ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাণিজ্য ভারসাম্যে স্বস্তি

প্রকাশিত: ০০:৫৭, ৫ ডিসেম্বর ২০২১

বাণিজ্য ভারসাম্যে স্বস্তি

বাংলাদেশের অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গত প্রায় দেড় বছর অর্থনীতিতে ছিল শ্লথ গতি। চলমান গতিশীলতা পুনরায় মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করছে। একইসঙ্গে অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি বাণিজ্য ভারসাম্যকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করছে। বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি। আমদানি-রফতানির ব্যবধান বা বাণিজ্য ঘাটতি নিরসনে রফতানি বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু রফতানির ক্ষেত্রে রয়েছে নানা ধরনের প্রতিকূলতা। এ জন্য কাক্সিক্ষত মাত্রায় এ রফতানি বাড়ছে না। পরিবর্তনশীল এই রফতানি বাণিজ্য নিয়ে জনকণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেছেন রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-এর ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসান। রফতানি বাড়াতে পণ্যের বহুমুখীকরণ ও বাজার অন্বেষণে আপনাদের পরিকল্পনা কি? উত্তরে জনাব আহসান বলেন, ‘রফতানি বাড়াতে পণ্যের বহুমুখীকরণে আমরা কাজ করছি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি নন ট্রেডিশনাল আইটেম যেমন বাইসাইকেল। দেখা গেল বেলজিয়ামে বাইসাইকেলের ভাল চাহিদা, ভাল মার্কেট আমরা সেটাকে নিয়ে বিশ্লেষণ করি। আবার সেখানে মেলা হলে আমরা বাংলাদেশ থেকে বাইসাইকেল উৎপাদনকারীদের মেলায় অংশগ্রহনের সুযোগ তৈরি করে দেই। তাদের সে সব দেশে বাণিজ্য সুবিধা পেতে সহায়তা করি। তিনি আরও বলেছেন, ‘বিশ্ব বাণিজ্যের গতি প্রকৃতির সঙ্গে আমরা সর্বদাই সামঞ্জস্য রেখে চলি। এক্ষেত্রে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের গুণগত মান তুলে ধরা এবং নতুন মার্কেট খোঁজার চেষ্টা করি। মূলত বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মূল কাজটি করে আমরা তাদের সাপোর্ট হিসেবে থাকি। বাংলাদেশের পণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কেটিং করার চেষ্টা করি। ইপিবির একটি প্রধান কাজ হলো- আন্তর্জাতিক যেসব মেলা হয় সেখানে বাংলাদেশের রফতানি কারকদের নিয়ে যাওয়া। বিভিন্ন পণ্যের সঙ্গে পরিচিত করা এবং মার্কেটের সঙ্গে পরিচিত করানো। মূলত রফতানিনীতি প্রণয়ন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমরা তা বাস্তবায়নে সহায়তা করি। ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি নিরসনে আপনাদের কি পরিকল্পনা? এএইচএম আহসান বললেন, বাণিজ্য ঘাটতি কমানো আমাদের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু দেশে প্রাথমিক পণ্য বা কাঁচামালের অভাবে রফতানির তুলনায় আমদানি বেড়ে যায়। যেমন তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে যদি কাঁচামাল আমদানি না করা হতো তবে গার্মেন্টস শিল্প থেকে রফতানির পরিমাণ দ্বিগুণ হতো। আবার আমদানিকৃত কাঁচামাল বা মেশিনারিজ পণ্য কাজে লাগিয়ে শিল্পের উৎপাদন বাড়ে। তাই সব সময় বাণিজ্য ঘাটতিকে খারাপ বলা যাবে না। কিছু ইমপোর্ট ইকোনমির জন্য ভাল। দেশে প্রাথমিক পণ্য আমদানির পরিমাণ কিভাবে কমানো যায়? উত্তরে বললেন, ‘এটা ইপিবির পরবর্তী পদক্ষেপ। এক্ষেত্রে উৎপাদনকারী শিল্পগুলোকে আরও উন্নত করতে হবে। ইতোমধ্যে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান অনেক ভাল অবস্থানে গিয়েছে। একটা সময় একটি শিল্পের সবকিছুই বিদেশ থেকে আনতে হতো। আমরা শুধু লেবার দিতাম। এখন পরিবর্তন এসেছে রফতানি নীতির মাধ্যমে তাদের সহায়তা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে কি পরিমাণ পণ্য রফতানি হচ্ছে? তিনি বললেন, ‘বর্তমানে ৭৫০-এর অধিক পণ্য রফতানি হচ্ছে।’ এক্ষেত্রে কোন সমস্যা? ‘ রফতানিতে কোন সমস্যা নেই তবে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে টিকে থাকতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। আমরা যে পণ্য তৈরি করি তা পার্শ¦বর্তী দেশও তৈরি করে সুতরাং একজন বায়ার এদেশের পণ্য তখন নেবে যখন অন্য দেশের তুলনায় ভাল এবং তুলনামূলক কমদামে দেয়া যাবে। এই জায়গায় আমরা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে এই চ্যালেঞ্জ নিতে পুরোপুরি সক্ষম হয়েছি। অন্যান্য প্রডাক্টের ক্ষেত্রে এখনও পিছিয়ে আছে। বিশেষ করে গুনগতমান এবং প্রযুক্তির দিক থেকে। ভালোমানের পণ্য তৈরি করতে হলে হাই টেকনোলজি প্রয়োজন এক্ষেত্রে আমাদের ঘাটতি রয়েছে। ভাল প্রযুক্তি দিয়ে উন্নত মানের পণ্য তৈরি করতে যে বিনিয়োগ প্রয়োজন সেটা অনেক উদ্যোক্তার পক্ষে সম্ভব হয় না। এই সমস্যা সমাধানে প্লাস্টিক, পাট, তৈরি পোশাক ও লেদার এই চারটি সেক্টর নিয়ে আমরা কাজ করছি। এগুলোর মান যদি বাড়াতে পারি তাহলে সহজেই অন্যদেশে ভাল বাজার তৈরি করতে পারবো।’ সম্ভাব্য আর কিকি রফতানি পণ্য আছে যা নিয়ে আপনি আশাবাদী? যা বললেন,‘ দুই ধরনের পণ্য রফতানি হয় ট্রেডিশনাল ও নন ট্রেডিশনাল। নন ট্রেডিশনাল পণ্যের ভলিউম অনেক কম তা দিয়ে বেশি আগানো যায় না। যেমন হস্তশিল্প ১০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি করা অনেক কঠিন। এর চাহিদা থাকলেও প্রতিটি পণ্যের মূল্য কম থাকায় অনেক এক্সপোর্ট প্রয়োজন। এখন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে দুটি বিষয়কে কৃষিপ্রক্রিয়াজাত শিল্প এবং বৈচিত্র্যময় পাট পণ্যে। কাঁচাপাট রফতানি না করে পাটপণ্য রফতানি করা। বস্তা ছাড়াও ব্যাগ, জুতা, শোপিছ সহ অন্যান্য যেসব পণ্য আছে সেগুলোর ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।’ চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা রফতানি আয় ৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পূরণে আপনি কতটা আশাবাদী? এএইচএম আহসান বললেন,‘ আমি সম্পূর্ণ আশাবাদী। গত দুই মাসের যে তথ্য আছে, আগামীতে এভাবে চললে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে বলে আমি আশা করছি।’ স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি থেকে উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত? তিনি বললেন, ‘উত্তরণ হলে অনেক দেশে শুল্ক মুক্ত রফতানি করা যেত তা আর সম্ভব হবে না। তবে এ সুবিধা কিছু দেশে পাওয়া যাবে ২০২৬ এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে বন্ধ হবে ২০২৯ সালে। সেই হিসেবে আমাদের এখনও সময় আছে প্রস্তুতি নেবার । এটা নিয়ে মন্ত্রণালয়, ইআরডি সমন্বিত কাজ করছে । যে চ্যালেঞ্জগুলো আসবে সেগুলো কিভাবে অতিক্রম করা হবে।’ আসছে বছরে রফতানিতে নতুন কোন কাজের পরিকল্পনা রয়েছে যা ২০২১ এ হয়নি? তিনি বললেন, ‘ আমাদের হিসাব-নিকাশ হয় অর্থবছর থেকে অর্থবছর। তবে রফতানি বাড়াতে আমরা যে মূল কাজ করি বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণ করা। করোনাকালীন এই কাজটা আগের মতো করা যায়নি। যেসব মেলায় অংশগ্রহণ করেছে তা সবই ভার্চুয়াল ফেয়ার। অনলাইন ফেয়ার একটি নতুন মাত্রা। গত মাসে আমরাও একটি মেলা আয়োজন করেছিলাম ‘সোর্সিং বাংলাদেশ’। সেখানে বাংলাদেশী প্রায় ৬০-৭০টা কোম্পানি তাদের পণ্য নিয়ে এসেছিল এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বায়াররা সেটাতে অংশ গ্রহণ করেছিল। রফতানি বাড়াতে এমন অনেক কাজ হচ্ছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সেক্টরের সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা হচ্ছে। তারা যেসব সমস্যা তুলে ধরে। সেসব সমাধান করার চেষ্টা করছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সময়ে ১ হাজার ৭৩২ কোটি ১০ লাখ (১৭.৩২ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ১ হাজার ১৭৫ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। অন্যদিকে চলতি অর্থ-বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে ১ হাজার ৮১ কোটি ৮০ লাখ (১০.৮১ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি। এ হিসাবেই অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। আশার কথা হলো, বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ এখনও সন্তোষজনক অবস্থায় আছে। এ অবস্থায় আমদানি বাড়লেও কোন সমস্যা নেই। আর আমদানি বাড়া মানে বিনিয়োগ বাড়া। বিনিয়োগ বাড়া মানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। সামষ্টিক অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হওয়া। তাই করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমদানি বাড়তে শুরু করেছে। আর এতে বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বেড়েছে। রফতানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বে আমাদের একটা ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি হয়েছে। তাই বহুমুখী উদ্যোগের মাধ্যমে রফতানিকে সম্প্রসারণ করতে হবে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সবাই মিলে কাজ করলে এসব লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। রফতানি আয়ের প্রায় ৮২ শতাংশ তৈরি পোশাক শিল্প থেকে আসে। বৈচিত্র্য ও বহুমুখীকরণের মাধ্যমে রফতানি আয় বাড়াতে কর্তৃপক্ষ আরও জোরালো ভূমিকা রাখবে এটাই প্রত্যাশা। সব রফতানি পণ্যকে একই মানদ-ে রাখা প্রয়োজন। রফতানির বাধাগুলো দূর করার জন্য প্রযুক্তি ও অবকাঠামোসহ সব ক্ষেত্রে উন্নয়নমুখী কাজ আরও জোরদারভাবে করা সময়ের দাবি।
×