ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আলোঝলমল জামালখান

দেয়ালজুড়ে টেরাকোটা সড়ক দ্বীপে ল্যাম্পপোস্ট

প্রকাশিত: ২৩:১৫, ৭ ডিসেম্বর ২০২১

দেয়ালজুড়ে টেরাকোটা সড়ক দ্বীপে ল্যাম্পপোস্ট

জনকণ্ঠ ফিচার ॥ চট্টগ্রামে সড়কদ্বীপের মাঝে ছোট ছোট ল্যাম্পপোস্ট, সন্ধ্যাপ্রদীপ জ¦ালিয়ে যেন স্বাগত জানাচ্ছে নগরবাসীকে। ভাস্কর্য, ম্যুরাল, টেরাকোটা ও গুণীজনকে স্মরণে দেয়ালে দেয়ালে ঐতিহ্য সংস্কৃতি। পরতে পরতে এমন দৃশ্য কোন স্বপ্ন কিংবা পরিকল্পনায় সাজানোর বিবৃতি নয়। এ সবের বাস্তবায়ন হয়েছে চট্টগ্রাম মহানগরীর চেরাগী পাহাড় থেকে জামালখান এলাকায়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অনেক স্থান যেখানে এখনও ময়লা আবর্জনায় ঢাকা, দখলদারদের দৌরাত্মে ফুটপাতে পথচারীদের হাঁটাচলা যেখানে কঠিন, সেখানে ২১ নম্বর জামালখান ওয়ার্ড ব্যতিক্রম। এখানে ফুটপাতে নির্দিষ্ট আসনে বসে নগরবাসী তুমুল আড্ডায় মেতে ওঠে। মা-বাবার হাত ধরে শিশুরা এ্যাকুরিয়াম আর টেরাকোটা দেখতে আসে। আলোর ঝলকানি দেখতে হাজারও লোকের পদচারণা হয় এই এলাকায়। সবুজের সঙ্গে আলোকায়নের সজ্জায় অপরূপ সৌন্দর্য থাকায় এই এলাকায় হাতে হাত রেখে প্রেম-বিরহগাথা সাজায় যুগল। আর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফটোশূটের জন্য নবদম্পতিরা ছুটে আসে জামাল খানের টেরাকোটা ও আলোকোজ্জ্বল সড়কদ্বীপে। এ যেন চট্টগ্রামের বুকে এক টুকরো ভালবাসা। ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সবুজায়নে রূপ নিয়েছে দর্শনীয় স্থানে। নগরীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ সড়কে যেখানে অন্ধকারে ডুবে থাকে, সেখানে জামালখান মোড়ের ডাঃ হাশেম চত্বরে কৃত্রিম ফোয়ারার সঙ্গে রঙ্গিন আলোকসজ্জা মনে করিয়ে দেয় যে, এই চট্টগ্রাম হাজার বছরের ঐতিহ্যের শহর। জামালখান তার ঐতিহ্যে ফিরেছে। সাবেক সফল মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সময়ে ‘হেলদি ওয়ার্ড’ সুনাম কুড়ানো জামালখান বর্তমানে নিরাপদ বিনোদন কেন্দ্রও। এ সব পরিবর্তনের নেপথ্যে বর্তমান কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন। ২০১৫ সালে ২৮ এপ্রিল কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে একের পর এক চমকপ্রদ উন্নয়ন কাজের উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশে এক নামেই পরিচিত করিয়েছে জামালখান ওয়ার্ডকে। ঐতিহ্যের সাক্ষী চেরাগী পাহাড় ছিল অন্ধকারে ডোবা। চেরাগীর চূড়াটি ছিল ভঙ্গুর। সেই ভঙ্গুর চূড়াকে সংস্কার করে এবং আলোকায়নের মাধ্যমে দৃষ্টিনন্দন করে সাড়া ফেলে দেয় চট্টগ্রামে। বিশেষ করে সারাদিন এলাকাটি ঘিরে আড্ডা দিয়ে থাকেন সাংবাদিক, ছাত্র-শিক্ষক, শিল্পী-সাহিত্যিকরা। সকল বিষয় মাথায় রেখে সাজানো হয়েছে চত্বরটিকে। এক সময় জামালখান মোড় ছিল অপরাধীদের অভয়ারণ্য। সেখানে এখন সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে ঢাকার টিএসসির মতো তারুণ্যের উচ্ছলতা। নিরাপত্তায় লাগনো হয়েছে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা। ১৯৯৫ সালে হেলদি ওয়ার্ডের সুনাম কুড়ানো জামাল খানের ডাস্টবিনের ময়লার দুর্গন্ধে চলাফেরায় ছিল বেহাল অবস্থা। এখন সেখানে বসার জন্য আছে আসন আর লাগানো হয়েছে ফুলের টব। এ ছাড়া ডোর টু ডোর বর্জ্য সংগ্রহ এবং বিন বিতরণ করায় পাল্টে গেছে অপরিষ্কারের চিত্র। ২০১৫ সালের এপ্রিলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে জামালখান ওয়ার্ড সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প হাতে নেন কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন। সরকারী