ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কাঁঠাল থেকে তৈরী হবে দই, আইসক্রিম, চকলেট ও চিজ

প্রকাশিত: ১৭:৪৬, ৫ ডিসেম্বর ২০২১

কাঁঠাল থেকে তৈরী হবে দই, আইসক্রিম, চকলেট ও চিজ

স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর ॥ বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট (বারি)’র বিজ্ঞানীরা কাঁঠালের পাল্প দিয়ে উন্নতমান, দারুন স্বাদ ও অধিক পুষ্টি সমৃদ্ধ দই, চকলেট, আইসক্রিম ও চিজ তৈরীর উপকরণ ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন, যা সারা বছর অতি সহজেই যে কেউ তৈরি করতে পারবে। সম্প্রতি কৃষি গবেষনা ফাউন্ডেশনের সহায়তায় পোস্টহারভেস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রসেসিং এন্ড মার্কেটিং অব জ্যাকফ্রুট প্রকল্পের মাধ্যমে এসব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়। বারি’র পোস্টহারভেসট টেকনোলজি বিভাগের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্পের প্রধান গবেষক ডঃ মোঃ গোলাম ফেরদৌস চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রামের ভেটেরিনারী এন্ড এনিমেল সাইন্স ইউনিভারসিটির ফুড সাইন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগের চারজন ছাত্র এ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে তাকে সহায়তা করেন। ডঃ মোঃ গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী জানান, কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহারের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ধারাবাহিকতায় এ বছর আমরা দই, পুষ্টিকর আইসক্রিম, চকলেট এবং চিজ তৈরীর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছি । সবচেয়ে বড় বিষয় হল, এগুলো তৈরী করতে দুধের সাথে শুধুমাত্র কাঁঠালের পাল্প প্রয়োজন। এক্ষেত্রে যদি কোন উদ্যোক্তা কাঁঠালের পাল্প সংরক্ষণ করেন, তবে সেগুলো দিয়ে সারা বছরই এসব পণ্য উৎপাদন করতে পারবেন। কাঁঠাল যেহেতু নানা পুষ্টিগুনে সমৃদ্ধ একটি ফল, কাজেই পাল্প দিয়ে তৈরী করা পণ্যও সাধারণ বাজারের পণ্য থেকে অধিক পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত হবে। এখানে কোন অতিরিক্ত বা কৃত্রিম রং বা ফ্লেভার ব্যবহার করা হয় না। পণ্যগুলো সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরী এবং দেখতেও খুবই সুন্দর। তিনি জানান, দই তৈরীতে শতকরা ৩ - ৫ ভাগ পাল্প ব্যবহার করা হয় । আইসক্রিম তৈরীতে ব্যবহার করা হয় ৫ - ৮ ভাগ পাল্প। আর চিজ তৈরীতে ৫০ - ৬০ ভাগ পাল্প ব্যবহার করতে হয়। ফলে ক্ষুধা নিবারণ ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে এসব পণ্য আদর্শ পণ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে নিঃসন্দেহে। তৈরিকৃত খাদ্যগুলো থেকে প্রচুর পরিমানে ক্যালরী পাওয়া যাবে। ড. চৌধুরী আরোও জানান, যে কেউ স্বল্প টাকা বিনিয়োগ করে এগুলি তৈরী করতে পারবেন। এসব তৈরী করতে তেমন বড় ধরনের কোন যন্ত্রপাতির দরকার নেই। একটি ডিপ ফ্রিজ, রেফ্রিজারেটর বা ছোট খাটো কিছু হোম মেড যন্ত্রপাতি দিয়েই এসব পণ্য খুব সহজেই তৈরী করা যাবে। যদি কোন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ৮০০ টাকার কাঁচামাল ব্যবহার করেন, তাহলে তিনি খুব সহজেই ১৫০০ টাকার পণ্য তৈরী করতে পারবেন। অর্থ্যাৎ বিনিয়োগের দ্বিগুন লাভ করতে পারবেন। আর দেশের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান যদি ব্যাপক পরিসরে আমাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসব পণ্য তৈরি করেন, তাহলেও দেশে এ সকল পণ্যের ব্যাপক বাজার তৈরী হবে। পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানী করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ড. ফেরদৌস জানান, কাঁঠাল দিয়ে বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পর এর পাল্প দিয়ে সারা বছর ব্যবহার করা যায় এমন কি পণ্য উৎপন্ন করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে থাকি। যেহেতু প্রতি বছর পাকা কাঁঠালই বেশী নষ্ট হয়, কাজেই পাকা কাঁঠাল থেকে পাল্প সংগ্রহ করে তা সহজেই সারা বছর অতি সহজেই সংরক্ষণ করা যায়। এ চিন্তা থেকেই দই, আইসক্রিম, চকলেট এবং চিজ তৈরীর পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয় এবং সফলতাও আসে। ইতিমধ্যে আমাদের এখানে চট্টগ্রামের ভেটেরিনারী এন্ড এনিমেল সাইন্স ইউনিভারসিটির ফুড সাইন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগের চারজন ছাত্র সমীক কর প্রান্ত, আবির হাসান রিজন, অভিক চাকমা ও আসম