ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া

প্রকাশিত: ০০:০৫, ৭ ডিসেম্বর ২০২১

নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া

১৮৮০ সালে জন্ম নেয়া মহীয়সী বেগম রোকেয়ার পৃথিবীর আলো দেখার দিনটি ৯ ডিসেম্বর। আবার চিরপ্রস্থানের সময়ও ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর। জন্ম মৃত্যুর এমন মিলিত দিনক্ষণ সত্যিই অভাবনীয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর আশির দশকে জন্ম নেয়া এই কিংবদন্তি আজও নারী চিন্তায় শুধু আধুনিক কিংবা সমকাল নয় একেবারে চিরস্থায়ী মনন সত্তা। সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুটা ছিল অর্ধাংশ নারী জাতির এক বিভীষিকাময় জগত। প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগের ধারাবাহিকতায় নারীদের পশ্চাদবর্তিতা, অবরুদ্ধতার সময় পার করতে ঊনবিংশ শতাব্দীর আধুনিক যুগ নতুন সময়ের উপহার হলেও পিছিয়ে পড়া নারীরা সেখান থেকে তখন অবধি মুক্ত হতে পারেনি। বাল্য বিয়ে, অকাল মাতৃত্ব, সতীদাহ প্রথার মতো দুঃসহ জীবন কাটানোই ছিল যেন সমাজ ও সংস্কারের অমোঘ বিধান। যাকে অতিক্রম করা অসহনীয় এক অব্যবস্থার সঙ্গে লড়াই-সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া। তেমন তমসাচ্ছন্ন এক অপ্রতিরোধ্য দুঃসহ জীবন কাটানো যেন অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। সেই চরম ক্রান্তিকালের বিপন্ন সময়ে জন্ম নেন নারী জাগরণের বলিষ্ঠ দিশারী বেগম রোকেয়া। এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তৈরি হওয়া রোকেয়া অনুভব করলেনÑ মেয়েদের জন্য এক অনতিক্রম্য অবরোধ প্রথা। শুধু তাই নয় সমাজ-সংসারের শৃঙ্খলিত জীবনে কন্যা সন্তানের অধিকারহীনতার নির্মম ঘটনাপঞ্জি। শুধু পুরুষ নয় বহিরাগত মহিলাদের সামনেও কন্যাদের আসার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল। বালিকা বয়সে জ্ঞান চর্চার কোন পরিবেশ পরিস্থিতি ছিল না। বরং ধর্মীয় শিক্ষা এবং মায়ের হাতে সংসারের তালিম নেয়াই ছিল অবোধ মেয়েদের প্রতি দিনের কাজের তালিকা। বিয়ের পর যাতে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সেখানে মানিয়ে-গুছিয়ে নিতে কোন সমস্যা না হয়। আর বিয়ে মানেই বাল্য বিয়ে পরিণতিতে অকাল মাতৃত্ব। জমিদার পরিবারে জন্ম নিলেও তখন জমিদারি জৌলুস হারানোর বিপন্ন সময়। মাতৃভাষা বাংলা ছিল প্রায়ই অপ্রচলিত, সাংসারিক কঠোর নিয়মের মধ্যে। অভিজাত ভাষা ছিল উর্দু। বেগম রোকেয়ার বড় বোন করিমুন্নেসার অতি শৈশবকাল থেকে বাংলাভাষার প্রতি ছিল অদম্য আগ্রহ। সেই বাসনায় লুকিয়ে বাংলা বই পড়াও ছিল স্বভাবজাত। মাঝে মাঝে ধরাও পড়ে যেতেন। বেগম রোকেয়ার স্মৃতিচারণে করিমুন্নেসার এমন দুর্লভ আগ্রহ তাকে কতখানি উৎসাহিত করেছিল তার উল্লেখ আছে। উত্তরকালে রোকেয়া মাতৃভাষা চর্চায় শুধু নয় মায়ের ভাষাতে তার লেখনী শক্তির চমৎকার