ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

গণতান্ত্রিক সুশাসন নিশ্চিত করার পালা

প্রকাশিত: ২১:৩৮, ৪ ডিসেম্বর ২০২১

গণতান্ত্রিক সুশাসন নিশ্চিত করার পালা

ভাবতে বিস্ময় লাগে, আজ বিশাল লোভের কাছে বশীভূত সেই বাঙালী যারা, যাদের পূর্ব প্রজন্ম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বৈষম্যমূলক চরম ন্যায়-নীতিহীন নির্যাতন ও অপশাসনের সমাপ্তি টানতে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পর শেষ এক দফা- ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’-এ খালি হাতে যুদ্ধে যোগ দিতে লাখে লাখে পথে নেমেছিল। বোনেরা, মায়েরা ভাই ও পুত্রদের, স্বামীদের এগিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল- বিজয় না নিয়ে ফিরবে না। ইতিহাসের অপূর্ব সেই সময়টিতে না খেয়ে, না ঘুমিয়ে স্বদেশ-মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে যুদ্ধ করে তারা ত্রিশ লাখের বেশি প্রাণকে উৎসর্গ করে বিজয় ছিনিয়ে শত্রুমুক্ত স্বদেশে ফিরে নিজ নিজ কাজে যোগ দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ভারতের প্রবাসী নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধা, বাস্তুত্যাগী কোটি শরণার্থী দেশে ফিরেছিল। খুব দ্রুত বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করে ’৭২-এর নবেম্বর মাসেই সংবিধান প্রণয়ন করেন। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে, স্থানীয় নিরাপত্তা এবং কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনী গঠনে বিপুল কর্মকান্ড গ্রহণ করেন। বাদ যায়নি যুদ্ধাপরাধী দালাল-রাজাকারদের বিচার কাজও। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছর দিনরাত কর্মব্যস্ত বঙ্গবন্ধুর সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়া, যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হওয়া, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে মৌলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা এবং সবশেষে জাতীয় ঐক্য গঠনের লক্ষ্যে বাকশাল, যে দলে জিয়াউর রহমানসহ সেনা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে এক রাজনীতির ছত্রছায়ায় আনার লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক রীতির অনুসরণে গঠিত হওয়া সম্ভবত বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুদের বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নে মদদ যুগিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর প্রতি দায়বদ্ধতা যে মৃত্যু, সেটিও শত্রু দল প্রমাণ করেছিল জেলে বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহযোদ্ধা চার জাতীয় নেতাকে হত্যার মাধ্যমে। ফলে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধের সফলতার জন্য কাজ করা নেতাদের অনেককে হত্যাকারী দল অস্ত্রের মুখে মোশতাকের মন্ত্রিপরিষদে যোগ দিতে বাধ্য করেছিল। জেলহত্যা না হলে এই সম্মানীয় নেতৃবৃন্দ কখনও মোশতাকের সরকারে যোগ দিতেন না বলে বিশ্বাস করি। মনে করি তাদের মুক্তিযুদ্ধ ও এর আগের গৌরবময় অবদান জাতির স্মরণ রাখা উচিত। কেননা, তারাও ’৭৫ পূর্ববর্তী ইতিহাস রচনার অংশগ্রহণকারী কর্মী ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের যে প্রতিষ্ঠা ’৭২-এ সূচিত হয় তার গোড়া কর্তন শুরু হয় ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট, ৩ নবেম্বর, ৭ নবেম্বর। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে স্বৈরাচারী সেনাশাসক জিয়া, এরশাদ ও খালেদা এবং খালেদা-নিজামী-তারেকের শাসনকালেও। বর্তমানে অর্থাৎ ২০০৮ ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐক্যজোট গঠন করে বিপুলভাবে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে জোটের প্রধান ম্যান্ডেট- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার খালেদা-মওদুদ কর্তৃক আটকে থাকা বিচার সম্পন্ন করে ’৭৫-এর খুনীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দান। বলা বাহুল্য, সুশাসনের একটি অন্যতম প্রমাণ- অপরাধীদের বিচার ও দ- প্রদান, সেটি শুরু হয় ২০০৯-এ। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা গণতন্ত্র ও সুশাসনের অন্যতম শর্ত। এ লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে বয়স্ক, মুক্তিযোদ্ধা, বিধবা, প্রতিবন্ধী, শিক্ষাবৃত্তি, উপবৃত্তি, হিজড়া প্রভৃতি শ্রেণীকে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। এদিকে খাল, নদী দখলমুক্ত করার কাজও শুরু করা হলো। দুর্নীতি কমাতে সরকারী কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি হলো। ডিজিটাল করা হলো নানা ক্ষেত্রের কর প্রদান, ক্রয়-বিক্রয়, অর্থ স্থানান্তের প্রক্রিয়া। কিন্তু সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন দ্রুত গতিতে ঘটলেও গণতন্ত্র ও সুশাসনের কতগুলো সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে, যা গভীর মনোযোগ ও দৃঢ় পদক্ষেপ দাবি করে। সীমাহীন লোভের উত্থান, নারী-শিশু নির্যাতন-হত্যা-ধর্ষণ, রাজপথে-নৌপথের উচ্চমাত্রার দুর্ঘটনায় শিশু-তরুণের প্রাণহানি এবং সর্বোপরি সবকিছু প্রধানমন্ত্রী বা নেত্রীকেন্দ্রিক হয়ে ওঠা, মন্ত্রীদের নিজস্ব দক্ষতা-যোগ্যতা-আস্থা হ্রাস পাওয়া এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভুল ব্যবহার করার বিষয়টিতে উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। তাছাড়াও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস করা না গেলে ক্রমান্বয়ে কমতে থাকা কৃষি জমি খাদ্য সঙ্কট তৈরি করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে সরকারকে আরও উন্নয়ন ঘটাতে হবে। নতুবা বর্তমান বিশ্বের ডিজিটাল দুনিয়ায় যেখানে ইন্টারনেটে হাজার রাজার ব্যক্তির ‘হেইট স্পিচ’ বা ঘৃণা প্রচারকারী বক্তব্য, মন্তব্য প্রচার হচ্ছে, সেখানে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সব মন্ত্রী, সাংসদ, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীকে সমালোচনার পাত্র হতে হয়- এটাই গণতন্ত্রের এবং বাক-স্বাধীনতার প্রমাণ। তবে প্রত্যেক দেশ ও রাষ্ট্রের কিছু স্মরণীয় ব্যক্তি ও বিষয় নিয়ে বক্তব্য প্রদান নিষিদ্ধ থাকে। যেমন- জার্মানিতে নাজি পার্টি নিষিদ্ধ, কেউ ‘হলোকস্ট’ অস্বীকার করতে পারবে না, কোন ব্যক্তি হিটলারের প্রশংসা করতে পারবে না, তেমনি বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধকে অসম্মান করতে পারবে না, ’৭১-এর ২৫ মার্চের ‘জেনোসাইড’কে অস্বীকার করতে পারবে না, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস হিসেবে মান্য হবে। জনগণ দেখতে চায় প্রত্যেক মন্ত্রী, প্রত্যেক সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, প্রশাসক, জনপ্রতিনিধি নিজেদের ‘জনগণের সেবক’ হিসেবে গণ্য করে এলাকার, দেশের জনগণের কল্যাণে কাজ করবে। প্রধানমন্ত্রী কথাটা প্রায়ই স্মরণ করিয়ে দেন। কার্যত সেটি খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। আর যাই হোক, সরকারী কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের জনগণের সেবক গণ্য করলে স্থানীয় নির্বাচনে এত সহিংসতা, মারামারি হতো না। এত জমি, নদী, বন দখলদারের আধিপত্যে যেত না। সাধারণ জনগণ বর্তমানে চাল-আটা-ডাল-ভোজ্য তেলের দাম, বাস ভাড়া বৃদ্ধির ফলে কষ্টে আছে। চা শ্রমিকরা কি আমাদের মতো মানুষ নয়? তাদের বেতন বা মজুরি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-চিকিৎসা কিভাবে চলবে? তাদের মজুরি বাড়াতে সরকারকে অনুরোধ করব নীতিমালা প্রণয়নের জন্য, যা চা কোম্পানিগুলো মানতে বাধ্য হবে। টিসিবির আওতা, পণ্যের পরিমাণ আরও ‘বাড়ানোর’ কোন বিকল্প নেই। বাস ভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে হবে। ছাত্রদের পরিবহনে কনসেশন সব দেশে আছে। আমরা এডিনবরায় পড়াকালে ছাত্রদের মাসিক বাস টিকেট কাটতাম। মনে আছে রেলেও কনসেশন ছিল। কল্যাণ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলো ক্রমশ অর্জন করতে হবে। মানিলন্ডারিং তো একটি বাস্তব ঘটনা। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তিনি জানেন না কারা করে, তালিকা চেয়েছেন। এটা ভাল প্রতিক্রিয়া কি? তালিকা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিগত অর্থমন্ত্রীও কানাডার ‘বেগম পাড়ার’ মালিকদের কথা উল্লেখ করেছিলেন। দুর্নীতি ও মানিলন্ডারিং ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ দুটি বন্ধ করতে কাজ করতে হবে অবশ্যই। যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি হচ্ছে। ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল এবং রাজপথের বাসগুলোর সার্ভিস উন্নত করা অত্যাবশক। ঢাকা শহরকে ধুলাবালি, কন্সট্রাকশনমুক্ত করা দরকার। এগুলোতে উন্নতি করা গেলে গণতন্ত্র ও সুশাসনের সীমাবদ্ধতা হ্রাস পাবে। দেশ আরও গণতান্ত্রিক হবে, সুশাসন ও মানবাধিকারও নিশ্চিত হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×