ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিক্ষায় ব্যাপক প্রসার, সর্বক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য

কোটি কোটি শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যের বই

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ৩ ডিসেম্বর ২০২১

কোটি কোটি শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যের বই

অপূর্ব কুমার ॥ স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাত মাসের মাথায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের হাত ধরে ড. মুহাম্মদ কুদরত-এ-খুদা কমিশনের মাধ্যমে দেশে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশ পেয়েছে অভাবনীয় সাফল্য। শিক্ষায় ব্যবস্থার ভিত ৭১ সালে তৈরি হলেও এখানে পৌঁছতে পেরোতে হয়েছে কঠিন পথ। নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে নারী শিক্ষায় অভাবনীয় সাফল্য, বিনামূল্যে বই বিতরণ, কারিগরি শিক্ষা প্রসার, উপবৃত্তি চালু, রেজিস্টার্ড প্রাথমিক স্কুল, থানাভিত্তিক বেসরকারী স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ, মেডিক্যাল শিক্ষা ও উচ্চ শিক্ষায় বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেকদূর। স্বাধীনতা-পরবর্তী সাতটি শিক্ষা কমিশন গঠন হলেও শিক্ষার প্রসার বেড়েছে মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। তবে শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রসার বাড়লেও সেই তুলনায় মান বাড়েনি। বর্তমানে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর সাক্ষরতার হার ছিল ১৬.৮ শতাংশ। ১৯৭৪ সালে সাক্ষরতার হার দাঁড়ায় ২৫.৯ শতাংশ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহজোট সরকার দায়িত্ব নেয়ার সময় ২০০৯ সালে দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ৫২ শতাংশ। চার বছর পর ২০১৩ সালে ২১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশ হয়েছে। ২০২০ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ৭৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ। পাকিস্তান আমলের মাত্র ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গায় বর্তমানে বাংলাদেশে ৫৭টি সরকারী এবং ১০৭টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে (সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ১৬টি সাধারণ, পাঁচটি প্রকৌশল, নয়টি কৃষি, ১৭টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পাঁচটি মেডিক্যাল এবং তিনটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় নামে দুটি বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। একইসঙ্গে পাঁচটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ছয়টি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং ৪৯টি সরকারী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট রয়েছে মেডিক্যাল এডুকেশনের আগেও তুলনায় এগিয়ে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে আমাদের মাত্র ছয়টি মেডিক্যাল কলেজ ছিল। এখন সেখানে ৩৬টি সরকারী এবং ৭১টি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া আধুনিক মানদণ্ডে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি ও উচ্চতর মেডিক্যাল গবেষণার জন্য ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউট অব পোস্টগ্রাজুয়েট মেডিক্যাল রিসার্চকে (আইপিজিএমআর) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়েছে। একই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে আরও চারটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুরু হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব হাসপাতাল ছাড়াও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অনেক সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল-ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে। ব্যানবেইসের আর্কাইভ থেকে পাওয়া ১৯৭০-৭১ সালে দেশের শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এর আগের বছরের একটি তুলনামূলক চিত্রে দেখা গেছে, ওই বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে নারী শিক্ষায় হঠাৎ পিছিয়ে যায় দেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ ওই পিছিয়ে যাওয়া অবস্থা থেকে নারী শিক্ষা নিয়ে শুরু করে নতুন যাত্রা। এ্যানুয়াল রিপোর্ট অন পাবলিক ইন্সট্রাকশন ফর দ্য ইয়ার ১৯৭০-৭১ প্রতিবেদন অনুসারে, ওই সময় দেশে মোট শিক্ষার্থীর ২৮.৪ শতাংশ ছিল মেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১৮৮টি অনুমোদিত ডিগ্রী কলেজে ৯ শতাংশের বেশি এবং তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ শতাংশের মতো ছাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ হাজার ৯৪৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে নারী ছিলেন ১ হাজার ২৯৪ জন। