ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কামরুল ইসলাম খান

স্মরণে মুক্তিযুদ্ধ ॥ ভোমরা ক্যাম্পের দিনগুলো

প্রকাশিত: ২১:৩৩, ৭ ডিসেম্বর ২০২১

স্মরণে মুক্তিযুদ্ধ ॥ ভোমরা ক্যাম্পের দিনগুলো

(গতকালের পর) যশোরে তখন যুদ্ধ চলছে। ইপিআররাও সাতক্ষীরার সীমান্ত এলাকা থেকে ওই যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। ভোমরা সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে ত্রাণ সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন বাংলাদেশে আসতে থাকে। আমরা লক্ষ্য করলাম এসব সহায়তা ঠিকমতো যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছাচ্ছে না। এরই মধ্যে ভারত থেকে বিশেষত কলকাতা থেকে দলে দলে সাংবাদিকরা আসতে থাকেন বাংলাদেশের অবস্থা রিপোর্ট করার জন্য। তারাও আসতে থাকেন আমাদের কাছে। আমরা কয়েক ছাত্র-যুবক তখন ভোমরায় আস্তানা গেড়েছি। পরে এই আস্তানাই মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পরিণত হয়। মার্চের শেষদিকে কলকাতা থেকে সাংবাদিকদের এক গ্রুপ আমাদের কাছে আসেন। তারা যশোরের যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে চান। যশোরে তখন বিহারী-বাঙালী দাঙ্গাও চলছে। এ দলে ছিলেন ঐওঘউটঝঞঅঘ ঝঞঅঘউঅজউ-এর সাবেক সম্পাদক মানস ঘোষ, একজন ফটোসাংবাদিক ও পিনাকী বাবু। পিনাকী ছিলেন দীর্ঘদেহী ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। তাঁর পদবি এখন মনে নেই। তিনি যে সাঁতরিয়ে কলকাতা থেকে আন্দামান গিয়েছিলেন সে কথা জেনেছিলাম মানস ঘোষের কাছে। এই সাংবাদিক দলকে যশোর পাঠানোর উদ্যোগ নেই। তখন সব ধরনের গাড়ি চলাচল বন্ধ। কোন গাড়ি জোগাড় করতেও পারলাম না। পারলেও ওই গাড়ি যুদ্ধ এলাকায় ঢোকাও ঝুঁকিপূর্ণ। ফায়ার ব্রিগেডের এক ড্রাইভার আমাদের দুই খসরুর (কালো ও সাদা) বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল। সেই সূত্র ধরে ওই ড্রাইভারকে আমরা অনেক কাজে লাগাতাম। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িতে করেই সাংবাদিকদের পাঠালাম যশোর। এর আগে তাদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। কোথাও জায়গা না পেয়ে স্টেডিয়ামের পাশে আমার ফুফুর বাড়িতে খাওয়া এবং আমাদের বাড়ির সামনে ডাকবাংলোতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করি। ভোমরা ক্যাম্পে যেসব ত্রাণ সহায়তা আসছিল সেগুলো মাঝে-মধ্যে যশোর ও চৌগাছার রণাঙ্গনে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করি। ইতোমধ্যে আমরা ভোমরা ক্যাম্পে কয়েক আনসারকে দিয়ে প্রশিক্ষণ শিবির চালু করি। ভোমরা সীমান্ত তখন অনেকটা উন্মুক্ত। একদিন একটা পিকআপ ভ্যান চলে যাচ্ছিল ভারতে। আমরা সেটি আটক করলাম। সেটি সম্ভবত ম্যালেরিয়া বিভাগের ছিল। এই গাড়ি দিয়ে আমরা মাঝে-মধ্যে বিভিন্ন অপারেশনে সাতক্ষীরা শহরে যেতাম। এর মধ্যে ভোমরায় বিদেশী সাংবাদিকরা আসতে শুরু করেছেন। ওখানে দু-একটি পাকা ঘর ছিল। এই ঘরে দেয়ালে লেখা ছিল ‘এওঠঊ গঊ ইখঙঙউ, ও ডওখখ এওঠঊ ণঙট ঋজঊঊউঙগ’। তারা এই দেয়াল লিখনের ছবি তুলে নিয়ে যায়, যা পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন কাগজে ছাপা