধু এজাজ প্যাটেলকেই মনে রাখবে!! টেস্ট ক্রিকেটের ১৪৪ বছরে মাত্র তৃতীয় বোলার হিসেবে ইনিংসে ১০ উইকেট নিয়ে অবিস্মরণীয় এ কীর্তি গড়লেন ৩৩ বছর বয়সী বাঁহাতি নিউজিল্যান্ড স্পিনার। নাম লেখালেন জিম লেকার এবং অনিল কুম্বলের পাশে। ১৯৫৬ সালে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ইল্যান্ডের হয়ে অস্ট্রেলিয়ার ১০ উইকেট নিয়েছিলেন লেকার, ১৯৯৯ সালে দিল্লীতে পাকিস্তানের ১০ উইকেট নেন কুম্বলে। মুম্বাইয়ে জন্ম নেয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত এজাজ মুম্বাইয়েই সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে ভারতের সব ব্যাটসম্যানকে সাজ ঘরে পাঠিয়ে গড়লেন ইতিহাস। পেলেন ভারতীয় গ্রেট কুম্বলের উষ্ণ শুভেচ্ছা। এজাজ শুরু করেছিলেন ওপেনার শুভমান গিলকে রস টেইলরের হাতে ক্যাঁচ বানিয়ে, শেষ করেন শেষ ব্যাটসম্যান সিরাজকে রাঁচিন রবীন্দ্রর হাতে ক্যাঁচ বানিয়ে। মাঝে বিরাট কোহলি, চেতেশ^র পুজারা কেউই তাঁর ঘূর্ণির ফাঁদ থেকে বাঁচতে পারেননি। ৪৭.৫ ওভার বল করে ১১৯ রান দিয়ে ১০ উইকেট শিকার করেন বাঁহাতি এ স্পিনার। ইতিহাসে ১০ উইকেট নেয়া তিনজনই স্পিনার। এজাজ কীর্তিটি গড়েছেন তার জন্মস্থান মুম্বাইয়ে! এই ম্যাচের আগে মাত্র ১০টি টেস্ট খেলে ইনিংসে ৫ উইকেট ছিল দুই বার, কোনবারই ৫টির বেশি পাননি। দুই ইনিংস মিলিয়েও ৭ উইকেটের বেশি তার ছিল না। এমনকি ৬৮ ম্যাচের প্রথম শ্রেণীর ক্যারিয়ারেও কখনও ইনিংসে ৬ উইকেটের বেশি পাননি। সেই এজাজের নাম এবার চিরস্থায়ী হয়ে গেল ক্রিকেট ইতিহাসে। লেগস্পিন লিজেন্ড অনিল কুম্বলে পাকিস্তানের ১০ উইকেট নিয়েছিলেন ১৯৯৯ সালে। দিল্লী টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে তার বোলিং ফিগার ছিল ২৬.৩-৯-৭৪-১০। ইনিংসে ১০ শিকারের চোখ ধাঁধানো কীর্তি টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম দেখিয়েছিলেন জিম লেকার। ১৯৫৬ এ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওল্ড ট্র্যাফোর্ড টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৩ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ১০ উইকেট, ওই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে তার শিকার ছিল ৯ উইকেট! সব মিলিয়ে ৯০ রানে ১৯ উইকেট, এক ম্যাচে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড। কাছাকাছিও যেতে পারেননি আর কেউ। টেস্টে বাঁহাতি হিসেবে এজাজই এখন সেরা। আগের রেকর্ডটি ছিল রঙ্গনা হেরাথের, ২০১৪ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১২৭ রানে ৯ উইকেট নিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কান বাঁহাতি স্পিনার। নিউজিল্যান্ডের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে সেরা বোলিংয়ের আগের রেকর্ড ছিল স্যার রিচার্ড হ্যাডলির। ১৯৮৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ব্রিসবেনে ৫২ রানে ৯ উইকেট