ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ : হাসান, তোর একটি অপ্রকাশিত কাব্যপত্র

কাক কবি আবুল হাসানের কাছে ॥ সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকীর খোলা চিঠি

প্রকাশিত: ২৩:৫২, ৩ ডিসেম্বর ২০২১

কাক কবি আবুল হাসানের কাছে ॥ সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকীর খোলা চিঠি

সুপ্রিয় হাসান, ‘সাময় সময় দেয় না, সময়কে ছিনিয়ে নিতে হয় সময়ের পাখা থেকে, সময়ের মুঠো থেকে...!’ কাব্য করছি? সাহস নেই আমার কলমের। তোর কলমের সামনে! সংলাপ? ইয়েস। আমার চলচ্চিত্রের একটি চরিত্রের। তুই যখন নীহারিকায় স্থান করে নিলি সে সময় নির্মাণ করেছিলাম! ‘ঘোড়ার মাথা!’ এটি আবুল হাসান তোর উচ্চারণ, রেগে গেলে , কিছু অপছন্দ হলে বল্তি। আবার উচ্ছ্বসিত হলেও! মনে আছে? কবি আবুল হাসান! হাসান তোর সঙ্গে কথা বলছি! সৈয়দ শামসুল হক কাক প্রথম সংখ্যার জন্য কবিতা দিলেন। চোখ বুলিয়ে তাঁর সামনেই তুই বলে বসলি ঘোড়ার মাথা! সব্বনাশ! না, সৈয়দ হক রাগলেন না। সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন : থাম হাসান থাম, দিচ্ছি, দিচ্ছি, তোর তাড়ায় তড়িঘড়ি করে লিখেছিÑ হাসান : তাড়া খেয়ে কলম চালালে ঘোড়ার মাথা হয় , কবিতা হয় না! জানতাম না! উদাত্ত হাসি। ঠিক বলেছিস হাসান! তোর অনেক কালজয়ী কবিতা তো মোনিকো রেস্তঁরা কিংবা রেক্সের টেবিল ক্লথের ওপর জন্মেছে! খাতা লাগত না! তোর মনে আছে? গুণ আর তুই মিলে চা-বয় মনিকে কবি বানিয়ে ছিলি! রেস্তরাঁর নাম-ই হয়ে গেল মোনিকো এবার সৈয়দ হক দিলেন কালজয়ী কবিতা : খাদ্য ও খাদক! যার শেষ দুটি ছত্র : কপালে তৃতীয় চোখ, হাতে রক্ত হেনাÑ বুঝি এই বাংলাদেশ মরেও মরে না! * (কাক প্রথম সংখ্যা ১৯৭২) আমাদের কবিতা সঙ্কলনের নাম কাক... হাসান, তোর আবিষ্কার! বলছি। আগে একটু ঘুরে আসি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাছ থেকে। তিনি তোকে চিনতেন, স্নেহ করতেন! তাঁর প্রশ্ন : কাক কেনো রে ? এত পাখি থাকতে কাক নাম দিছোস ক্যান রে? (খাস ময়মনসিংয়ের টোন) তুই সরাসরি জবাব না দিয়ে শুনিয়ে দিলি কাকের জন্য লেখা কবি শামসুর রাহমানের ছত্রগুলো : অপূর্ব আবেগ ছিল তোর আবৃত্তি, তোর কণ্ঠে! গ্রাম্য পথে পদচিহ্ন নেই, গোঠে গরু নেই কোন, রাখাল উধাও, রুক্ষ সরু, আল খাঁ খাঁ, পথপার্শ্বে বৃক্ষেরা নির্বাক। নগ্ন রৌদ্র চতর্দিকে, স্পন্দমান কাক, শুধু কাক। জয়নুল তুলি তুলে নিলেন। মুহূর্তে সাদা কাগজে জন্ম হলো কাকের। এক নজর দেখে তোর হাতে দিয়ে বললেন : হয় না রে, হয় না... দুর্ভিক্ষ ছাড়া কাক হয় না, বুঝলি! তুই-ও একনজর দেখে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিয়ে বললি : জব্বর হইছে, দ্যাশে তো রুচির দুর্ভিক্ষ চলতাছে ... কাউয়ারা কা কা করতাছে... হা