হয়। নেতাজীর এই উক্তি যে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামেরও প্রেরণা হতে পারে যেটা দেখে ভারতীয় ও বিদেশী সাংবাদিকরা কিছুটা বিস্মিত হলেন। ভোমরা ক্যাম্পে অনেকেই এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। পাইকগাছার এমএনএ গফুর ভাই এলেন। তিনি আসাতে আমাদের নেতৃত্বশূন্যতা অনেকটা কেটে গেল। ইপিআর সদস্যরা যশোর অঞ্চলে যুদ্ধ শেষে ভোমরা ক্যাম্প ও আশপাশের ক্যাম্পে সমবেত হয়। ভোমরা ক্যাম্পের তখনকার কমান্ডে ছিলেন সুবেদার আইয়ুব। মূলত গফুর ভাইয়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তখন কাজ শুরু হলো। এদিকে শাহজাহান স্যারের নেতৃত্বাধীন মুজাহিদ বাহিনীর একটি অংশ ভোমরায় আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এবার একে একে সাতক্ষীরা শহরে কয়েকটি অপারেশন করা হয়। প্রথমটি ছিল সাতক্ষীরা ট্রেজারি থেকে অস্ত্র ও গুলি সংগ্রহ। আরেকটি ছিল পাঞ্জাবী এসডিওকে আটক করে ভারত পাঠানো। সাতক্ষীরায় পাকবাহিনী আসার পর সীমান্তে হানা দিতে শুরু করে। এই পর্যায়ে আমাদের ক্যাম্প ভোমরা থেকে ভারত সীমান্তের ঘোজাডাঙ্গায় স্থানান্তর করা হয়। তবে ভোমরায় একটা পর্যবেক্ষণ চৌকি রাখা হয়। ঘোজাডাঙ্গায় স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় এবং দিন দিন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়তে থাকায় ক্যাম্পের আকার বড় করার প্রয়োজন দেখা দেয়। সেনাবাহিনী, ইপিআর, মুজাহিদ, আনসারের পাশাপাশি ছাত্র-জনতার স্থান সঙ্কুলানের জন্য ইছামতি নদীর তীরে ইটিন্ডিয়ায় এক আম বাগানে বড় আকারের ক্যাম্প তৈরি করা হয়। সীমান্ত থেকে মাইল তিনেক দূরত্বে এই ক্যাম্প কিছুটা নিরাপদ ছিল। বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর এই ক্যাম্প ৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে আসে। এই ক্যাম্প থেকেই একে একে চালানো হয় বিভিন্ন অপারেশন। পাকসৈন্যরা যখন আলিপুর ও মাহমুদপুর পর্যন্ত এসে ঘাঁটি স্থাপন করে। তখন পদ্মশাখরায় ইছামতি নদীর বাঁধ কেটে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে অনুযায়ী স্পট চিহ্নিত করা হয়। বাঁধ কেটে নদীর পানি উঠিয়ে দিলে হানাদারদের অগ্রযাত্রা থমকে যাবে। নির্ধারিত দিনে সন্ধ্যায় আমরা ইটিন্ডিয়া ক্যাম্প থেকে রওনা হলাম। ইপিআর, ছাত্র-যুবক সবাই এই অপারেশনে তৎকালীন ক্যাম্প কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে অংশ নিলাম। বিশাল সেই বাঁধ কেটে পানি তুলে দিতে সারারাত লেগে গেল। ভোরবেলা সম্পন্ন হলো ওই কাজ। জোয়ারের পানিতে সীমান্ত অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হলো। সাতক্ষীরার যে ক’জন ছাত্র-যুবক আমরা প্রথম ভোমরায় এসে ক্যাম্প চালু করি তাদের কেন্দ্র করেই যেমন ভোমরা ক্যাম্প বড় আকার পায়, তেমনি ইটিন্ডিয়া ক্যাম্পে সাতক্ষীরারও ওই গ্রুপকে কেন্দ্র করেই ছাত্র-যুবকদের বাহিনী গড়ে ওঠে। পাশাপাশি যশোর থেকে একটা গ্রুপ এখানে থেকে যুদ্ধে অংশ নেয়। এই গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন মুরাদ ও টিপু সুলতান। (চলবে) লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, জনকণ্ঠ
×