নিয়েছিলেন কিউই কিংবদন্তি পেসার। দেশটির হয়ে ইনিংসে ৭ উইকেটের বেশি নেই আর কারও। সর্বোপরি ভারতের বিপক্ষে সেরা বোলিংয়ের ৫০ বছর পুরনো রেকর্ডও ভেঙে দিয়েছেন এজাজ। ১৯৭১ সালে ত্রিনিদাদে ক্যারিবিয়ান অফস্পিনার জ্যাক নোরিগার ৯৫ রানে ৯ উইকেট ছিল আগের সেরা। অনিল কুম্বলের টুইট, ‘পারফেক্ট টেন ক্লাবে এজাজ প্যাটেল তোমাকে স্বাগত। দারুণ বল করেছ। টেস্ট ম্যাচের প্রথম ও দ্বিতীয় দিনে এই অর্জন বিশেষ কিছু।’ শচীন টেন্ডুলকার মুম্বাইয়ের ছেলে। কে জানে মুম্বাইয়ের এজাজের জন্য তাঁর মনের ভেতরে ভিন্ন কিছু খেলা করে যাচ্ছে কি না। তা যেহেতু বোঝার উপায় নেই, চলুন জানি বরং এজাজের কীর্তিতে শচীনের প্রতিক্রিয়া, ‘অভিনন্দন এজাজ প্যাটেল টেস্ট ক্রিকেটে এক ইনিংসের ১০টা উইকেটই তুলে নেওয়ার জন্য। দেশের বাইরে নিজের দেশে গড়া এই বিরল কীর্তি অবশ্যই সত্যিকারের অর্থে স্পেশাল।’ হরভজন সিং, ‘আজাজ প্যাটেল, এটা চিরদিনের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ৪৭.৫-১২-১১৯-১০ এক কথায় দুর্দান্ত আমাকে এখন দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে দাও।’ অনেক হাততালির ইমোও যোগ হয়েছে এরপর। এজাজ যা করেছেন তাতে মুগ্ধতার শেষ নেই শাস্ত্রীর, ‘ক্রিকেটে সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটা এটা। গোটা দলের একটা ইনিংসকে ব্যাগে ভরে ফেলা সত্যি খুব বড় কথা। সত্যি অবিশ্বাস্য। ওয়েলডান ইয়াং ম্যান-এজাজ প্যাটেল।’ বিদেশের মাঠে? বরং বলা উচিত, তার ঘরের মাঠই দুহাত ভরিয়ে দিল তাকে। ১৯৮৮ সালে মুম্বাইয়ে জন্মেছিলেন। ৮ বছর বয়সে মুম্বাই থেকেই পরিবারের সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ড। কিন্তু ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয়ে গিয়েছিল মুম্বাইয়ের মাঠেই। মুম্বাই থেকেই ক্রিকেট নেশাটা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন কিউইদের দেশে। ঘটনা হলো, ১৯৯৬ সালে এজাজ নিউজিল্যান্ডে চলে যাওয়ার তিন বছর পর ১৯৯৯ সালে কুম্বলে ফিরোজ শাহ কোটলায় পান ১০ উইকেট। সেই কারণেই বোধহয় মুম্বাইয়ে খেলতে নেমে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলেন এজাজ। এমনকি তার স্ত্রীও এই শহরেরই। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের প্র্যাকটিসে নেট বোলার হিসেবে দেখা গিয়েছে তাকে। কে জানত, ওয়াংখেড়ে চিরকালীন এক ছাপ রেখে যাবেন! এজাজ বলেন, ‘আমার কাছে দারুণ একটা মুহূর্ত। আমার পরিবারের কাছেও। কোভিডের জন্য ওরা মাঠে হাজির থাকতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু ওরা যে দারুণ খুশি হয়েছে, এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। আমার ক্যারিয়ারে এটা একটা বিরাট ঘটনা হয়ে থাকবে। মুম্বাইয়ের মাঠে ১০ উইকেট নেয়ার জন্য কপাল সঙ্গ দিয়েছিল। কুম্বলে স্যারের বিরাট ভক্ত আমি। তার মতো ঘটনা ঘটাতে পেরে ভাল লাগছে।’ এজাজ প্যাটেল বাঁহাতি
×