ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নদী শাসনে নির্মাণ কাজের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা কমাতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাঙ্গন

প্রকাশিত: ১৭:৫৪, ৬ ডিসেম্বর ২০২১

নদী শাসনে নির্মাণ কাজের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা কমাতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাঙ্গন

যে কোন ধরনের জলজ অবকাঠামোকে রক্ষা করতে নদীশাসনে কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের নদীগুলোর গঠনগত পরিবর্তন অনিয়মিতাকার। ক্রমান্বয়ে নদীগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, বিশেষ করে বর্ষাকালে এর মাত্রা বাড়ে এবং ঠিক তখনই এই ধরনের জলজ অবকাঠামো রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করা যায় নদীর প্রবাহের পরিবর্তন, পানির সঞ্চারন, তীর ভাঙ্গন, নদীর তলদেশের ক্ষয়, চর তৈরি হওয়া ইত্যাদি। নদী শাসনের কাজ করতে হলে বিশেষ করে নদীর তীর বাধাইয়ের নির্মাণ কাজের সময় যাতে করে নদীর গঠনগত পরিবর্তন না হয় সেই দিকে নজর রাখা বিশেষ জরুরি। এই নির্মাণ কাজের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে, যখন বিভিন্ন প্রতিকূলতা সামনে আসে। এ সকল প্রতিকূলতার সম্মুখীন হলে কাজের ধরণেরও পরিবর্তন আনতে হয়। কাজের পরিকল্পনা কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর নির্ভর করে। নির্মাণ কাজের প্রত্যেকটি আইটেম পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। এই আইটেমগুলোর মাঝে মধ্যে পরিবর্তন করতে হয়। সাইটের পারিপার্শিক অবস্থা বুঝে। যদিও নকশা এবং নির্মাণ সাইট নির্দিষ্ট, তারপরও নির্মাণ কাজের সময় অনাকাক্সিক্ষত ভাঙ্গন দেখা দেয়। এর প্রধান কারণ হলো- নির্মাণকালে কাজের সমন্বয়হীনতা। এই সমন্বয়হীনতার জন্য নির্মাণ কাজের সময় নষ্ট হয় এবং নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি পায়। তাই নির্মাণ কাজের প্রত্যেকটি আইটেমকে সমন্বয় করে কাজ করতে পারলে এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রয়োগের মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাঙ্গনকে রোধ করা যায়। নদীশাসনের নির্মাণ কাজ প্রধানত দুটি মৌসুম নির্ভর। তা হলো- প্রাক-মৌসুম সময়/বর্ষাকালের আগে ও মৌসুম সময়কাল/বর্ষাকালে। সাধারণত নদী শাসনের নির্মাণ কাজগুলোতে যে আইটেমগুলো থাকে তা হলো- নদীর মনিটরিং সার্ভে; সফটওয়্যারের মাধ্যমে নদীর গঠনগত দিক বিশ্লেষণ; ড্রেজিংয়ের কাজ; প্রতিরক্ষামূলক উপাদান ফেলা (জিওব্যাগ, সি.সি ব্লক, পাথর ফেলা, ইট বা জিওট্রেক্সটাইলের চাদর বিছানো ইত্যাদি) তীর রক্ষামূলক কাজ (শুকনো মাটির খনন, সি.