ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বিনিয়োগ প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০০:৫৭, ৫ ডিসেম্বর ২০২১

কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বিনিয়োগ প্রয়োজন

বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে খাদ্যশস্য ও ধান উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে । প্রতি বছর দেশে দশমিক ৪৩ শতাংশ হারে কৃষিজমি কমলেও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেড়েছে চালের উৎপাদন। কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে চাল উৎপাদন বাড়লেও এর প্রবৃদ্ধির হার কমে এসেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে উৎপাদন না বাড়ায় চাল আমদানিও বাড়াতে হচ্ছে। একরপ্রতি উৎপাদনও সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এ অবস্থায় টেকসই উন্নয়নের জন্য গতিশীল কৃষির প্রয়োজন। জমির স্বল্পতার কারণে প্রান্তিক ক্ষুদ্র শ্রেণীর কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে। তারাই এখন দেশের খাদ্য নিরাপত্তার একমাত্র ভরসাস্থল, যারা একখ- জমিকে আঁকড়ে ধরে আছে। তাদের জমিতে যথাযথ প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটালে টেকসই কৃষি উৎপাদন সম্ভব। তার জন্য প্রয়োজন টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য ভর্তুকিতে কৃষিযন্ত্র বিতরণের লক্ষ্যে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়। ২০২৫ সালের মধ্যে এর সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের ৬৪টি জেলার প্রায় সব উপজেলায় কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। এ কথা সত্য, ভর্তুকি সুবিধাসহ আধুনিক যন্ত্রনির্ভর কৃষি প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে পৌঁছানো ও টেকসই কৃষি যান্ত্রিকীকরণ আক্ষরিক অর্থেই কঠিন একটি কাজ এবং এটি নিশ্চিতের জন্য আরও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ প্রয়োজন। না হলে ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ও তা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য কৃষি সরঞ্জাম, হস্ত ও শক্তিচালিত যন্ত্রপাতির কার্যকর ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি শ্রমিকের কর্মদক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ে প্রচলিত শ্রমিকের মাধ্যমে পরিচালিত অনেক কৃষিকাজ শক্তিচালিত কৃষি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। তবে এর গতি আরও বাড়াতে হবে। কৃষিকাজের আধুনিকীকরণ কৃষি যান্ত্রিকীকরণের উন্নয়নের ওপর নির্ভর করে, যা কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ চারা রোপণ, পরিচর্যা, ফসল সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ও মূল্য সংযোজনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত সব প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কার্যকারিতা ও উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ভূমিকা অপরিসীম। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ বলতে কেবল কৃষি যন্ত্রপাতি বিকাশের অগ্রগতিকেই বোঝায় না; বরং এটি কৃষির পরিবেশ, কৃষির মান, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার মতো অনেক বিষয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। এটি গতিশীল, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি যন্ত্রপাতির বিকাশ, উদ্ভাবন ও ব্যবহারের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সঙ্গে প্রধানত ট্রাক্টর ও মেশিনারি সম্পৃক্ত থাকলেও অন্যান্য ইনপুট যেমন উৎপাদন, নির্বাচন, বিতরণ, ব্যবহার, মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও কৃষি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং তাদের পরিচালনায় বীজ, সার, পানি, কৃষি শ্রমিক এমনকি কৃষি মৌসুম ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। বাংলাদেশের কৃষি যান্ত্রিকীকরণের চিত্র হলো জমি চাষে ৯৫ ভাগ, সেচ ব্যবস্থায় ৯৫, ফসল তোলা বা হারভেস্টে ১ দশমিক ৫, ধান মাড়াইয়ে ৯৫, রোপণে দশমিক ৫ ভাগেরও কম। মূল সঙ্কটের জায়গাটি এখানেই। ফসল উৎপাদন-পূর্ববর্তী যান্ত্রিকীকরণে যে অগ্রগতি অর্জন করেছি, উৎপাদন ও তার পরবর্তী প্রক্রিয়াকরণে পিছিয়ে থাকায় আমাদের বিপুল পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। জমি চাষ, মাড়াই ও সেচের ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ যান্ত্রিকীকরণ হলেও সিডার, হারভেস্ট ও সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ ততটা হয়নি। এর মূল কারণ হলো, চাষ, মাড়াই ও সেচের জন্য যে ধরনের যন্ত্র ব্যবহৃত হয়, সেগুলো টেকনোলজি বেজড। আর সিডার, হারভেস্ট ও কীটনাশক বা সার প্রয়োগের জন্য যে যন্ত্রগুলো রয়েছে তা টেকনোলজির পাশাপাশি নলেজ বেজড। ফলে যন্ত্র ব্যবহারে যন্ত্রের পেছনে থাকা মানুষটিরও কিছুটা দক্ষতা অর্জনের বিষয় আছে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষককে দক্ষ করে তুলতে পারলে ওই যন্ত্রগুলোও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে, ব্যবহার বাড়বে। মাছ চাষ, দুগ্ধখামার কিংবা পোলট্রি শিল্পেও বিশ্বব্যাপী বহুবিধ যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে। যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে বলেই এসব খাতে অনেক বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করা গেছে। একই সঙ্গে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষতিও কমানো সম্ভব হয়েছে। এক সময় কৃষিযন্ত্রের কথা শুনলে আমাদের দেশের কৃষি শ্রমিকরা আঁতকে উঠতেন। তারা ভাবতেন যন্ত্র এসে তাদের কাজটুকু কেড়ে নেবে। এখন আর সেই দিন নেই। এখন একটি কৃষিযন্ত্র গ্রামের একজন তরুণের নিরাপদ কর্মসংস্থান। আধুনিক চাষ পদ্ধতির সঙ্গে টিকে থাকতে মান্ধাতা আমলের ধ্যানধারণা দিয়ে সম্ভব নয়। এটি সবাই বুঝে গেছে। সময়ের বিবর্তনে কাজেরও বহু ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এখন কৃষি শ্রমিকেরও তীব্র সঙ্কট তৈরি হয়েছে। কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণেও কৃষি হয়ে উঠেছে ব্যয়বহুল। এর সমাধান আসতে পারে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমেই। ধান, গম, আলু, ভুট্টাসহ নানা রকম সবজি ও ফলের পাশাপাশি মৎস্য, পোলট্রি ও ডেইরি শিল্পেও আমাদের কৃষক ও খামারিরা বিপ্লব ঘটিয়েছেন। কৃষি খাতে সরকারের আন্তরিকতা, সমন্বিত উদ্যোগ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণে নেয়া প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও খাদ্যনিরাপত্তায় বড় ধরনের অগ্রগতি নিশ্চিত করবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা নিশ্চিত করা। প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন সময়ের দাবি। প্রকল্পটি যাতে যথাসময়ে সম্পন্ন হয় এবং কোন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি না হয়, এ ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয়। করোনাকাল কতদিন স্থায়ী হবে তা এখনও অনিশ্চিত। মনে রাখা দরকার, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার মধ্যে কৃষিই হচ্ছে আমাদের অর্থনীতি এবং টিকে থাকার মূল শক্তি। সমন্বিত আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়ায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনীতি ডেস্ক
×