ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

টিকে থাকতে বাঙালীর উদ্ভাবন

শ্রম বিক্রির বিচিত্র হাট মালদ্বীপে

প্রকাশিত: ২৩:৩৮, ৮ ডিসেম্বর ২০২১

শ্রম বিক্রির বিচিত্র হাট মালদ্বীপে

মোরসালিন মিজান, মালদ্বীপ থেকে ফিরে ॥ বিচিত্র এক হাট বটে। মালদ্বীপে শ্রম বিক্রির এ হাট গড়ে তুলেছেন প্রবাসী বাঙালীরা। নিজেদের হাটে নিজেরাই বিক্রি হন। বিক্রি হওয়ার জন্য দিনভর অপেক্ষা করে থাকেন। একইভাবে হাট থেকে প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী শ্রমিক সংগ্রহ করতে পারেন স্থানীয়রা। সপ্তাহে একদিন বা দুদিন নয়, প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চালু থাকে হাট। মাসিক বেতনের কোন ব্যাপার নেই এখানে। দৈনিক কাজ, কাজ শেষ হওয়া মাত্রই মজুরি- এ সূত্র মেনেই চলে হাটের কার্যক্রম। শ্রমের মূল্য নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে দরকষাকষিরও সুযোগ আছে। তবে মজুরি বঞ্চিত করা যাবে না। মূলত বঞ্চিত হওয়া থেকে বাঁচতেই স্বেচ্ছায় হাটে উঠছেন শ্রমিকরা। তাই বলে ভাববেন না, শ্রম বিক্রির হাট বা শ্রমিকের হাট হিসেবে সত্যি সত্যি এগুলোর কোন স্বীকৃতি আছে। আসলে মূল রাস্তার ধারে খুচড়ো কাজ প্রত্যাশী এই শ্রমিকদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমাবেশ দেখে শ্রম বিক্রির হাট বলে মনে হয়। সম্প্রতি দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন একাধিক হাটের কথা জানা যায়। হুলহুমালের ছোট পার্ক, দামাস এবং ফেস টু নামে পরিচিত দুটি স্থানসহ আরও কিছু এলাকায় নিয়মিতভাবে হাট বসে। সব হাটের চরিত্র এক ও অভিন্ন। বিস্তারিত আলাপে যাওয়ার আগে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলি, মালদ্বীপের জনসংখ্যা মাত্র ৫ লাখ। পাঁচ লাখ বলেই অনুমান করা হয়। অনেকে নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন শুনে। ততোধিক অবাক করা তথ্য হলো, সেখানে বাংলাদেশী বাস করছেন ১ লাখের মতো। মালদ্বীপে পায়ে হাঁটার পথ ধরে এগিয়ে গেলে কিছুক্ষণ পরপরই কোন না কোন বাঙালীর দেখা মিলে। দোকানগুলোতে কেনাকাটা করার সময় হঠাৎই বাংলা বলে কাছে এসে কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে যান। মালদ্বীপে পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ নীল জলরাশি ঘেরা রিসোর্ট। অত্যন্ত বিলাসবহুল এসব রিসোর্টেও বাঙালীদের অনেকে কাজ করেন। পুরোপুরি বৈধ শ্রমিকরা ভাল প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী চাকরি করার সুযোগ পান। তবে শ্রমিকের হাটে একেবারেই ভিন্ন চিত্র। এ হাট গড়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে নির্মম নিষ্ঠুর বঞ্চনার ইতিহাস। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা দালাল ধরে মালদ্বীপে পাড়ি জমিয়েছেন। সহায় সম্বল বিক্রি করে টাকা দিয়েছেন দালালকে। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী কাজের ব্যবস্থা হয়নি। বরং বৈধতার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় নিত্য ভুগান্তিতে পড়তে হয়েছে। সর্বোপরি মাসের পর মাস কাজ করেও বেতন পাননি তারা। চির বঞ্চিতরা বিদেশের মাটিতেও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। কিন্তু ফিরে আসার পথও খোলা নেই। এমন বাস্তবতায় তারা ‘দিন আনি দিন খাই’ নীতি বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এর পরও মজুরি বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে তুলনামূলকভাবে কম। তাই নিজেদের হাটে ওঠাতে দ্বিধা করছেন না। হুলহুমালের ছোট্ট পার্ক সংলগ্ন রাস্তার ধারে আছে এমন একটি হাট। পার্কের ভেতর দিয়ে যাওয়া আসা করতে গিয়েই এটি চোখে পড়ে। প্রথম দেখায় মনে হয়েছিল প্রবাসী বাঙালীরা গল্প আড্ডা জমিয়েছেন। কিন্তু বারবার একই দৃশ্য দেখে ও তাদের