সি ব্লক স্থাপন, ইটের স্তর বিছানো, বার্ম নির্মাণ ইত্যাদি); অফটেক, লিভি, ডাইক ইত্যাদি নির্মাণ করা; তীর পাশ^বর্তী রাস্তা নির্মাণ; ঘাস লাগানো (বিশেষ করে ভেটিবার ঘাস খুব গুরুত্বপূর্ণ)। যে ধরনের সমস্যা গুলো নির্মান সাইটে দেখা যায় তা হলো- নদীর কোন অংশের বা নিমার্ণ সাইড তীর ভাঙন অথবা নদীর তল দেশের ক্ষয়; অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচলে প্রতিকূলতা (চর গঠনের ফলে নাব্যতা কমে যায়); তীরের উপর/পাশে ভারবাহী কাঠামো থাকা; নির্মাণ সাইটে মাটির গুণগত মান খারাপ থাকা; পুনুরুদ্ধারকৃত জমির/চর সঠিক ব্যবহার না হওয়া; ড্রেজিংয়ের উপাদান নির্দিষ্ট স্থানে না ফেলা; নির্মাণ সাইটে অপরিকল্পিত পানি নিষ্কাশন ও নির্মাণ কাজের প্রক্রিয়া যথাযথ অনুসরণ না করে। সম্ভাব্য সমাধান ॥ প্রাক মৌসুম সময়কাল/বর্ষাকালের পূর্বেঃ এই সময়ে নির্মাণ কাজের গতি সবচেয়ে বেশি থাকে কারণ বর্ষা পূর্ববর্তী সময়ে পানির স্তর নিচে থাকে। কাজের পূর্বে নদীর গঠনগত রূপ বিশ্লেষণ করতে হবে। যেমন নদীর পলির সঞ্চারণ, স্তরায়ন, তীরবর্তী মাটির ক্ষয়, চর গঠন এর জন্য সহজলভ্য Arch GISGes Delft 3D সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। বিগত বছরের ভূমির গঠনরূপ ও পলিমাটিরপ্রবাহ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে নির্মাণ কাজের যে অংশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সেটির কাজ আগে করতে হবে। বর্ষাকাল আসলে নদীর অতিরিক্ত গতি ও ভাঙন শুরু হয় বাধাইয়ের কাজের পূর্বে ড্রেজিং করে আগে ডিজাইন লেভেলে যেতে হয়। কিন্তু সব স্থানের মাটির গুণগত মান এক হয় না। তাই প্রায় সময় দেখা যায় যে, ড্রেজিংয়ের সময় নিচের পাড়ের দিকে ভাঙতে থাকে। তাই আগের মাটির গুণগতমান (মাটির শেয়ার শক্তি, ঢালের কোন, মাটির ফাইয়ের মান) জানতে হবে। তারপর সেই অনুযায়ী ড্রেজিংয়ের মাটি কাটার পুরুত্ব নিরূপন করতে হয়। মাটি কাটার পুরুত্ব বেড়ে গেলে ড্রেজারের শেয়ার শক্তি, টর্ক, বেগ, কাটারের চাপ ইত্যাদি বেড়ে যাবে এবং মাটির ভাঙ্গার প্রবণতা বেড়ে যাবে। তাছাড়া মাটির ভিতরে পানির ধারণ ক্ষমতাও এই ভাঙ্গনকে প্রভাবিত করে। মনিটরিং সার্ভের মাধ্যমে ড্রেজারের মাটি কাটার পুরুত্ব পর্যবেক্ষণ করা যায়। কোথাও যদি অতিরিক্ত কাটার ফলে ভাঙ্গন দেখা দেয় তা হলে সাথে সাথে ড্রেজিংয়ের কাজ বন্ধ করে দিতে হবে। পরবর্তীতে সেই ভাঙা জায়গায় জিওব্যাগ ফেলে পূর্ণ করে দিতে হবে। এই ধরনের মনিটরিং সার্ভেগুলো সাধারণত Global Mapper সফটওয়্যারের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। যখন এই কাটার সাকশন ড্রেজার তার ডিজাইন লেভেলে পৌঁছাবে তখন অতিদ্রুত প্রতিরক্ষামূলক উপাদান ফেলতে হবে। ডিজাইন লেভেলটি সাধারণত পূর্ব ও পরবর্তী মনিটরিং সার্ভের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে বের করতে হয়। এই সম্পূর্ণ কাজটি মনিটরিং সার্ভের ডাটা Global Mapper সফটওয়্যারের মাধ্যমে পক্রিয়াকরণ করে বের করতে হয়। সাধারণত কাটার সাকশন ড্রেজারের কাটার পুরুত্ব ৩ মিটারের বেশি করা যাবে না। আর যখন ডিজাইন লেভেলের কাছাকাছি যাবে তখন ০.