ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সেলিম জাহাঙ্গীর

অপ্রতিরোধ্য সুকৃতি গোস্বামী

প্রকাশিত: ০০:০৮, ৭ ডিসেম্বর ২০২১

অপ্রতিরোধ্য সুকৃতি গোস্বামী

হরেক রকম ঘাত প্রতিঘাতকে পেছনে ফেলে অদম্য গতিতে সামনে এগিয়ে চলা নারীদের সংখ্যা আজ আর হাতে গোনার অবস্থায় নেই। সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন অভিঘাতে নারীদের সামনে চলার পথ সেভাবে নিরাপদ এবং নির্বিঘœ নয়। নিজের প্রয়োজনে পরিস্থিতির দাবিতে বের হয়ে আসতে হয় সমস্যা সঙ্কুল আবর্ত থেকে। তেমনই এক লড়াকু নারী রাজশাহীর সুকৃতি গোস্বামী। রাজশাহীর বালিয়া পুকুর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন এই সংগ্রামী নারী। পিতা নিতাই ভট্টাচার্য আর মা শান্তি ভট্টাচার্য। তাঁদের একমাত্র কন্যা সুকৃতি। ২৫ বছর আগে বিয়ে হয় প্রদীপ গোস্বামীর সঙ্গে। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর কাকাদের সঙ্গে কোন সম্পর্কের বাঁধনে জড়ানো যায়নি। শুধুমাত্র পারিবারিক সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারার জটিলতায়। স্বামীর সংসারেও তেমন সচ্ছলতার অভাব সুকৃতিকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। দেখতে দেখতে ৪ কন্যার সন্তানের জননীর অবস্থানে সুকৃতি। অভাবের সংসারে চোখে শর্ষের ফুল দেখার অবস্থা। নিজে অনেক কষ্ট করে জীবন কাটাচ্ছেন। সন্তানদের অপেক্ষাকৃত ভাল কিছু উপহার দিতেই হবে। সেই তাড়নায় নতুন কিছু করার চেষ্টায় নিজেকে সমর্পণ করেন। উপায় বের করতেও খুব বেশি সময় লাগে না। স্বামী প্রদীপ কন্যাদের জন্য প্রায়ই বাজার থেকে তেঁতুলের চাটনি নিয়ে আসত। সেই চাটনি দেখে সুকৃতি ভাবতে থাকে নিজেই তো এমন কিছু তৈরি করে বাজারে বেচা-বিক্রি করতে পারি। চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে খুব বেশি ভাবেননি। চাটনি তৈরি করে ছোট পলিথিনের প্যাকেটের মুখে মোম লাগিয়ে বিভিন্ন দোকানে নিয়ে যান অনেক আশা নিয়ে। মাঝে মধ্যে মোম গলে চাটনি কোন দোকানদারের টেবিলে পড়ে যাওয়ার অবস্থাও ঘটে। সদাশয় দোকানি ভাল বুদ্ধি দেয় সুকৃতিকে। তবে তা যেন পলিথিনের প্যাকে নয় একেবারে কাঁচের বয়ামে ভরে বিক্রি করতে হবে। সেভাবে সুকৃতি তার নতুন জীবনের পথচলা শুরু করেন। কাঁচের বয়াম কিনতে দোকানদারই তাঁকে সহায়তা করেন। হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন জায়গায় আচার বিক্রি করা অত সহজ সাধ্য ছিল না। চারপাশের মানুষের উপহাস, উপেক্ষা আর বিদ্রƒপ সব সময়ই ভাগ্যে জুটত। কিন্তু জীবন যোদ্ধা সুকৃতি কোনদিকে তোয়াক্কাও করে না। নিজের হাতে তৈরি চাটনি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয় যত্রতত্র। পায়ের ব্যথায় রাতের ঘুম পর্যন্ত হারাম হয়ে যায়। তবু সুকৃতি দমেন না। কঠিন মনোশক্তিতে সামান্য পুঁজি সম্বল করে যে ব্যবসার নতুন অধ্যায় শুরু করেন তা আজ রমরমা। বহু কষ্ট আর পরিশ্রমের সুফল আজ সুকৃতির হাতের নাগালে। ইতোমধ্যে বড় হতে থাকে তার চারটি ফুটফুটে কন্যা। তাদের লেখাপড়ার বিষয়টাও মাকে ভাবিয়ে তোলে। প্রতিদিন হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমের যে কষ্ট, দুঃখ তাও একসময় প্রশমিত হয়ে যায়। বড় মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ছোটরাও ধাপে ধাপে এগিয়ে আসতে থাকে। তবে স্বামী প্রদীপ সব সময় ছায়ার মতো তাকে সুরক্ষা দিয়েছেন। মানুষের অবহেলা, উপেক্ষার দুঃসময়ে যথার্থ সঙ্গীর মতো পাশে থেকেছেন। তেমন সফলতাও এসেছে জীবনে ও সংসারে। সুকৃতি আজ সফল ব্যবসায়ীর কাতারে। রাজশাহীর পিজি ফুডসের স্বত্বাধিকারী। ব্যবসার জন্য অনুমোদিত সনদপত্রও আছে। সবচেয়ে বড় কথা ব্যর্থতাকে অতিক্রম করে সচ্ছল-স্বাচ্ছন্দ্য জীবন উপহার পাওয়া ও যুদ্ধে জয়ী হওয়া। অপরাজিত নারী সুকৃতি এখন আর হেঁটে হেঁটে তাঁর পণ্য বিক্রি করেন না। এখন স্কুটি নিয়ে সে তাঁর বাণিজ্যিক যাত্রাপথকে অবাধ ও মুক্ত করেছে। ততদিনে সন্তানরাও লেখাপড়ায় সমৃদ্ধ আঙিনায়। বড় মেয়ে প্রীতি স্নাতক পরীক্ষার্থী। মেজজন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে। পরের জন উচ্চ মাধমিক দ্বিতীয় বর্ষে। ছোট জন দশম শ্রেণীতে। জীবন এখন কানায় কানায় ভরে উঠেছে সংগ্রামী সুকৃতির অদম্য এগিয়ে যাওয়ার অভিযাত্রায়।
×