ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. নিজামউদ্দিন জামি

ষাটের সাহিত্য পত্রিকা ও আড্ডায় আমিনুল ইসলাম বেদু

প্রকাশিত: ২৩:৫৪, ৩ ডিসেম্বর ২০২১

ষাটের সাহিত্য পত্রিকা ও আড্ডায় আমিনুল ইসলাম বেদু

উত্তাল ষাটের দশকে অনেকগুলো পত্রিকা প্রকাশিত হয়। দ্রোহী যৌবনের দূততুল্য তিনটি সাহিত্যগোষ্ঠী তখন ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। পত্রিকাগুলো হচ্ছে সাম্প্রতিক (১৯৬৩), স্বাক্ষর (১৯৬৪) ও কণ্ঠস্বর (১৯৬৫)। সেই তিন সাহিত্য পত্রিকা ও আড্ডার সাতকাহন নিয়ে ‘প্রসঙ্গ কথা’ শিরোনামে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রকাশ করেন খ্যাতিমান লেখক ও সাংবাদিক সাংস্কৃতিক সংগঠক আমিনুল ইসলাম বেদু। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আবদুল মান্নান সৈয়দ ও আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ভাষ্যে বইটি পরিকল্পিত ও গঠিত। পরিশিষ্টে আছে আরও তিনটি লেখা (রচয়িতা-বুদ্ধদেব বসু, সন্দ্বীপ দত্ত ও শিবনারায়ণ রায়)। গ্রন্থটির উৎসর্গপত্রে লেখা আছে, ‘আমার নিত্য দিবারাত্রির সাথী-সতীর্থ ‘সাম্প্রতিক’ ছিল যাঁদের প্রাণের প্রদীপ-সেই সব আমার অকালপ্রয়াত বন্ধু সহচর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (মঞ্জু), আবদুল মান্নান সৈয়দ, জাকারিয়া শিরাজী (জ্যাক শিরাজী), মফিজুল আলমকে আমার হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসায় উৎসর্গ করে তৃপ্ত হলাম।’ বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ৪০০ টাকা। প্রকাশ করেছে প্রকাশনা সংস্থা সাম্প্রতিক। আলোচ্যবিষয় বা সূচীটাও একনজরে দেখে নেয়া যাক। আমার স্মৃতিপটে আঁকা কিছু অগোছাল কথা। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মনে হঠাৎ অসূয়ার আবির্ভাব। সাম্প্রতিক সাহিত্য পত্রিকার আড্ডা ও সাম্প্রতিক প্রসঙ্গে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাষ্য। সাহিত্য সৃজনে আড্ডার প্রসঙ্গ। আড্ডার কথা। সাম্প্রতিক এর পূর্বকথা। সাম্প্রতিক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বেদুর ৭৮তম জন্মপূর্তি। সাহিত্য সৃষ্টিতে বাংলা সাময়িকপত্রের ভূমিকা। এরপর পরিশেষ্টে আছে সাহিত্যপত্র প্রসঙ্গ, লিটল ম্যাগাজিন ভাবনা ও লিটল ম্যাগাজিন অভিযাত্রা সাহিত্যপত্র। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যাড্ডা সম্পর্কে বলেন- ‘আড্ডা সময়ের অপচয় নয়, আড্ডা বুদ্ধিমত্তা, বিকাশ ও মানুষে মানুষে ভালবাসার সোপান।’ আড্ডা একপ্রাণ থেকে অন্যপ্রাণে মধুসিঞ্চন করে। আড্ডা শিল্প-সাহিত্যের প্রায় অনিবার্য একটি অধ্যায়। এর বাইরেও আড্ডার গুরুত্ব বিদ্যমান। আড্ডায় মানুষ নিজেকেই ঝালাই এ যাচাই করে নিতে পারে। অনেক সময় বই পড়েও যা উপলব্ধ হয় না, আড্ডায় তা পূর্ণতা পায়। আড্ডায় জ্ঞান ভাগাভাগি হয়। বাংলা ভাষা-সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতিতে আড্ডার গুরুত্ব অপরিসীম। ষাটের দশকের সে তিনটি পত্রিকার তিনটি প্রকাশসনকে (১৯৬৩, ১৯৬৪ ও ১৯৬৫) আমিনুল ইসলাম বেদু তিনিটি সিঁড়ির সঙ্গে তুলনা করেছেন। ষাদের দশকের সাহিত্যান্দোলনে পত্রিকাগুলো সত্যি সিঁড়ির মতোই পথ সৃষ্টি করেছিল। এ জাতীয় সাহিত্যপত্রকে ক্ষেত্রবিশেষে লিটল ম্যাগাজিনও বলা হয়। লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্র সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু বলেন, ‘জনপ্রিয়তার কলঙ্ক একে কখনও ছোঁবে না।...