৫ থেকে ১.৫ মিটার এর মধ্যে রাখতে হয়। পরবর্তী বড় সমস্যা হলো এই ড্রেজাররের মাটি নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা। নদীর পুনুরুদ্ধারকৃত জায়গায় এই মাটি ফেলা যেতে পারে। কিন্তু এই মাটি নদীর গঠনগত রূপপরিবর্তন করে ফেলতে পারে, যা নিমার্ণ কাজে প্রভাব ফেলবে। এর ফলে চর তৈরি হলে বা নাব্যতা কমে গেলে অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচলে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তাই এই মাটি নদীর পাড় গঠনে ব্যবহার করা যেতে পারে অথবা এমন স্থানে ফেলতে হবে যাতে করে নির্মাণ বা নৌ-চলাচলে কোন সমস্যার সৃষ্টি না হয়। তাছাড়া এই মাটি নদীর পাড়ে পাশ^বর্তী রাস্তা বা তার পিছনের ঢাল তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। সুতরাং এই ড্রেজারের মাটি ফেলার স্থানকে পূর্ব থেকে ঠিক রাখতে হবে। ড্রেজিং কাজ শেষ হলে নিমার্ণ কাজের প্রক্রিয়া সঠিকভাবে অনুসরণ করতে হবে। সাধারণত নির্মাণ কাজের জন্য যে প্রক্রিয়া সঠিকভাবে অনুসরন করতে হবে। যে প্রতিরক্ষামূলক উপাদান ফেলতে হবে তা নদীর তলদেশের এপ্রোন থেকে শুরু করতে হবে। কারণ এপ্রোনের ভারবহন ক্ষমতা উপরের ঢালের ভারবহন ক্ষমতার চাইতে ২.৫ থেকে ৩ গুণ বেশি। নদীর পাড়ের উপরের ভারবাহী কাঠামো থাকা অবস্থায় এর মাটির স্থায়িত্বের মান নূন্যতম ১.৫ হতে হবে। যদি পাড়ের উপরের মাটির ভার বহন ক্ষমতা এপ্রোনের চেয়ে কম হয় তাহলে ভাঙন দেখা দিবে। তাই প্রতিরক্ষামূলক উপাদান শুরুতে এপ্রোন থেকে ফেলতে হবে। তারপর নদীর তলদেশের ঢালতার পর পানির উচ্চতা থেকে আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠতে হবে। যে ধরণের জিওব্যাগ ফেলা হবে তার ঘনত্ব বের করতে হবে পুল টেস্টের মাধ্যমে। এই ঘনত্ব বের করতে হয় আয়তনের ভিত্তিতে অর্থাৎ ঘনমিটার এককে। এই সকল জিওব্যাগ নির্দিষ্ট স্থানে পড়ল কিনা তা বের করাটাও অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এপ্রোণ কিংবা নিচের ঢালু অঞ্চলের জিওব্যাগের পুরুত্ব বের করতে হয় ঘনত্ব থেকে। সঠিক স্থানে ফেলার জন্য লম্বা স্টিলের খাচা ব্যবহার করা হয়, তা না হলে নদীর পানির উচ্চতা থেকে তলদেশে পড়ার সময় পানির অতিরিক্ত ¯্রােত ও বেগের কারণে এই সকল জিওব্যাগ সঠিক স্থানে পড়বে না। মাল্টিভিম ইকো সাউন্ডারের মাধ্যমে এই জিওব্যাগের স্থানে ডাটা বের করা হয়। পরবর্তী Cloud computing এবং Global Mapper সফটওয়্যারের মাধ্যমে এর পুরুত্ব যাচাই করা হয়। নদীর তলদেশের ঢালে জিওব্যাগ সাধারণত ফিল্টার লেয়ার হিসেবে কাজ করে এবং তার উপর প্রতিরক্ষামূলক উপাদান যেমন- সি সি ব্লকবা পাথর ফেলা হয়। একই সাথে পানির উচ্চতা