রাফসানজানি, তাদের একাডেমিক কোর্স শেষ করে ট্রেনিং করতে আসে। তাদেরকে এ কাজে সম্পৃক্ত করি এবং সফলভাবে আমরা প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হই। যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর কাঁঠাল উৎপন্ন হয়, কাজেই তারা যদি এসব প্রযুক্তি ঐ এলাকায় ছড়িয়ে দিতে পারেন, তাহলে সেখান থেকেও কাঁঠাল চাষী, উদ্যোক্তা বা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা লাভবান হতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। বারি’র পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান কৃষিবিদ মোঃ হাফিজুল হক খান জানান, প্রতি বছর আমাদের দেশে বিপুল পরিমান কাঁঠাল নষ্ট হয়। অপচয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে কাঁঠালের বহুবিধ ব্যবহারের এসব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে আমরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারব। দই, আইসক্রিমসহ যে সব পণ্য উৎপন্ন করা হয়েছে, তা পুষ্টিকর, স্বাস্থ্যসম্মত ও লাভজনক হবে। আমরা যদি এ সেক্টরে প্রশিক্ষিত লোকবল তৈরী করতে পারি, তাহলে এর ব্যাপক বাণিজ্যিক স¤ভাবনা তৈরি হবে যা কাঁঠালের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতেও বিরাট অবদান রাখবে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পুষ্ঠি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়। এর আগে পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের বিজ্ঞানীরা কাঁঠাল দিয়ে চিপস্, আচার, কাটলেট, জ্যাম, জেলীসহ প্রায় ২০টি পণ্যের উপকরণ ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছিল, যা তরুন উদ্যোক্তাদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ ও সাড়া জেগেছিল। এসব পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে অনেক উদ্যোক্তাই ইতিমধ্যে স্বাবলম্বি হয়ে উঠতে শুরু করেছে। শুধু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাই নয়, বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানও এসব পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ বা দেশের বাইরে রপ্তানী করতে আগ্রহী হয়ে উঠে বলে জানা যায়। বারি’র পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ জানায়, প্রতি বছর দেশে উৎপাদিত মোট কাঁঠালের ৪৩-৪৫ ভাগ শুধুমাত্র প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায় । দেশের জাতীয় ফলের এ অপচয় রোধকল্পে কৃষি গবেষনা ফাউন্ডেশন হাতে নেয় পোস্টহারভেস্ট ম্যানেজমেন্ট, প্রসেসিং এন্ড মার্কেটিং অব জেকফ্রুট নামে একটি গবেষণা প্রকল্প। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করতে থাকে কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহারের নানা উপকরণ ও প্রযুক্তি যাতে উদ্যোক্তারা সারা বছরই বিভিন্ন পণ্য তৈরিতে কাঁঠালকে ব্যবহার করতে পারে। কাঁঠালের অপচয় রোধ,কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, উদ্যোক্তা তৈরী, বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাঁঠালের পণ্যের বড় ধরনের উৎপাদন কর্মের মাধ্যমে এটাকে শিল্পের মর্যাদা প্রদান, ব্যাপক কর্মক্ষেত্রের ব্যবস্থা, সর্বোপরি কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশীক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার উদ্দেশ্যে উক্ত প্রকল্পের মাধ্যমে একের পর এক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে ডঃ মোঃ গোলাম ফেরদৌস চৌধুরীর নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা। তারা কাঁচা কাঁঠাল ও পাকা কাঁঠালের যেসব প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য উদ্ভাবন করেছেন যা দেশের বড় বড় সুপার শপে বিক্রি হচ্ছে বলে জানা যায় এবং ভোক্তা পর্যায়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে। গত বছর ঢাকার কাওলার আছমা বেগম মিনা বাজারে ৩-৪ লক্ষ টাকার শুধু ফ্রেশ-কাট কাঁচা কাঁঠালই বিক্রয় করেন এবং মার্কেটে ব্যাপক চাহিদা অনুযায়ী কভিড-১৯ এর কারণে পুরো সরবরাহ করতে পারেন নি। কাঁঠালের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ধারাবাহিকতায় এবার তারা পাকা কাঁঠালের পাল্প দিয়ে মুখরোচক দই, পুষ্টিকর আইসক্রিম, চকলেট এবং চিজ তৈরির উপকরণ ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের ধারনা, খুব স্বল্প মূলধন বিনিয়োগে উদ্যোক্তারা এসব পণ্য নিয়ে কাজ করলে তারা সহজেই খুব বেশী লাভবান হতে পারবে এবং সারা বছরই তৈরি করতে সক্ষম হবে।
×