ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

প্রধানমন্ত্রীর স্যার বটবৃক্ষের প্রস্থান

প্রকাশিত: ২১:২৯, ৭ ডিসেম্বর ২০২১

প্রধানমন্ত্রীর স্যার বটবৃক্ষের প্রস্থান

আমাদের মাথার ওপরের ছাদগুলো খসে পড়ছে একে একে। সর্বশেষ নক্ষত্র রফিকুল ইসলাম স্যার চলে গেলেন। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, তাঁর প্রস্থান এক বেদনাবিধুর ঘটনার পাশাপাশি আমাদের জন্য এক সতর্কবার্তা। পরিমিত কথা বলা আর প্রমিত বাংলায় কথা বলার মানুষ এখন আর নেই বললেই চলে। আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি, ভাষা দূষণ নদী দূষণের চাইতেও ভয়ঙ্কর। আর সে ভাষাই আজ মহাদুর্যোগের মুখে। নাটক, সিনেমা, কবিতা, গান সব জায়গায় এমনকি মুখের কথায়ও বাংলা ভাষার ওপর এত অত্যাচার অভাবনীয়। আজকের প্রজন্ম শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে জানে না। যাঁদের দেখে, যাঁদের কথা শুনে জানত বা বুঝতে পারত প্রয়াত অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। নানা বিষয়ে প-িত মানুষটি কথা বলতেন কম, কাজ করতেন অধিক। আমরা জাতীয় কবি আখ্যা দিয়ে কবি নজরুল ইসলামকে বন্দী করে রেখেছি ঘেরাটোপে। তাঁর গান, কবিতা নিয়ে আগের মতো কাজ হয় না। একমাত্র্র রফিকুল ইসলামই কাজ করেছিলেন। বাংলার দুর্ভিক্ষ, ভাষা আন্দোলন, বাঙালীর স্বাধিকারের লড়াই এবং জাতিসত্তার সংগ্রামের অগ্নিসাক্ষী জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশের ইতিহাসকেই গ্রন্থিত করে গেছেন তাঁর সমস্ত লেখায়। তিনিই আবার নিজেকে উৎসর্গ করেছেন নজরুল সাধনায়। বিদ্রোহী কবির প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনী লিখেছেন তিনি। চেষ্টা করেছেন তার কর্মের আন্তর্জাতিকীকরণের। কেমন ছিল তাঁর জীবন বা জীবনবোধ? আজকের সমাজে যখন সাম্প্রদায়িকতা হানা দিচ্ছে, তখন তাঁর দিকে ফিরে তাকানো জরুরী। বাবা ছিলেন রেলওয়ের চিকিৎসক। বাসা ছিল রেলওয়ে কলোনিতে। দশ বছর বয়সে রফিকুল ইসলাম দেখেছেন বাংলার দুর্ভিক্ষ। ১২ বছর বয়সে তাকে হতে হয়েছে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সাক্ষী। ঢাকার বাইরে থেকে এসে সেইন্ট গ্রেগরিস স্কুলে ভর্তি হলেও দাঙ্গার কারণে তাকে স্কুল পরিবর্তন করতে হয়। অষ্টম শ্রেণীর পর তাকে ভর্তি করানো হয় আরমানিটোলা স্কুলে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সেই সময়টায় মুসলমান ছাত্রদের আরমানিটোলা স্কুলে ঢুকতে হতো মাহুতটুলি দিয়ে। আর হিন্দু ছাত্রদের ফটক ছিল পেছন, আরমানিটোলার দিকে। এক সাক্ষাতকারে সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘এই যে বিভাজন, এটা আমাদেরকে আরও অসাম্প্রদায়িক করেছে। মানুষে মানুষে কেবলমাত্র বিশ্বাসের কারণে এই যে হানাহানি এবং এই যে ঘৃণা এটা যে কত অবাস্তব, এটা ছেলেবেলায় মনে গেঁথে গেছে। ছেলেবেলা থেকে আমরা একটা অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গড়ে উঠেছি। চারদিকটায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার এই বিভীষিকা দেখে, এর বিরুদ্ধে ওই দাঙ্গার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের মধ্যে একটা ঘৃণা জন্মগ্রহণ করেছে। বর্ণাঢ্য জীবন প্রবাহে বিশিষ্ট নজরুল গবেষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম নজরুল অধ্যাপক এবং নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক। তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই সময়ের দুর্লভ কিছু আলোকচিত্রও তুলেছিলেন তিনি। বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের এই প্রত্যক্ষ সাক্ষী সেসব ইতিহাস গ্রন্থিত করেছেন তার লেখায়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে প্রথম গ্রন্থ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের ইতিহাসের প্রথম গ্রন্থসহ প্রায় ৩০টি বই লেখা এবং সম্পাদনা করেছেন তিনি। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম একুশে পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঘোষিত প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকেও ভূষিত হয়েছেন তিনি। এক সময় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়াও তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ছিলেন। ২০১৮ সালে তাকে জাতীয় অধ্যাপক ঘোষণা করে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গুরু ছিলেন তিনি। কিন্তু এসব বিষয়ে থাকতেন নীরব। বাংলাদেশের সমাজে এমন সুস্থির আর প্রজ্ঞাবান মানুষের দরকার বড় বেশি। তাই তাঁর চলে যাওয়া এক অপূরণীয় ক্ষতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় একাত্তরের জুলাই মাসে রফিকুল ইসলামসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষককে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানী সেনারা। যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তৎপরতায় এবং মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির হস্তক্ষেপে তাদেরকে সামরিক বন্দীশালা থেকে পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেই সময়ের বর্ণনা দিয়ে ২০১৫ সালে বিবিসিকে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, ‘এভাবে আমরা আমাদের সহকর্মীদের তৎপরতায় ক্যান্টনমেন্টের বন্দীজীবন থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দীজীবনে এলাম। সেখানেও মুক্তিযোদ্ধা বোঝাই। কিন্তু আমাদের মনে হচ্ছিল, আমরা পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে এলাম।’ আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির আকাশে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম একজনই। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। সিডনি থেকে [email protected]
×