২৬ মার্চ, ১৯৭১। বিশ্বের বুকে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। বাংলার গণমানুষের হৃদয়ের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ’৭১-এর উত্তাল দিনগুলোতে অসম্ভব রাজনৈতিক মুনশিয়ানার সঙ্গে ধাপে ধাপে পা ফেলছিলেন। তিনি যে ধৈর্য ও প্রজ্ঞার সম্মিলন দেখিয়েছিলেন সেটা ছিল অভূতপূর্ব। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং টানা ২৪ দিন ধরে চলা সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন আর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে গণহত্যার দিকে এগিয়ে যায় পাকিস্তানী সামরিক জান্তা।
স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নিয়ে ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি সিডনি এইচ শ্যানবার্গকে দেয়া একটি সাক্ষাতকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি চট্টগ্রামে একটি গুপ্ত হেডকোয়ার্টারে ফোন করে স্বাধীনতার বার্তা পাঠিয়েছিলেন, যেটা পরবর্তী সময়ে গোপন ট্রান্সমিটার দ্বারা প্রচারিত হয়েছিল।’ এ ছাড়া ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাত ১২টা থেকে ১টার মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনারা তার বাড়ির ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। তিনি ড্রেসিংরুম থেকে বাইরে বের হয়ে আসেন এবং তাদের মুখোমুখি দাঁড়ান। পাকিস্তানী সেনাদের গুলি বন্ধ করতে বলেন এবং জিজ্ঞাসা করেন, কেন তারা গুলি করছে? যদি তারা তাকে গুলি করতে চায় সেটা করুক; কেন তারা অন্য মানুষ এবং বাচ্চাদের ওপর গুলি করছে? একজন মেজর পেছন থেকে গর্জন করে উঠে গুলি বন্ধ করতে বলেন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে জানান, তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
ইপিআরের শহীদ সুবেদার মেজর শওকত আলীর কন্যা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর সেলিনা পারভিনের সাক্ষাতকার থেকে জানা যায়, ২৫ মার্চ রাতে সুবেদার মেজর শওকত আলী পিলখানাতে অবস্থান করছিলেন। তার পরিবার রাজশাহীতে অবস্থান করছিল। তিনি ছিলেন সিগন্যাল কোরে বাঙালীদের মধ্যে সিনিয়র। আজিমপুর গেটে প্রহরারত সৈনিকের মারফত রাত ১০টার কিছু পরে তার কাছে মেসেজ আসে। তার সঙ্গে সে রাতে আরও দু-একজন ছিলেন। রাত সোয়া ১২টা বা তার কাছাকাছি কিছু সময় পরেই ওয়্যারলেস মেসেজ ট্রান্সমিটাররত অবস্থায় তিনি পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। প্রফেসর সেলিনা পারভিনের ভাষ্যে : সেই রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সুবেদার মেজর শওকত আলী যখন ট্রান্সমিট করছিলেন তখন তার সঙ্গে ছিলেন সিগন্যালম্যান আব্দুল মোত্তালিব। আব্দুল মোত্তালিব সেই বিরল সৌভাগ্যবানদের একজন, যিনি সেই রাতে শওকত আলীর সঙ্গে গ্রেফতার হয়েও বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষণা ট্রান্সমিশনে শওকত আলী ‘মোটোরোলা এসবিসি-৩’ সেট ব্যবহার করেন। এটি ইপিআর সিগন্যাল কোরে বল্ট্যাকসেট বলে জনপ্রিয়। সেটটিতে ভয়েস অপশন ও টিজি অপশন দুটোই রয়েছে। ‘২৫ র্মাচ রাতে চট্টগ্রামে সিগন্যালম্যান আবুল খায়ের ওয়্যারলেস সেট নিয়ে ডিউটিতে ছিলেন। উর্ধতন কর্মকর্তার নির্দেশে তিনি তার এসবিসি-৩ সেটে ভয়েস অপশন অফ করে রেখেছিলেন। রাত সাড়ে ১১টার কাছাকাছি তিনি তার সেটে টিজি (টেলিগ্রাফিক) অপশনে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি পান এবং মেসেজ আনকোড করে তৎকালীন কমান্ডার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামকে হস্তান্তর করেন। ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম মেসেজ প্রাপ্তিমাত্র তা চট্টগ্রামে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।’
স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনীর প্রধান লে. জেনারেল নিয়াজীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারী তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে ক্ষীণ স্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হলো পূর্বেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।’ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার হ্যান্ডবিল বিলি করা হয় রাজশাহী, খুলনা, সিলেটসহ বড় শহরগুলোতে।
