ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শান্তিচুক্তির দুই যুগ অবকাঠামো উন্নয়ন কল্পনাতীত

পাহাড় ও সমতলের ব্যবধান ক্রমেই কমছে

প্রকাশিত: ২৩:২৬, ৩ ডিসেম্বর ২০২১

পাহাড় ও সমতলের ব্যবধান ক্রমেই কমছে

হাসান নাসির, খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে ॥ পার্বত্য শান্তিচুক্তির দু’যুগ পূর্তি হলো। পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয়েছিল যুগান্তকারী এই চুক্তি। অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়নসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রে অর্জন অনেক। কিন্তু চুক্তিটি যেহেতু ‘শান্তিচুক্তি’, সেহেতু সেই শান্তি কতটুকু এসেছে তা একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন। সহাবস্থান কিছুটা পরিলক্ষিত হলেও প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মধ্যে ফারাক অনেক। তাই রয়ে গেছে অতৃপ্তি, অপূর্ণতা। এখনও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার উগ্র আক্রমণে পড়ছে লাশ। খাগড়াছড়ির বিভিন্ন এলাকার বাঙালী ও পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলে যা বোঝা গেল তাতে স্পষ্ট যে, জীবনমানের অনেক উন্নতি ঘটেছে। মানুষের আয় বেড়েছে, পুষ্টির চাহিদা মিটছে আগের চেয়ে বেশি, শিশু কিশোররা এখন স্কুলে যায়, চিকিৎসা এখন অনেক সহজলভ্য। অবকাঠামো এবং সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় পাহাড় ও সমতলের ব্যবধান ক্রমেই কমে আসছে। এখনকার যে চিত্র, তা কয়েকযুগ আগে কল্পনাও করা যায়নি। এই উন্নতি সম্ভব হয়েছে সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক পদক্ষেপের কারণে। কিন্তু চুলচেরা বিশ্লেষণে যে প্রশ্ন এসে যায় তা হলো, সেই মানবিক উদ্যোগের মূল্যায়ন কতটুকু হয়েছে, নাকি এখনও মূল্য দিতে হচ্ছে ? পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর অভিযোগ, শান্তিচুক্তির পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। অপরদিকে, সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলো বলছে, চুক্তির ৭২টি ধারা বা শর্তের মধ্যে ৭১টির বাস্তবায়ন করবে সরকার, যারমধ্যে ৪৮টি এরইমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ১৫টি ধারার আংশিক বাস্তবায়ন এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। এতগুলো ধারা বা শর্তের মধ্যে পাহাড়ী সংগঠনগুলোর জন্য মাত্র একটি ধারা, যা হলো অস্ত্র সমর্পণ। কিন্তু সেই একটি শর্ত তারা চব্বিশ বছরেও প্রতিপালন করেনি। চুক্তি যদি হয় উভয়পক্ষের জন্যই পালনীয়। তবে একটি পক্ষ সশস্ত্র থেকে গেলে অপরপক্ষের নিরস্ত্র হওয়া কতটুকু সম্ভব, সে প্রশ্ন এসে যায়। প্রশাসন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এমনকি সেনাবাহিনীও বলছে, এই বাংলাদেশে যাদের বংশ পরম্পরায় বসবাস তাদের সকলেই নাগরিক। কাউকে তারা আলাদা চোখে দেখেন না। সকলের অধিকার সমান থাকা উচিত, এমনই অভিমত চুক্তি বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর। বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকায় বাঙালীদের বসবাস, ব্যবসা পরিচালনা এমনকি ছোটখাটো একটি দোকান খোলার ক্ষেত্রেও আসছে বাধা, এমনই তথ্য মিলছে অনুসন্ধানে। সহাবস্থানেই যে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে, সেটি যদি কোন এক বা একাধিক পক্ষ বুঝতে না চায় তাহলে উন্নত জীবন লাভ করা সুদূর পরাহত হয়ে যায়। এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন উপলব্ধি। এজন্য অবকাঠামোসহ নানাক্ষেত্রে উন্নয়নের পাশাপাশি মনের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। দাবির সেই জুম্মল্যান্ড ও বাস্তবতা ॥ দেশের এক দশমাংশ নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম, যা এখন খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান- এই তিন জেলায় বিভক্ত। মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ এখানে বসবাস করে। ৫ হাজার ৫০০ বর্গমাইলের দুর্গম এ এলাকা একদা ছিল অনেকটাই জনমানবহীন। সেখানে প্রায় সকলেই সেটেলার। এরমধ্যে কেউ আগে, কেউ পরে। সময়ের পরিক্রমায় এ জনপদে পাহাড়ী বাঙালীর অনুপাত এখন প্রায় সমানে সমান। পৃথক আবাসভূমি ‘জুম্মল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠা কিছু নেতার অভিপ্রায় হতে পারে। কিন্তু এতসংখ্যক বাঙালীর বসবাস যেখানে, সেখানে জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার সেই স্বপ্ন আর বাস্তবসম্মত কিনা, এমন প্রশ্ন এখন সাধারণ পাহাড়ীদের মনেও। একান্ত আলাপে অনেক পাহাড়ীও বলেছেন, পার্বত্য তিন জেলায় এখন বাঙালীদের প্রায় সমান বসবাস। এই বাস্তবতা মানতে হবে। এমন অবস্থায় উচিত হবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে জীবনমানের আরও উন্নয়ন ঘটানো। সরকারের অনেক পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও প্রকল্প পাহাড়ী জনপদ ঘিরে। সেগুলোর বাস্তবায়নে ইতিবাচক পোষণ করলেই বরং মঙ্গল। কারণ, এতদিনের যে অভিজ্ঞতা তাতেই পরিষ্কার হয়ে গেছে, সংঘাত এবং রক্তক্ষয় করে কোন সমাধান নেই। এটা অনেক দূরাশা। সময়ের বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের অধিবাসী হিসেবে মূল ধারায় শামিল হওয়া। পাহাড়ী দলগুলোর অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ ॥ দু’যুগ আগে যখন শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তখন পাহাড়ীদের সংগঠন ছিল একটি, যার নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। এ সংগঠনটির সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয়েছিল যুগান্তকারী এই চুক্তি। আশা ছিল, এতে শান্তির সুবাতাস বইবে। অর্জন একেবারে কম নয়, তবে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও শান্তি এখনও আসেনি। কী পাহাড়ী, কী বাঙালী-প্রতিটি পরিবারেই প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় এক ধরনের শঙ্কা। প্রতিদিনই ভাবতে হয়, আজকের দিনটি বেঁচে থাকব কিনা। কারণ, হত্যা ও হামলার ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ভোরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয় জেএসএস অন্যতম শীর্ষ নেতা আবিষ্কার চাকমা। কারা হত্যা করল পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর এই নেতাকে ? নিশ্চয়ই কোন বাঙালী সংগঠনের কাজ নয়। নিজেদের মধ্যে অন্তর্কলহ, গ্রুপ উপগ্রুপে বিভক্তি এবং একে অপরের প্রতি আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ। এমন ঘটনা অহরহ। এভাবেই নিজেদের মধ্যে সংঘাতে ঘটছে প্রাণহানি, যে পরিসংখ্যান অনেক বড়। শান্তিচুক্তি শুরুর সেই জেএসএস ভেঙ্গে এখন পাহাড়ীদের চারটি সংগঠন। এগুলো হচ্ছে জেএসএস, জেএসএস সংস্কার, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন জেএসএস নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। অস্ত্র সমর্পণ না হওয়ার পেছনে পরিষদ চেয়ারম্যানের ব্যর্থতা নাকি নির্লিপ্তভাব তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অনেকের অভিযোগ, তিনি এ পদে থেকেও সশস্ত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছেন। আবার পাহাড়ী সংগঠনগুলোর ওপর তার আগের সে প্রভাব রয়েছে কিনা প্রশ্নও আছে। কারণ, দীর্ঘ দু’যুগ ধরে তিনি বা তার দল কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন না। এতে করে সমর্থন কতটুকু রয়েছে তা পরীক্ষিত নয়। গুরুত্বপূর্ণ এ পদটি ধরে রাখবার মানসেই জেএসএসের এই শীর্ষনেতা জনসমর্থন যাচাইয়ের পরীক্ষায় যেতে চান না বলে মনে করেন খোদ পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর অনেক মানুষ, যা আলোচনায় বেরিয়ে এসেছে। পাহাড়ের পরিপ্রেক্ষিত যে বদলে গেছে, তা অনেকেই মানছেন। পাহাড়ে দু’যুগে ৪৬৭ খুন ॥ পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় গত চব্বিশ বছরে খুন হয়েছে ৪৬৭ জন। এরমধ্যে ৩২৭ জন পাহাড়ী এবং ১৪০ জন বাঙালী। আহত হয়েছে মোট ১ হাজার ২১৬, যারমধ্যে বাঙালী ৮২৪ এবং পাহাড়ী ৪৭২। অথচ, শান্তিচুক্তি হওয়ার পর এই হত্যাযজ্ঞ থেমে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনও সেই অস্ত্রের দামামা। এই চব্বিশ বছরে মোট অপহরণের ঘটনা ৭১১, যারমধ্যে ৪৭২ জন উপজাতি এবং ২৩৯ জন বাঙালী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে এ সময়ের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৮১২টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ১২ হাজার ৮৫১ রাউন্ড গুলি। সন্ত্রাসী কর্মকা-ের জন্য গ্রেফতার হয়েছে উপজাতি জনগোষ্ঠীর ১ হাজার ৯৭৭ জন। হত্যার যে পরিসংখ্যান তাতেই পরিষ্কার যে, পাহাড়ীদের সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ সংঘাতেই খুনের ঘটনা বেশি। উপজাতীয় সংগঠন থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগসহ মূল ধারায় যুক্ত হওয়া নৃগোষ্ঠীর নেতারাও তাদের হিটলিস্টে। সে কারণেই এ পর্যন্ত হত্যার শিকার হয়েছেন বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গা, কাপ্তাই জোনের রাজাখালী উপজেলার বাঙাল হালিয়া ইউনিয়নের ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি ক্য হ্লা চিং মারমা, বান্দরবান জোনের রাবার বাগান এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা কে চিং থোয়াই মারমা, বান্দরবান পৌর আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি ও সাবেক পৌর কাউন্সিলর চ থোয়াই মং মারমা,বান্দরবান সদরের রাজভিলা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা বাচানু মারমা এবং কাপ্তাই উপজেলার চিৎমরম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নেথোয়াই মারমা। বছরে চাঁদাবাজি ৪০০ কোটি টাকার ॥ তিন পার্বত্য জেলায় রয়েছে নীরব চাঁদাবাজি। এর শিকার হয়েও ভয়ে টু-শব্দটি করতে পারেন না ভুক্তভোগীরা। বিশেষ করে চাঁদাবাজদের উৎপাত বেশি ব্যবসা পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ওপর। এই চাঁদা উঠিয়ে পাহাড়ী সংগঠনগুলো তাদের অস্ত্র কেনা এবং সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে।
×