ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভারত থেকে এলো মিগ-২১ ও ট্যাঙ্ক টি-৫৫

প্রকাশিত: ২৩:২৮, ৮ ডিসেম্বর ২০২১

ভারত থেকে এলো মিগ-২১ ও ট্যাঙ্ক টি-৫৫

আজাদ সুলায়মান ॥ ঢাকায় আনা হয়েছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত একটি যুদ্ধবিমান মিগ-২১ (ভিনটেজ) ও একটি ট্যাঙ্ক টি-৫৫। বুধবার ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ কার্গো বিমানে করে আনা হয় মিগ-২১। হযরত শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সকাল সাড়ে দশটায় খণ্ডিত মিগ-২১বাহী বিমানটি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। পরে সন্ধ্যায় এটিকে সাতটি বড় লরিতে করে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে যাওয়া হয় শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরে। অপরদিকে সড়কপথে ভারতের কলকাতা থেকে আনা হয় টি-৫৫। দুটো সমরযানই বিজয় দিবস উপলক্ষে দর্শক-সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশকে বন্ধুত্বের উপহার হিসেবে ভারত এ দুটো আকর্ষণীয় সমরযান দিয়েছে। মঙ্গলবার সকালে মিগ-২১ ভিনটেজ যুদ্ধবিমানটি অন্য একটি বিমানে বহন করে ঢাকায় আনা হয়েছে। সন্ধ্যায় জাতীয় জাদুঘরে পৌঁছার পর মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন- আজ বুধবার থেকেই ভিনটেজের এ্যাসেম্বলিং করা হবে। ৪/৫ দিন লাগতে পারে পূর্ণ অবয়বে প্রতিস্থাপন করতে। এটি এখানেই প্রদর্শনের জন্য স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হবে। আজ থেকে মিগ-২১ এর এ্যাসেম্বলিং শুরু হবে। এখানে ভারতীয় বিমান বাহিনীর ১১ জন ও বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ২৩ জন দক্ষ সদস্য অংশ নেবেন। জানা গেছে, বিশালাকৃতির মিগ-২১ যুদ্ধবিমানটি মোট অর্ধশত খ-ে কার্গোবিমানে ঢুকানো হয়। এর মধ্যে বড় পাঁচটি খ- হচ্ছে দুটো পাখা, মূল বডি, পেছনের লেজ ও চাকা। বাকিগুলো ছোট ছোট খ-। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো জাহাজটি অবতরণ করার পর সেটাকে নিয়ে যাওয়া হয় রানওয়ে সংলগ্ন পশ্চিম পাশের বিমান বাহিনীর বঙ্গবন্ধু ঘাঁটিতে। ওখানেই দু’দেশের বিমান বাহিনীর সদস্যদের তত্ত্বাবধানে আনলোড করে তোলা হয় বড় বড় সাতটি লরিতে- যেগুলো সন্ধ্যার আগেই শাহবাগে এসে পৌঁছায়। মিগ-২১ ভিনটেজ রাশিয়ার নির্মিত কার্যকরী যুদ্ধজাহাজ (ফাইটার জেট)। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে এটি দিয়ে বেশ কয়েকবার আকাশ হামলা চালানো হয়। ওই সময়ে এ ধরনের জাহাজই ছিল অত্যাধুনিক ও নির্ভরযোগ্য আকাশযান। চোখের পলকেই শত্রুঘাঁটিতে হামলা করে নিরাপদে নিজের বেইজে ফিরে আসতে পারদর্শী এই যুদ্ধজাহাজটি। এতদিন ভারতীয় বিমান বাহিনীতেই বিশেষ মর্যাদায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল। মিগ-২১ এর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এটি এক ক্রুচালিত ফাইটার জাহাজ। ২৩ ফুট দীর্ঘ ও পাঁচ ফুট চওড়া দুটো উইংয়ের ওজন ২৯৭ কেজি। জাহাজটির মোট ওজন ৬ হাজার ৮৫০ কেজি, ১৭৯০ কেজি জ্বালানি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন, ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৫০০ মাইল গতিতে উড্ডয়নে সক্ষম, ল্যান্ডিং স্পীড ঘণ্টায় ২৮০ কিলোমিটার, পাইলট ১ বা ২ জন, দৈর্ঘ্য ১৪.৫ মিটার উচ্চতা ৪.