সঙ্গে কথা বলে মূল ঘটনাটি জানা সম্ভব হয়। কুমিল্লার তরুণ রনি বলছিলেন, তিনিসহ কাগজপত্র ঠিক নেই এমন বহু বাঙালী মালদ্বীপে আছেন। পাসপোর্টের ফটোকপি দেখিয়ে কাজ করেন তারা। পুলিশও তেমন বাধা দেয় না। তবে পুরোপুরি বৈধ না হওয়ায় তাদের প্রতি পদে ঠকতে হয়। অনেকে মাসের পর মাস কাজ করান। মাসিক বেতন দেয়ার কথা বলে কাজ করিয়ে আর টাকা দিতে চান না। ওদের সঙ্গে তো আমরা পারিও না। একটু প্রতিবাদ করতে গেলে পুলিশ ডেকে বসে। উল্টো অভিযোগ করে বলে, আমাদের কাছেই টাকা পান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোঃ হেলাল বলছিলেন, আমি একটা কোম্পানিতে কাজ করতাম। সাত মাস কাজ করে কোন বেতন পাইনি। মোট ৮০০ লোকের ৭ মাসের বেতন ওরা মেরে দিয়েছে। বঞ্চিতদের বেশির ভাগই ছিল বাঙালী। ভারতীয় এবং ফিলিপাইনের নাগরিকও কিছু ছিল। এক পর্যায়ে সবাই মিলে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছিলাম। এ কারণে পুলিশ অনেককে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল। কয়েকজন বাঙালীও সে সময় জেলে যান। এসব কারণেই মাসিক বেতনে কাজ করেন না। তার মতে, খুচড়ো কাজ করলে টাকা মার যাওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। লক্ষণ খারাপ দেখলে কাজ ছেড়ে দিয়ে নতুন কাজে চলে যাওয়া যায়। তাই রাস্তার ধারে বসে থাকতে বাধে না। এভাবে নিয়তির সঙ্গে যুদ্ধ করেই বেঁচে আছেন তারা। সবচেয়ে বেশি খারাপ ছিলেন করোনার কালে। কেউ মরেছেন। কেউ মরতে মরতে বেঁচে গেছেন। শ্রমিকরা জানান, ৫-৬ মাস ঘর থেকে বের হওয়া বারণ ছিল। কাজ করা যায়নি। কাজ ছিল না বলে খাবারও ছিল না। অনেকে বাংলাদেশ থেকে টাকা এনে খরচ করেছেন। মুন্সীগঞ্জের শ্রমিক মনোরঞ্জন জানান, গতবার তিনি দেশ থেকে ৪০ হাজার টাকা চেয়ে নিয়েছেন। এবার নিয়েছেন ৩০ হাজার। এ টাকায় কোনরকমে খেয়ে পরে বেঁচেছেন। করোনাকালে তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন বলেও জানান তিনি। বলেন, রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলাম। বাইরে বের হওয়ায় পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এখনও মামলা আছে। তাই দেশে আসতে পারছেন না তিনি। শরীতপুরের সুজন জানান, করোনার সময় অনেক বাঙালী মারা গেছেন মালদ্বীপে। তাদের মালে ও হুলহুমালেতে কোনরকমে কবর দেয়া হয়েছে। কবরের চিহ্নও নাই এখন। কত মানুষ যে না খেয়ে ছিল! রাস্তায় বসে কেঁদেছে তারা। এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তার ধারে বসে কাজ খুঁজছেন। জীবন যুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। রনি জানান, প্রথমে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে কোথাও কাজ আছে কিনা জানার চেষ্টা করেন। তবে এ প্রক্রিয়ায় খুব বেশি কাজ পাওয়া যায় না। তাই কয়েকটি স্পটে সরাসরি বসে যান তারা। যাদের প্রয়োজন তারা এখানে এসে দর দাম করে শ্রমিক সংগ্রহ করেন। কী ধরনের কাজ করানোর জন্য স্থানীয়রা শ্রমিক খুঁজতে এখানে আসেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, যার যে কাজের অভিজ্ঞতা আছে তিনি সে কাজ করেন। আবার অন্য কাজও হাতছাড়া করতে চান না। তবে নির্মাণ কাজ, বাসা রং করা, বাসা পরিবর্তন, গাছ লাগানো ইত্যাদি কাজের জন্যই বেশি ডাক আসে বলে জানান তিনি। পার্কের একটি ভাঙ্গা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছিলেন ভোলার লালমোহনের আব্দুল মালেক। তিনি জানান, বহু কষ্ট করে জীবন যাপন করতে হয় তাদের। এক কক্ষে ১০-১২ জন থাকেন। একেকজন ১০০০ টাকা করে ঘর ভাড়া দেন। দোতলা বিছানা। এমন ৫-৬টি বিছানা থাকে এক কক্ষে। খাওয়ারও কষ্ট আছে। তবুও টাকা বাঁচিয়ে দেশে পাঠান। দেশেও তো স্ত্রী সন্তান আছে, তাদের সুখে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু হায়, তাদের খুশি করার কথা ভাবেন না কেউ!
×