উদ্যোগে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা ও সৌজন্যে সম্পন্ন করা হয়েছে আরও ৫ কোটি টাকার সৌন্দর্যবর্ধনের কর্মকা-। সৌন্দর্য বৃদ্ধির অনেক কাজ। তবে দেশজুড়ে যা সবচেয়ে বেশি আলোচিত তা হলো, চট্টগ্রাম ও কলকাতার রেনেসাঁর অগ্রদূত ডাঃ অন্নদা চরণ খাস্তগীরের নামে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির দেয়ালে টেরাকোটার কাজ। বিপ্লবীদের আন্দোলন থেকে বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে টেরাকোটার কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান ভাষা আন্দোলন, ৭ মার্চের ভাষণ, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়, হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে টেরাকোটার কাজ। এ সব সিপিডিএল নামে একটি আবাসন সংস্থার সৌজন্যে করা হয়। এরই সঙ্গে পুরো এলাকাজুড়ে করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন বাগান। আর মাঝে মাঝে বসানো হয়েছে আসন। এ ছাড়া যাত্রীদের জন্য রয়েছে ছাউনি। এর পাশ ধরেই একের পর এক আড্ডা দেয়ার আসন। এ যেন বিকেলের অবকাশ যাপনের নান্দনিক এক স্থান। ডাঃ এমএ হাশেমের ভাস্কর্য তৈরি করে জামালখান মোড়ে নির্মাণ করা পানির কৃত্রিম ফোয়ারা, যা মূল সড়কে যোগ করেছে বাড়তি সৌন্দর্য। সৌন্দয্যবর্ধন, সবুজায়ন ও ঐতিহ্যম-িত করে জামালখান এখন যে নগরীর একটি মডেল- তা চট্টগ্রামের বাইরে থেকেও যারা আসেন তারা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে। অকপটেই তারা বলেন, পুরো মহানগরী যদি জামালখান হয়ে যেত তাহলে চট্টগ্রাম হতো একটি স্বপ্নপুরী। এ বিষয়ে কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন বলেন, আমাকে মানুষ ভোট দিয়েছে প্রথমবার আন্দাজে। কেউ আমাকে চিনত না। তাদের বিশ^াস ও আস্থা কতটুকু রাখতে পেরেছি জানি না। তবে জামালখানকে আমার সন্তান মনে করে গড়ে তুলছি। নির্বাচিত হওয়ার পর বিভিন্ন প্রশাসনিক জটিলতায় আমাদের শপথ নিতে প্রায় তিন মাস বিলম্ব হয়। তবে জনগণ যখন সুযোগ দিয়েছে, তখন জামালখানকে অন্যান্য ওয়ার্ডের চেয়ে আলাদা করে সাজাতে চেয়েছি। সেই লক্ষ্য রেখে প্রথম দিন থেকেই আমার পরিকল্পনা ছিল জামালখানকে নান্দনিকভাবে সাজানো। সেই শুরু, যা এখনও অব্যাহত রেখেছি। এখানে যে এ্যাকুরিয়াম আছে ফুটপাতে, তা দেশের অন্য কোন স্থানে নেই। শীঘ্রই ‘বার্ড জোন’ করা হবে। এ জন্য বিদেশ থেকে পাখি আনা হবে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, পল্লীকবি জসীম উদদীনসহ শিল্প সাহিত্যে খ্যাতিমানদের টেরাকোটাযুক্ত স্মৃতি কর্নার আছে। নতুন প্রজন্ম যাতে বিস্মৃত না হয়, এ জন্য বিদ্যালয়ের পাশে এ সব শিক্ষণীয় বিষয় তুলে ধরেছি। তিনি বলেন, জামালখান এখন শুধু চট্টগ্রাম নগরীর সৌন্দর্যের উদাহরণ নয়, এটি সারাদেশের মানুষের মডেল হবে। ‘বাংলাদেশ দেখবে জামালখান’Ñ এই স্লোগানে ঐতিহ্য সংস্কৃতি সবুজ ও পরিচ্ছন্ন ওয়ার্ড হিসেবে গড়ে তুলছি। ৬০ বছর বয়সীদের সার্টিফিকেটসহ যে কোন নথিপত্র উনাদের বাসায় গিয়ে দিয়ে আসা হচ্ছে। আমি বলেছি, বয়স্কদের কষ্ট করে আসতে হবে না, কাউন্সিলর অফিস নিজেই যাবে তাদের বাসায়। বদলে যাচ্ছে সময়, দিন বদলের সনদ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভিশন বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি। পুরো জামালখানকে বিনোদন সাংস্কৃতিক ও ইতিহাসসমৃদ্ধ করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে এবার মহসীন স্কুলের দেয়ালে এমএস প্লেটের ওপর লেজার কাটিং করে চট্টগ্রামের ৩০ বরণ্যে ব্যক্তির ম্যুরাল করছি, যা ১৬ ডিসেম্বর উদ্বোধন করা হবে।
×