হা (সবার কোরাস হাসি) আমরা হাঁপছেড়ে বাঁচলাম! ‘ঘোড়ার মাথা’ তো বলে বসিনি পরম শ্রদ্ধেয় শিল্পীর সামনে! *জয়নুলের তাৎক্ষণিক আঁকা কাকের ছবি, বাঁশপাতা কাগজে কাকে ছাপ , মূল সাদা কাগজে! হ্যাঁ-কাক। এবার কাকের জন্ম বৃত্তান্ত : তোর পক্স হয়েছে। জল বসন্ত! কবি তো, তোকে বসন্ত ধরবেই! বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট্ট হাসপাতালে তুই। প্রতিদিন দেখত যাই। আমাদের স্বপ্নের কবিতা সঙ্কলনের নাম তল্লাশ করা হচ্ছে। চলছে দিন রাত অন্বেষণ, গবেষণা! বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা সঙ্কলন বের করতে যাচ্ছি, (?) চাট্টিখানি কথা নয়! (হাসি) সকালে নাস্তা রুটি-ভাজি খেয়েছিস, হাসান তুই। জানালার কাছে প্লেট। একটা কাক এসে রুটির টুকরো ঠোঁটে ঠুকরে নিয়ে চম্পট। তোর চিৎকার : পাইছি পাইছি, এদ্দিন ঘোড়ার মাথা লইয়া ভাবছি, নাম তো উইড়া আইলো ইউরেকা ইউরেকা ‘কাউয়া কাউয়া...’ অতঃপর বেছে নেয়া হলো : কাক। আজ ভাবি, কাউয়া দিলেই জম্পেস হতো! আবুল বারক আল্ভী অঁকলো প্রচ্ছদ, মিশকালো কাক-কালো জমিনে সাদা অক্ষরে কাক। ব্যাস। আর ভিতরে জয়নুলের কাক... রুচির দুর্ভিক্ষের পাখি!! সময় চলিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়...! কাক ’৭২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি বের হলো/ কা কা কা/ ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ড : ০২ অকস্মাত তুই উধাও। বকা দিয়েছিলাম আমার স্নেহ-আদর-ভালবাসার ভা-ারের অবস্থান থেকে। নেই, নেই, নেই... সাহিত্য পাতায় নেই, রমনার আড্ডায় নেই, রেক্সের কাবাব-পরোটার আসরে নেই, বুড়ো ভাইয়ের দাঁত বের করা পুরান ঢাকার চুন-সুরকির ক্ষয়িষ্ণু দালানেও নেই। অনিন্দ্য সুন্দরী মখমল ত্বকের সেই মহিলার মুখপানে নির্বাক বসেও তুই নেই...!! কবি উধাও! উদ্বিগ্ন তো বটেই...! সবাই। প্রায় পক্ষকাল পরে বিকেলে রমনার বটমূলে আসতেই ম্যানেজার একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন : স্যার, কবি, এই পত্র আপনাকে দিতে বলেছেন, দিতে বলেছেন আপনাকেই। কোন কবি? স্যার, পাগলা কবি। ওরা আদর করে তোকে ডাকত, বাকিতে খেলে-ও। শোধ হতো না কোন দিন! মধু দার ক্যান্টিনে হাসান, তুই খুব একটা যেতি না! রাজনীতির ডামাডোলে কাব্য রস হয়ত খুঁজে পেতি না! রেক্স তোর প্রিয় ছিল! খামের এই চিঠি আবুল হাসান, তোর। অখ্যত জেনারেল ট্রেডিং কোম্পানির প্যাডে চার পাতার পত্র লিখেছিলি। পত্র? না কবিতা! নাকি হৃদয়ের ব্যবচ্ছেদ, পোস্টমর্টেম? আজও জানি না! ছাপব, তাই অনুমতি প্রার্থনা, দিবি জানি! একটি ছত্রই যথেষ্ট - সব পরিচিত মুখের চোখগুলো থেকে অপরিচিতের ছায়ায় চলে যেতে হবে আমাকে ! সন্ধ্যা নেমে এলো। রমনার বিবর্ণ হলদে আলোছায়া অন্ধকারে পত্রটি পাঠ করতে করতে চোখ ঝাপ্সা হয়ে এলো। কবি মনের অকপট কথন। হারাইনি, আজ ৫০ বছর পরেও, বুকের অন্দরে। প্রকাশ করিনি যদিও! ০৩/ মাস না যেতেই তোর হঠাৎ উদয়। সেই আকর্ণ বিস্তৃত হাসি। ‘আইলাম, ঘোড়ার মাথা।’ চা দ্যান... রমনার মোগলাই বহুত দিন প্যাটে পড়ে নাই...। শতছিন্ন মোগলাই। প্লেটে দেয়া হতো! নামেই মোগলাই! স্বদে, গন্ধে নয়। মোগলাই খেলে সাম্রাজ্য ছেড়ে ভাগোয়াট হতে! ম্যানেজার টুকরো টুকরো শতছিন্ন করে দিত আমাদের সামনে। মনপুরা দ্বীপ, মুহূর্তে উধাও। পঙ্গপাল, রমনার বটমূলে আমরা। ০৪/ শেষ দেখা : তেজগাঁ বিমান বন্দর। চিকিৎসার জন্য পূর্ব জার্মানি যাচ্ছে, হৃদয় জনিত রোগ। কবি-তো। হাসান : যাচ্ছি, বুকের ভেতরের ঝামেলা মিটাইয়া আসি। ব্যথা! একটা কথা, ঘোড়ার মাথা চিঠিটা ফালাইয়া দিছেন তো? আমি : না, ওটা থাকবে। আমার কাছে! কথা রেখেছি। আমার সম্পদ! হাসান : তাহলে এই কলমটা লইলাম! বুকপকেট থেকে আমার কলম ছিন্তাই করেছিলি। ওটা আমার মায়ের দেয়া কলম।মা কবিতা লিখতেন এক সময়। তুই জানতি! আমার মা তোকে ডাল-ভাত খাওয়াত, হঠাৎ হাজির হলেই, আমি বাসায় না থাকলেও! হাসান : হা হা ঘোড়ার মাথা, লিখতে তো হইব...হিটলারের দ্যাশে... তুই চলে গেলি হৃদয়ের একূল ওকূল দু’কূল ভাসিয়ে। ‘পথের শেষ কোথায়, কি আছে শেষে... কে জানে, জানি না! হাসতে হাসতে হাসান তুই চলে গেলি ইমিগ্রেশনে! আমাদের প্রাণের পরে চলে গেলি। তুই, কি যেন বলে গো, কি যেন পেছনে রেখে গেলি? রবীন্দ্রনাথ কুসুম বনে আর্তনাদ করেছেন, কাদম্বরী দেবীর আত্মহননে, আমরা আবুল হাসান, তোর কাব্য বনে কান পেতে আছি। কবি তুই ‘আপনার মনে আপনি জ্বলেছিস’ গন্ধব্ধূর ধুপ’ হয়ে। আমার আজকের লিখন তোর কাব্য নিয়ে নয়, তোর কাক প্রথম সংখ্যার ‘মানুষ’ নিয়েও নয়, যা হৃদয়ে অনুরণিত : আমার যোগ্যতা নেই সে গভীরে প্রবেশের। তুই ঐশ্বরিক উচ্চারণ করেছিলি, আজ বুঝি : আমি যেন আবহমান থাকবো বসে/ ঠুকরে খাবো সূর্য, লতা, গাছের শিকড়/ অন্ধকারের জল আমি যেন অনাদিকাল থাকবো বসে বিশ্রুতিময় জীবনে কল্লোল/ আমার এই লিখন তোর সে চিঠি নিয়ে। অকপট কাব্য গাঁথা। আমি আমার একটি চিত্রনাট্যে (এখনো চিত্রায়ন হয়নি) তোর চরিত অঙ্কন করেছি। পাঠিয়ে দেব! কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে তোর সখ্যতা ছিল ভিন্ন মাত্রার। স্বল্পবাক কাদরীকে তুই শ্রদ্ধা করতি! যদিও স্নেহের সম্পর্ক ছিল সবার সাথেই। একদিন ধরে বসলি : কাদরীর লগে আমার একটা ছবি তুইলা দেন! ক্লিক!! ছবি হাসানের সঙ্গে কাদরী, আমার ক্যামেরায় খোলা চিঠির শেষে যাবে : ইতি, হাসান তোর ছায়া সহচর সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী, কথা রেখেছি –রাখবো- দেখা হবে... আমি যেন আবহমান থাকবো বসে/ আবহমান আমিই কল্লোল/ সময় থেকে সভ্যতাতে রাখবো ঢেকে যুদ্ধ, মড়ক, নগ্ন ফলাফল/ (কাক প্রথম সংখ্যা ১৯৭২)।
×