১২৫ মিটার, বোঝাই অবস্থায় ওজন ৮,৮২৫ কেজি, সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ২,৩৫০ কিলোমিটা। এতে ১ দশমিক ৩০ মিলিমিটার জিএসএইচ-৩০-১ কামান (১৫০ রাউন্ড) থাকে। সর্বোচ্চ ৩৫০০ কেজি ওজনের অস্ত্র ৪টি এ্যান্টি-এয়ারক্রাফট মিসাইল থাকে। মিগ-২১ একটি সুপারসনিক ফাইটার। এটি আকাশ থেকে থেকে আকাশে, আকাশ থেকে মাটিতে সব দিকেই কার্যকরী। মিগ-২১ এর আছে শক্তিশালী ইঞ্জিন ও হালকা বডি। এ ছাড়া উন্নত ম্যানুয়েভার পাওয়ার এই ফাইটারকে অন্য সব ফাইটারগুলো থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। মিগ-২১ এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশ কম। এই বিমানের জন্য আলাদা শেডের দরকার হয় না। খোলা আকাশের নিচে এই বিমান ফেলে রাখা যায়। ১৯৫৯ সালে সার্ভিসে আসার ৫০ বছর পরেও মিগ-২১ এবং চীনা সংস্করণ জে-৭, এফ-৭ এয়ারগার্ড বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। যার প্রধান কারণ এর উন্নত সংস্করণ। এই ফাইটারের বডি বাদে মোটামুটি সব পার্টসই কম-বেশি উন্নত হয়েছে। আর এই আপগ্রেডেশন এই ফাইটারকে আধুনিক রাখতে সাহায্য করেছে। এই মিগ-২১ বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রথম ফাইটার বিমান, যা উপহার দিয়েছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। বর্তমানে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী মিগ-২১ এর চীনা সংস্করণ জে-৭, এফ-৭ এয়ারগার্ড ফাইটার হিসেবে ব্যবহার করে। জানা গেছে, মিকোয়ান ডিজাইন ব্যুরো মিগ-২১ বিমানের নক্সা তৈরি করে। এর ন্যাটো কোডনেম ফিসবেড। মিগ-২১ এর জন্ম হয় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে। এটি ইতিহাসে সর্বাধিক নির্মিত ফাইটার জেট। এটি মালালাইকা নামে অধিক পরিচিত ছিল। এর পূর্বসূরি মিগ-১৯, যা ছিল মূলত গ্রাউন্ড এ্যাটাক ফাইটার। ১৯৪৮-৪৯ সালে সোভিয়েতরা মিগ-১৭, মিগ-১৯ এবং সুখোই-৭ এর সমন্বয়ে একটা সুপারসনিক ফাইটার বিমান তৈরির ডিজাইন সম্পন্ন করে। মিগ-২১ এর পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের পরে সোভিয়েতরা বুঝতে পারে যে ফাইটার অনুপাতে ইঞ্জিনের ক্ষমতা কম, তখন এই ঝামেলা সারিয়ে তৈরি করা হয় আরেকটি প্রটোটাইপ। এই প্রটোটাইপও ডানার ঝামেলার কারণে বিফল হয়। একই অবস্থায় পড়ে তাদের টেস্টিং প্রটোটাইপও। অবশেষে ১৬ জুন ১৯৫৫ সালে সর্বশেষ প্রটোটাইপ চূডান্তভাবে বানানোর অনুমতি পায়। এই ফাইটার সার্ভিসে আসে ১৯৫৯ সালে। পরে সোভিয়েত রাশিয়ার বিমান বাহিনীর বহরে এই বিমান যুক্ত করা হয়। ১৯৫৯ সালের আগে এটি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছুই জানতো না। কিন্তু, ভিয়েতনাম যুদ্ধে তারা এটা সম্পর্কে জানতে পারে। জাানা গেছে, বর্তমানে অকেজো টি-৫৫ ট্যাঙ্ক ও একটি ৭৫/২৪ মিঃ মিঃ মাউন্টেন হাউটজার মঙ্গলবার সকাল এগারটায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল বিথিয়ন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্নেল আশরাফের কাছে উপহার হিসেবে হস্তান্তর করেন। বিজয়ের মাসে বাংলাদেশের প্রতি সম্মাননা জানাতে তাদের এটি ভ্রাতৃপ্রতিম উপহার বলে বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। বেনাপোল স্থলবন্দরের উপ-পরিচালক মামুন কবীর তরফদার জানান- বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বন্দর, উপজেলা প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এটি হস্তান্তর করা হয়। ট্যাঙ্ক এবং মাউন্টেন হাউটজার গানটি পেট্রাপোল স্থলবন্দর থেকে ক্রেনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর দুটি গাড়িতে আনলোড করে লালন শাহ সেতু এবং বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে সেনা সদর দফতর ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে জাতীয় জাদুঘর ও ঢাকা সেনানিবাসে পৌঁছানো হয়।
×