স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। বিকাল সাড়ে ৫টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত টেলিভিশন চ্যানেল এবিসি নিউজেও চলে আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা। আকাশবাণীর রেডিও তরঙ্গে মধুর আশ্বাসবাণী, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।’ আকাশবাণী জানাল, পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ঢাকার আশপাশে, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, চট্টগ্রামে পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে বাঙালী মুক্তিফৌজের যুদ্ধ চলছে। রাতে বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকাও শোনাল একই বার্তা।
সকালে ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরের আদমজী কলেজ থেকে বন্দী অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্টাফ হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে সারাদিন আটকে রেখে সন্ধ্যায় অজ্ঞাত স্থাানে নিয়ে যাওয়া হয়। পাক হানাদার বাহিনী ঢাকায় দিন-রাত কার্ফু দিয়ে দলে দলে রাস্তায় নেমে ভবন, বস্তি ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের বাসভবনের ওপর ভারি মেশিনগান ও কামানের গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। এলাকার পর এলাকা আগুন লাগিয়ে ভয়ার্ত নর-নারী-শিশুকে অগ্নিদগ্ধ করে এবং গুলি করে হত্যা করা হয়। অবাঙালী নাগরিকদের সহযোগিতায় পাকসেনারা দুপুরে পুরান ঢাকা আক্রমণ করে এবং মধ্যরাত পর্যন্ত ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। পাক হানাদার বাহিনী দ্য পিপল, সংবাদ, ইত্তেফাক, বাংলার বাণী অফিস এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ট্যাঙ্কের গোলায় ধ্বংস করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একাধিক গণকবর খুঁড়ে সেখানে শত শত লাশ মাটিচাপা দিয়ে তার ওপর বুলডোজার চালায়। নগরীর বিভিন্ন স্থানে সারারাত ধরে হাজার হাজার লাশ মাটিচাপা দেয়া হয়। পুরান ঢাকায় নিহতদের লাশ বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়া হয়।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে সশস্ত্র যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে দেশের সর্বত্র চলে সশস্ত্র প্রতিরোধ। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হ্যান্ডবিল আকারে ইংরেজী ও বাংলায় ছাপিয়ে চট্টগ্রামে বিলি করা হয়। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে দুপুর ২টা ১০ মিনিটে, ২টা ৩০ মিনিটে এবং সান্ধ্য অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশকে সাহায্যের জন্য বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ ও রাষ্ট্রসমূহের প্রতি আহ্বান জানান। কুমিরার প্রতিরোধ যুদ্ধে সৈন্য বোঝাই তিনটি ট্রাকে আগুন ধরে যায়। প্রাণপণ লড়াই শেষে পাক আর্মিরা দুই ট্রাক অস্ত্রশস্ত্র ফেলে রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যায়। ২৬ মার্চের এই খন্ডযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার লে.কর্নেল শাহপুর খান বখতিয়ার ও একজন লেফটেন্যান্টসহ ১৫২ সাধারণ সৈনিক প্রাণ হারায়। সঙ্গে দুই ট্রাক এ্যামুনিশন মুক্তিযোদ্ধাদের কব্জায় আসে। ১৪ বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাতবরণ করেন। প্রথম প্রহরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ, ইপিআর বাঙালী সেনা ও গ্রামবাসী মিলে ক্যাম্পাস অবরুদ্ধ করে, যেন পাকিস্তানী সেনারা বিশ্ববিদ্যালয় দখলে নিতে না পারে। প্রশিক্ষিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের এই প্রতিরোধ চলে টানা ১০ দিন। ২৭ মার্চ ভারতীয় লোকসভায় ভাষণদানকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ প্রতিরোধ যুদ্ধ সম্পর্কে বলেন, পূর্ববঙ্গের সমগ্র জনগণ এক বাক্যে গণতান্ত্রিক কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে। একে আমরা অভিনন্দন জানাই। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ভারত সরকার পূর্ববঙ্গের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে সজাগ রয়েছে এবং যথাসময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
লেখক : গবেষক
[email protected]