সম্ভার আমাদের সত্যিই মুগ্ধ ও বিমোহিত করে। বড় বোনের ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়, যার প্রেরণায় রোকেয়া জ্ঞান চর্চায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। পরবর্তীতে ভাই ইব্রাহিম সাহেবের সহায়তায় লেখাপড়ার প্রতি রোকেয়ার আগ্রহ দিন দিন বাড়তেই থাকে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের কোন সুযোগ তিনি পাননি। জন্মগতভাবে অসাধারণ এক প্রতিভাদীপ্ত মনন নিয়ে জীবনকে যে মাত্রায় শাণিত করেছেন তা যেমন বিস্ময়কর একইভাবে মুগ্ধতার বিষয়। কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিক রেওয়াজ অনুযায়ী বেগম রোকেয়ারও বিয়ে হয়ে যায় ১৬ বছর বয়সে। বিপতœীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। বিহারের উর্দুভাষী স্বামীর অপার আনুকূল্যে বেগম রোকেয়া যেভাবে পড়াশোনায় নিবিষ্ট হলেন পাশাপাশি মনন ও সৃজন দ্যোতনায়ও নিবেদিত হতে সময় লাগেনি। স্বামী বিলাত ফেরত উচ্চ শিক্ষিত সরকারী কর্মকর্তা। ইংরেজী ভাষায় সুপ-িত, উদারমনা এবং নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। যার একান্ত সান্নিধ্যে বেগম রোকেয়ার জীবনের মোড় ঘুরে যেতে সময় লাগেনি। অল্প বয়সে স্বামীহারা হয়ে নিজেই চলার পথকে নির্বিঘœ করতে সচেষ্ট হন। স্বামীর রেখে যাওয়া অর্থে খাওয়া পরার সমস্যা হয়নি কখনও। আবার মেয়েদের জন্য একটি বিদ্যালয় খুলতেও স্বামীর রেখে যাওয়া অর্থই তাকে আলোর পথ দেখায়। শৈশবের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বেগম রোকেয়া যে শিক্ষা পেয়েছিলেন সেটাই তার জীবনের নবদ্যুতির পরম নির্দেশনা। অর্থ আর সুযোগ দুটোই যেদিন হাতের নিকটে এলো সেদিন প্রথম তার সামনে দাঁড়ায় এদেশের অসংখ্য অসহায় ও পিছিয়ে পড়া নারী। সৃজন প্রতিভার স্ফূরণ আর বাস্তব কর্মযোগে অর্ধাংশ এই মেয়েদের জন্য যা যা করা সম্ভব সবটাই করতে অকুণ্ঠিত ছিলেন তিনি। পুরুষ শাসিত সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে উন্নত মস্তকে নিজের লক্ষ্য সাধনে জোরালোভাবে সমর্পিত হওয়াও ছিল রোকেয়ার অনমনীয় চিত্তের অনন্য দৃঢ়তা। বাংলা ও ইংরেজী দুই ভাষায় তার ক্ষমতা ও দক্ষতা ছিল অভাবনীয়। যাকে সম্বল করে তিনি নিজেকে এগিয়ে নিতে কোন দিকে ফিরেও তাকাননি। বাল্য বিয়েকে কঠোর সমালোচনা করে বলতে পিছপা হননিÑ যে অর্থ খরচ করে একজন বালিকাকে বিয়ে দেয়া তার অর্ধেক খরচ করলে কোন মেয়ে শিক্ষিত হয়ে যায়। শুধু তাই নয় নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সক্ষমতাও অর্জন করে। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন সমাজের দুটো চাকা সমান তালে এগিয়ে যেতে ব্যর্থ হলে পদে পদে হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। নারী জাগরণের দিকপাল মহীয়সী বেগম রোকেয়ার ৯ ডিসেম্বর জন্ম ও মৃত্যু দিবস। তাঁর প্রতি অন্তর্নিহিত অপরিমেয় শ্রদ্ধা।
×