থেকে উপরেও কাজ করতে হবে। তারপর পানির তলদেশের কাজের সাথে দুইটি মিলিয়ে সমন্বয় করতে হবে। তারপর নদীরপাড়ে সি সি ব্লক বসাতে হবে এবং রাস্তার কাজ শেষ করতে হবে। মৌসুমি সময়কাল বা বর্ষাকালে দুইটি বড় সমস্যা হলো ভারি বৃষ্টিপাত ও আকস্মিক বন্যা, তীরবর্তী উপরের ঢালু স্থান অনেক বেশি স্থায়িত্ব সম্পন্ন হয়। কারণ পানি তার বিপরীতমুখী চাপ দেয়। এই সময়ে মাটির ভিতর পানির প্রবাহ কিছুটা নিয়ন্ত্রিতভাবে কমে যায়। বালুমাটির ভিতরকার পানির চাপ ও নদীর পানির চাপ একটা সাম্যতা বিরাজ করে। তাই এই সময়ে ভাঙ্গন কম দেখা দেয়। ভারি বৃষ্টিপাত ও সঠিকভাবে পানি নিষ্কাশন না হলেও ভাঙ্গন অংশের কাজ করা হয়। তখন একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর কিছু পাইপ স্থাপন করা হয়। কিন্তু বালুমাটি হলে এই পাইপের ভিতর দিয়ে বালুসহ পানি বের হয়ে আসতে পারে, যার কারণে ভাঙ্গন হয়। তাই পাইপ স্থাপনের পূর্বে মাটির সিপেজ রেট, পরোসিটি, ভয়েড রেশিও ইত্যাদি জানতে হবে। তাছাড়া অপরিকল্পিত পানি নিষ্কাশন পাড়ের পিছনের ঢালে পানি জমে যাবে। তার ফলে মাটির ভিতর দিয়ে পানি বের হয়ে আসার প্রবনতা বেড়ে যাবে। এর সাথে সাথে মানুষের বসতি, বাড়ি, রাস্তাও জলাবদ্ধতা তৈরি হতে পারে। নির্মাণ কাজের সময় নদীর অফটেকের মুখ অনেক সময় বন্ধ করা হয়। এতে করে ভারী বৃষ্টিপাতে জলবদ্ধতা হতে পারে অথবা শুকনো মৌসুমে পানির অভাব দেখা দিতে পারে। এই জন্য অফটেকগুলোতে পানি সরবরাহে পাইপ স্থাপন করতে হবে। এর ফলে গ্রামের লোকজন শুকনো মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি পাবে। যদি মূল নকশাতে ঘাস লাগানো অন্তর্ভুক্ত থাকে তাহলে এই বর্ষাকালে ঘাস লাগানোর উপযুক্ত সময়। এই ধরণের ভেটিবার ঘাস মাটির ক্ষয়রোধ করে। বর্ষাকালে পরপরই অনেক ভাঙ্গন দেখা যায়। কারণ পানির উচ্চতা কমে গেলে মাটির উপর পানির চাপ কমে যায়, তাই ভারসাম্যতা নষ্ট হয়। তাছাড়াও পূর্বে থাকা ভারবাহী কাঠামো এই প্রবণতা আরও বাড়িয়ে দেয়। এই সময় নদীর রূপগত গঠনের ও অনেক পরবির্তনহয় এবং নদীর প্রবাহ স্থানান্তরিত হয়। এই সময় প্রধান লক্ষ্য হলো- নির্মাণাধীন সাইটকে আগে রক্ষা করা। যদি কোথাও বড় ধরনের ভূমিক্ষয় দেখা দেয় তাহলে তার জন্য আলাদা সাপোর্ট দিতে হবে। এই জন্য স্পার বা অস্থায়ী বাঁধ তৈরি করা যেতে পারে। এর ফলে নদীর গতির পরিবর্তন হবে এবং স্পার তৈরি করা যেতে পারে স্থানীয় কাঠ বা বাঁশ দিয়ে অথবা বালু ভর্তি ব্যাগ ফেলে বাধ তৈরি করা যেতে পারে। তাছাড়াও নদীর কোন অংশে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে আর্টিফিশিয়াল কাটঅফ তৈরি করে প্রবাহ পরিবর্তন করা যায়। লেখক : মোঃ বেলায়েত হোসেন (ইফাত) বি.এস.সি, (সিভিল) (অস্ট) এম.এস.সি, (পানি সম্পদ, বুয়েট) ফিল্ড ইঞ্জি: (কনসালটেন্ট), পদ্মা বহুমুখী সেতুপ্রকল্প (নদী শাসন)
×