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্পের অধীনে ১৯৮১ সালে প্রথম প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতর গঠন করা হয়। এরপর ১৯৯২ সালে এটি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ এবং ২০০৩ সালে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় হিসেবে গড়ে ওঠে। ২০০৩ সালে প্রাথমিকে মেয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ছিল ৪৯ শতাংশ। মাধ্যমিকে গ্রামীণ পর্যায়ে প্রায় ৫৪ এবং শহরাঞ্চলে এ হার ৫১ শতাংশের কিছু বেশি ছিল। ২০১৫ সালে পেশাদারি শিক্ষায় ৩৯, ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে (১৬২টি) ৪৩, দাখিলে ৫৯, আলিমে ৫৪ শতাংশের বেশি এবং কারিগরি শিক্ষায় মেয়ে শিক্ষার্থীর হার ছিল প্রায় ২৪ শতাংশ। ব্যানবেইসের ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, ১৩ ধরনের পেশাগত শিক্ষায় ৫৪, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক (ভোকেশনাল) শিক্ষায় ২৫ শতাংশের কিছু বেশি, ইংরেজী মাধ্যমে স্কুলে (১৪৫টি) প্রায় ৪৪ এবং দাখিলে ৬০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী মেয়ে। ব্যানবেইসের ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৮ বছরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে মেয়েদের পাসের হার আড়াই গুণ বেড়েছে। ১৯৯০ সালে ৩০ শতাংশ মেয়ে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় পাস করেছিল। ২০১৯ সালে পাস করেছে ৮৩ শতাংশের বেশি মেয়ে। ১৯৯০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় পাস করেছিল ৩১ শতাংশ মেয়ে। আর ২০১৯ সালে পাস করেছে প্রায় ৭৫ শতাংশ মেয়ে। ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হারও দিন দিন কমছে। ২০০৫ সালে ৪৭, ২০১০ সালে প্রায় ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। ২০১৯ সালে এ হার নেমে এসেছে প্রায় ১৮ শতাংশে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন বিষয়ে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, দেশ হিসেবে ৫০ বছরে আমাদের অনেক অর্জন রয়েছে। সামরিক সরকারের আমলে কিছুটা আমরা হোঁচট খেয়েছি। গণতান্ত্রিক আমলে অর্থনীতি, দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছি। শিক্ষা খাত নিয়ে আমি বলব, প্রত্যাশিত মান আজও আমরা অর্জন করতে পারিনি। শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও পরীক্ষানির্ভর, সনদসর্বস্ব। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, গত ৫০ বছরে শিক্ষার বিস্তার বেড়েছে, তবে মানের আশানুরূপ উন্নয়ন হয়নি। এখন মানের দিকে আরও নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, শিক্ষার মানের সঙ্গে শিখন পদ্ধতি, পাঠ্যক্রম, পাঠ্যবই, শিক্ষক সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের মননশীলতা জাগিয়ে তুলতে না পারলে ফলসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে মানের উন্নয়ন ঘটবে না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দিকে আমরা পা বাড়াচ্ছি। তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে শিক্ষার বাজেটের দিকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে শিক্ষায় জিডিপির ৪ শতাংশ অর্থ ব্যবহারের কথা বলেছিলেন। স্বাধীনতার পর প্রণীত ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষানীতিতে জিডিপির ৫ থেকে ৭ শতাংশ অর্থ ব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল। ৫০ বছর পর এখন এসে আমরা মাত্র ২ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছি। বঙ্গবন্ধু শাসনভার হাতে নেয়ার মাত্র ৭ মাসের মধ্যেই ‘খুদা শিক্ষা কমিশনে’র মাধ্যমে একটি আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষানীতি প্রণয়নে উদ্যোগ নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন, জিডিপির ৪ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয়; জাতীয় শিক্ষানীতি তৈরির লক্ষ্যে ড. কুদরত-এ-খুদার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠন এবং ১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ এবং ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭২৪ জন শিক্ষককে সরকারীকণের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল। প্রায় শূন্যে থেকে শুরু করা শিক্ষা ব্যবস্থা স্বাধীনতার ৫০ বছরে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি বড় অর্জন হয়েছে ছেলেমেয়েদের লিঙ্গ সমতা। ব্যানবেইসের তথ্যানুযায়ী, মেয়েদের শিক্ষার হার প্রাথমিকে শতকরা ৫১ ভাগ যা মাধ্যমিকে ৫৪। যা আগের তুলনায় অনেক বেশি। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে মূল ধারায় আনা সরকারের উল্লেখযোগ্য সফলতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এছাড়া প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার হ্রাস পেয়ে ১৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার প্রভাবে সচেতনতা বাড়ছে, ফলে বাল্যবিবাহের হারও গত চার পাঁচ বছরে কমে এসেছে। প্রাথমিকের সঙ্গে বর্তমানে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষায়ও সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডিজিটালাইজেশন করার নিমিত্তে প্রায় প্রতিটি স্কুলে চালু করা হয়েছে আইসিটি ল্যাব। বর্তমানে কম্পিউটার কোর্সকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার লক্ষ্যে ছেলেমেয়েদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার প্রয়াসে স্কুলভিত্তিক আইসিটিমেলা ও বিজ্ঞানমেলার আয়োজন করা হচ্ছে। সাংস্কৃতিক বিকাশে স্কুলভিত্তিক নানা কর্মসূচী চালু করা হয়েছে। তাছাড়া টিফিন কার্যক্রম, বিনামূল্য শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, স্কুল-ভিত্তিক মেধা ক্লাব গঠন, স্টুডেন্ট কেবিনেট গঠন, সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর জন্য গ্রামে গ্রামে গিয়ে অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধকরণসহ নানামুখী কর্মসূচী গ্রহণ আজ বাংলাদেশকে সফলতার এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এছাড়া উপবৃত্তি, স্কুল জাতীয়করণ, শিক্ষকদের চাকরি সরকারীকরণসহ সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট গঠন প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন করেছে। মাদ্রাসা শিক্ষায় বিজ্ঞান ও কম্পিউটার শাখা চালুকরণ, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর ও ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সুষ্ঠু তদারকির মাধ্যমে চলছে উচ্চ শিক্ষা কার্যক্রম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও এখন আর নেই কোন সেশনজট। করোনার কবলে পড়ার পূর্ব পর্যন্ত নিয়মিত ভর্তি কার্যক্রম, ক্লাস ও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১০ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গ্রহণযোগ্য একটি শিক্ষানীতি তৈরি করা হয়। সম্প্রতি কারিগরি শিক্ষার বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের সচেতনতা বেড়েছে। শতভাগ শিশুর স্কুলে গমন ও শিক্ষালাভ, ঝরে পড়ার হার কমিয়ে আনা, সংখ্যা বিচারে উচ্চ শিক্ষায় বিস্ফোরণ (৩.৮ মিলিয়ন), পাকিস্তান আমলের ৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গায় ৪৫টি পাবলিক ও ১০৩টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, মেডিক্যাল, টেক্সটাইল, ম্যারিটাইম, এভিয়েশন সায়েন্সেস, ডিজিটাল ইত্যাদি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, দশম শ্রেণী বা সমমান পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বছরে প্রায় ৩৮ কোটি পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রায় ৯৭ শতাংশ শিক্ষা বেসরকারী খাতে পরিচালিত হয়ে থাকে। এসব দিক বিবেচনা করে বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করেছে সরকার। বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীদেরও অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করায় সরকারী পাশাপাশি বেতনও শতভাগ বাড়ানো হয়েছে। এছাড়াও তাদের বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট, ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা, কল্যাণ ও অবসর বোর্ডের জন্য ১ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ, মেডিক্যাল ও চিকিৎসা ভাতা বেড়েছে। শিক্ষার সহজলভ্যতা ও প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সঙ্কট ও গ্রাম-শহর বৈষম্য কমে যাওয়া এবং শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি এখন শিক্ষা ব্যবস্থার অপরিহার্য ও অবিচ্ছিন্ন উপাদান। ২০১১ সালে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়নের মধ্য দিয়ে শিক্ষার সঙ্গে দক্ষতাকে যুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। বিনামূল্যে বই বিতরণে রেকর্ড ॥ দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে অন্যতম বৃহৎ অর্জন কোটি কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে বই বিতরণ। বিশ্বের অনেক উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশও এই উদ্যোগ নিতে পারেনি। ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে সব শিক্ষার্থীকে নতুন বই দেয়া শুরু হয়েছে। প্রতি বছর প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীকে ৩৫ কোটি বই দেয়া হচ্ছে। গত ১২ বছরে একবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ২০২০ সালে করোনা মহামারীতে সারা বিশ্বই ছিল ঝুঁকির মুখে। তবুও সব শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে করোনার মধ্যেও চলতি ২০২১ শিক্ষাবর্ষে বছরের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে নতুন বই। জানা যায়, আগে সব শিক্ষার্থী নতুন বই পেতো না। সাধারণত দুই-তিনটি নতুন বইয়ের সঙ্গে পুরনো বই দেয়া হতো। সব বই পেতে মার্চ পর্যন্ত সময় লেগে যেত। ফলে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ত। বছরের প্রথম দিন সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দেয়ায় গতি ফিরেছে পড়ালেখায়। নতুন বই ও উপবৃত্তি দেয়ার ফলে ঝরে পড়ার হার কমে এসেছে। প্রাথমিকে প্রায় শতভাগ শিশু স্কুলে আসছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানায়, ২০১০-২০২১ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত মোট ১২ বছরে ৩৬৫ কোটি ৮৪ লাখ ৪৫ হাজার ৭৮১টি বিনামূল্যের বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ চলতি ২০২১ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চার কোটি ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ২২৬ জন শিক্ষার্থীকে ৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার ৪১২টি বিনামূল্যের বই দেয়া হয়েছে। সরকার ২০১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাঝে তাদের নিজেদের ভাষায় বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ শুরু করেছে। চাকমা, মারমা, সাদ্রী, গারো ও ত্রিপুরা এই পাঁচ ভাষার শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক স্তরে তাদের মাতৃভাষায় বই ছাপানো হয়। এছাড়া দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদেরও বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে ব্রেইল বই। উপবৃত্তির সুফল দরিদ্র পরিবারের শিশুদের স্কুলে ভর্তি নিশ্চিত করা, শ্রেণীকক্ষে উপস্থিতি বাড়ানো ও ঝরে পড়া ঠেকাতে সরকার ১৯৯৩ সালে শিক্ষার জন্য খাদ্য কর্মসূচী হাতে নেয়। শহর এলাকা বাদে ২৭ শতাংশ এলাকায় এ কর্মসূচী ছিল। ১৯৯৯ সালে পৌর এলাকা বাদে অবশিষ্ট ৭৩ শতাংশ এলাকার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করে ছাত্রছাত্রীদের মাসে ২৫ টাকা হারে উপবৃত্তি দেয়া শুরু হয়। এখন প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য মাসে ১০০ টাকা এবং প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত মাসে ১৫০ টাকা হারে উপবৃত্তি দেয়া হয়। যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত খোলা হয়েছে, সেসব স্কুলের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মাসে ২০০ টাকা করে উপবৃত্তি দেয়া হয়। মাধ্যমিকেও বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে উপবৃত্তি দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের মাধ্যমে স্নাতক (পাস) কোর্সের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেয়া হয়। বিভিন্ন শর্তের ভিত্তিতে ৩০ শতাংশ ছাত্রী ও ১০ শতাংশ ছাত্রকে এই উপবৃত্তি দেয়া হয়। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় ১৯৭২ সালে, ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে। তৎকালীন সীমিত সম্পদ, রাষ্ট্রীয় নীতি ও মানুষের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে কমিশন ১৯৭৪ সালে তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে রাজনীতির পরিবর্তন ঘটায় প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালের অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি কিংবা ১৯৮৩ সালের মজিদ খান কমিশন প্রতিবেদনের সুপারিশ মানুষের প্রতিবাদে বাস্তবায়ন হতে পারেনি। দুটোর কোনোটিই জনগণের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করতে পারেনি, উল্টো বৈষম্য সৃষ্টির নানা উপাদান ছিল এগুলোতে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে ১৯৮৮ সালের মফিজ উদ্দিন আহমদের কমিশন প্রতিবেদনের সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি। এর দীর্ঘদিন পর ১৯৯৭ সালে অধ্যাপক এম শামসুল হককে প্রধান করে যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি করা হয়, তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৯৯৯ সালের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি (খসড়া) তৈরি করা হয় এবং ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শিক্ষানীতি সংসদে গৃহীত হয়। ক্ষমতার পর পরিবর্তনের কারণে সেই শিক্ষানীতিও আসলে বাস্তবায়ন হয়নি বা হতে দেয়া হয়নি। বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালে ড. এমএ বারীকে প্রধান করে নতুন কমিশন গঠন করা হয়। সেটি আর এগোয়নি। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞাকে প্রধান করে নতুন আরেকটি কমিশন গঠন করা হয় এবং এই কমিশনের সুপারিশগুলোও বাস্তবায়ন করা হয়নি। সর্বশেষ ২০০৯ সালে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে প্রধান করে জাতীয় শিক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭৪ সালের শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন ও ২০০০ সালের শিক্ষানীতিকে ভিত্তি ধরে নতুন একটি শিক্ষানীতি তৈরির কথা এই কমিটিকে বলা হয়। সরকারের চাওয়া অনুসারে কমিটি যে প্রতিবেদনটি তৎকালীন সরকারের কাছে পেশ করে, সেটি কিছুটা সংশোধিত হয়ে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে শিক্ষানীতি হিসেবে গৃহীত হয়। ২০১০ সালের এ জাতীয় শিক্ষানীতিই বাংলাদেশের দ্বিতীয় ও বর্তমান শিক্ষানীতি, যা ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কার্যকর রয়েছে। তবে সেই শিক্ষানীতির পুরোটা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। এছাড়া মহামারী করোনাতে শিক্ষাকার্যক্রম সচল রাখতে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়। ২০২০ সালে করোনা শনাক্ত হওয়ার আগে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও এইচএসসি পরীক্ষা সেইবার আয়োজন করা যায়নি। কিন্তু ২০২১ সালে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
×