এটি কখনও মন যোগাতে চায়নি, মনকে জাগাতে চেয়েছে।’ তিনি আরও বলেছেন, এক্ষেত্রে চেষ্টা করেও কাটতি বাড়ানো যাবে না। টিকে থাকা শক্ত হবে। আকারে মোটাসোটা হওয়ার সম্ভাবনা নাই, লিটল ম্যাগাজিন সময়ের সেবা করে না, সময়কে সৃষ্টি করার চেষ্টা করে ইত্যাদি। শিবনারায়ণ রায় লিটল ম্যাগাজিনের গতানুগতিক বৈশিষ্ট্যের পরও কমপক্ষে আরও পাঁচটি বিশেষত্ব বা শর্তজুড়ে দিয়েছেন। সে পত্রিকা দিয়ে ব্যবসা হবে না, গণমনোরঞ্জন হবে না, রাজনৈতিক দল কর্তৃক পরিচালিত হবে না, পেশাদার গোষ্ঠী বা সংগঠনের মুখপত্র হবে না, বিজ্ঞাপনের আয় কিংবা খ্যাতিমান লেখকের করুণাসজ্ঞাত রচনাদির ওপর নির্ভর করবে না। তিনি (শিবনারায়ণ রায়) লিটল ম্যাগাজিনের উদ্ভব সম্পর্কে বলেছেন, ‘গতানুগতিক নয়, জনপ্রিয় নয়, সাফল্যকাক্সক্ষী নয়, পৃষ্ঠপোষণলোলুপ নয়, একেবারে নিজস্ব, মৌলিক কিছু কথা অভিনবরূপে প্রকাশ করবার তীব্র অভীপ্সা থেকেই লিটল ম্যাগাজিনের উদ্ভব।’ (শিবনারায়ণ রায়, লিটল ম্যাগাজিন: অভিযাত্রা সাহিত্যপত্র, পরিশিষ্ট-৩) বিদেশে নির্বাচিত কিছু লিটল ম্যাগাজিনকে বিভিন্ন ফাউন্ডেশন, আর্টস কাউন্সিল, বিশ^বিদ্যালয় প্রভৃতি কিছু কিছু অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে। আমাদের দেশে অনুগত সাহিত্যপত্র না হলে সরকারও সাহায্য দেয় না, ব্যক্তির ক্ষেত্রেও তাই। এত কষ্ট করে যারা সাহিত্য পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে কাজ করেছেন, তাদের সেই কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। সম্প্রতিক এর প্রথম সংখ্যা (১৯৬৩) প্রকাশিত হয় শাহজাহান হাফিজের সম্পাদনায়। প্রকাশক ছিলেন আমিনুল ইসলাম বেদু। দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে সম্পাদনার দায়িত্ব বর্তায় আমিনুল ইসলাম বেদুর ওপর। সাম্প্রতিক ১৯৬৩ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত মোট ১০৫টি সংখ্যা বের হয়। বলা আবশ্যক যে, ‘যারা সাম্প্রতিকের লেখক কবি তারা স্বাক্ষরের লেখক কবি সম্পাদক আবার তারাই কণ্ঠস্বরের লেখক কবি।’ তৎকালীন সাহিত্য পত্রিকাগুলোর বিষয়বস্তু ও ভূমিকা সম্পর্কে বেদু বলেন, ‘ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি তখন রাজনীতির প্রধান বিষয়।’ সেসময়ে সাম্প্রতিক, স্বাক্ষর ও কণ্ঠস্বর দুঃসাহসিকতার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা, আরবি হরফে বাংলা প্রচলন ও পাকিস্তানী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে বিরুদ্ধে লেখকরা কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প প্রকাশ করে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেন। আমিনুল ইসলাম বেদু বলেন, ‘আজকের যেসব বরেণ্য নবীন প্রবীণ কবি সাহিত্যিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জ্যোতি ছড়াচ্ছেন এরা প্রায় সকলে ‘সাম্প্রতিকের সৃষ্টি।’ (পৃ. ২২৪) বিলুপ্তির পরও সাম্প্রতিক ‘সাহিত্য চিন্তা’ নামে ২০০০ সাল পর্যন্ত চলেছে। আমিনুল ইসলাম বেদু বলেন- ‘আড্ডা হতেই সাহিত্য সৃষ্টি হয়। ঠাকুর বাড়ির আড্ডা তার প্রমাণ। আড্ডা এবং সাহিত্য যেন আত্মার আত্মীয়।’ সাম্প্রতিক এর বিশেষত্ব ছিল সম্পাদকের ক্ষুরধার সম্পাদকীয়। খ. স্বাক্ষর (১৯৬৪) মাত্র তিন কি চারটি সংখ্যা বেরিয়েছিল বলে জানান সাম্প্রতিকের সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বেদু। স্বাক্ষর প্রথম সংখ্যা প্রকাশের পর হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। যদিও স্বাক্ষর বেশিদিন স্থায়ী হয়নি এবং স্বাক্ষরের সম্পাদক ছিলেন প্রত্যেক সংখ্যায় দুজন করে। প্রত্যেক সংখ্যায় আলাদা সম্পাদক। প্রথম সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন রফিক আজাদ ও সিকদার আমিনুল হক। পরের সংখ্যাগুলোতে সম্পাদক যেই হোন না কেন, এর নেপথ্য নায়ক ছিলেন রফিক আজাদ। ষাটের দশকের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কবিদের একই মলাটে বেঁধেছিলেন রফিক আজাদই। স্বাক্ষরের পয়সা যোগাড় করতে গিয়ে ঘড়ি বিক্রি করেছিলেন তিনি। স্বাক্ষরের তৃতীয় সংখ্যা ১৯৬৫ সালে এবং চতুর্থ শেষ সংখ্যা বের হয় ১৯৬৭ সালে। শেষ সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন রফিক আজাদ ও রণজিৎ পাল চৌধুরী। গ. কণ্ঠস্বর এর আড্ডা ছিল একেবারে রসে টইটম্বুর। এটি ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে ইসলামপুরের একটি প্রায়ান্ধকার একটি প্রেস থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ছিলেন এর মধ্যমণি। রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করে শুরু হয়েছিল কণ্ঠস্বরের যাত্রা (দুর্বলতায় রবীন্দ্রনাথ : আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ)। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখকদের পুনর্বিচারে প্রবৃত্ত ছিল তখনকার তরুণ এ লেখকগোষ্ঠী। ‘বলাবাহুল্য, এই দশকেই যে অসাহিত্যিক পদ্ধতিতে রবীন্দ্রহনন শুরু হয়েছিল, তার সঙ্গে কণ্ঠস্বরকেন্দ্রী বরীন্দ্র-বিবেচনার কিছুমাত্র সম্পর্ক ছিল না।’ কণ্ঠস্বরের একযুগে দুটি পর্যায় তৈরি হয়েছিল। প্রথম পর্যায় ১৯৬৫-১৯৭০; দ্বিতীয় পর্যায় ১৯৭২-১৯৭৬ পর্যন্ত। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কণ্ঠস্বর প্রকাশনা বন্ধ থাকে। ১৯৭২ সালের জুনে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্যায়ের কণ্ঠস্বর প্রকাশনা। স্বাধীনতার পর সম্পাদকীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে যে পরিবর্তন সাধিত হয় তা হচ্ছে- ‘এ সংখ্যার সঙ্গে ‘কণ্ঠস্বর তার অগ্রযাত্রার প্রথম পর্যায় ছেড়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে পা দিচ্ছে।...আমরা নিকটতররা অনুভব করছি আমাদের সাহিত্য গত দশকের বিক্ষিপ্ত, অস্থির ও লক্ষ্যহীন মানসিকতার পর্যায়ে ছেড়ে-অন্ধকার বন্দনার ক্লেদাক্ত পাপ পেচন থেকে এবং আকাশ-ব্যাপী নৈরাজ্য, বিভ্রান্তি ও অর্থহীনতার আবর্ত থেকে মুক্তি নিয়ে সুস্থ সংহত এক অম্লান জীবনাগ্রহে জেগে উঠছে।’ (আবদুল মান্নান সৈয়দ, প্রসঙ্গ কথা, পৃষ্ঠা ৫১) পঞ্চাশের দশকে সমকাল যে ভূমিকা পালন করে ষাটের দশকে কণ্ঠস্বরও একই ভূমিকা পালন করে বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্টরা। আমিনুল ইসলাম বেদুর দাবি, ‘সাম্প্রতিকের কবি-সাহিত্যিক লেখকরাই কণ্ঠস্বরকে প্লাবিত করেছে।’ (পৃষ্ঠা ২১) আমিনুল ইসলাম বেদু প্রকাশিত প্রন্থটি ষাটের দশকের সাহিত্য এবং আড্ডার নেতৃস্থানীয় ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত। গ্রন্থটি ত্রুটিমুক্ত নয়। পরবর্তী প্রকাশনায় সতর্ক সংশোধন কাম্য। ছাপাখানার ভূত ও সতর্ক সম্পাদনার ক্ষেত্রে আরও মনোযোগী হওয়ার আহ্বান রইল। বাংলা সাহিত্যের ষাটের দশকের সাহিত্যমনন সৃষ্টিতে যে পত্রিকাগুলো স্মরণীয় হয়ে আছে, গ্রন্থটি তারই স্মারক হয়ে থাকবে সন্দেহ নেই।
×