ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

-হারুন পাশা

আমার চরিত্ররা আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে প্রমিত ভাষাতেও কথা বলে

প্রকাশিত: ২১:৪১, ৩ ডিসেম্বর ২০২১

আমার চরিত্ররা আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে প্রমিত ভাষাতেও কথা বলে

হারুন পাশা [জন্ম. ১০ নবেম্বর ১৯৯০-] কথাসাহিত্যিক। তাঁর গল্প-উপন্যাসের বর্ণনায় লেখক অনুপস্থিত থাকে এবং চরিত্ররাই কথক। তাদের কথনেই কাহিনী এগিয়ে যায় শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত। আখ্যানে এক চরিত্র গল্প শোনায় আরেক চরিত্রকে কিংবা নিজেরাই বলে নিজেদের গল্প। উপন্যাসের ভেতরে রয়েছে ‘সংযুক্তি’ অংশÑ এই সংযুক্তি উপন্যাসের ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং এক কাহিনীর সঙ্গে আরেক কাহিনীর সেতু হিসেবে ব্যবহৃত। তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন রংপুর জেলায়। কথাসাহিত্যে পেয়েছেন ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১৮’ এবং ‘শওকত ওসমান সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯’। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন কবি গোবিন্দ ধর। আপনার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। এরপর লিখেছেন আরও গল্প। লিখেছেন উপন্যাস। গল্প-উপন্যাসে কথন আঞ্চলিক ভাষায় হলেও প্রমিত উচ্চারণও এসেছে। এর নেপথ্যের শিল্পবয়ন শুনতে চাই। হারুন পাশা : আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার চরিত্ররা আঞ্চলিক ভাষায় সঙ্গে প্রমিত ভাষাতেও কথা বলে। ঘটনা কিংবা পরিবেশ-পরিস্থিতি তাকে ঠিক করে দেয় সে কোন ভাষায় কথা বলবে। আপনার গল্প-উপন্যাসে উপস্থিত দেশ, সময়, সমাজ এবং মানুষের সঙ্কটের কথা। এগুলোর কথাই আমাদের একটু বলুন। চরিত্র নির্মাণের মৌলিকত্ব বিষয়ে আপনার গোপন কৌশল কি? হারুন পাশা : আমার সময়কালে আমার দেশ, সময়, সমাজ এবং চারপাশের মানুষ কেমন আছে তা জানতে আমার তুমুল আগ্রহ। এই আগ্রহ ফোর্স করে তাদের নিয়ে লিখতে। বিদ্যমান সঙ্কট আমাকে বেশি পীড়িত করে। ফলে এসে যায় সঙ্কটের কথা। আমার গল্প-উপন্যাস যেহেতু চরিত্রপ্রধান সেহেতু চরিত্ররাই রিপ্রেজেন্ট করে নিজেদের সঙ্কটের কথা এবং বলে সময়, সমাজ এবং দেশ-বহির্বিশে^র সঙ্কট নিয়ে। তাদের কথাতেই নানামাত্রিক সঙ্কট উঠে আসে। আমার সাহিত্যে চরিত্র নির্মাণের মৌলিকত্ব হলো চরিত্ররাই গল্প-উপন্যাসে দাপুটে। তারাই জীবন ও জগতের ব্যাখ্যাকারক। তাদের কথনেই গল্প-উপন্যাস সমাপ্ত হয়। লেখক এখানে অনুপস্থিত। চরিত্ররাই মুখ্য। আপনি তো ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করেন। আপনার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কেমন করে সাহিত্যে যুক্ত হয়? হারুন পাশা : আমি যখন কোন কিছু লিখব বলে স্থির করি তখন ওই বিষয়ে ভাল করে জানার চেষ্টা করি। যে স্পট আমার লেখায় আসবে সেই স্পটে যাই। তা যতদূরেই হোক না কেন। ওই মানুষদের সঙ্গে কথা বলি। তাদের জীবনাচারণ, ওইখানকার পরিবেশ, ঘটনাবলী ভাল করে জানি। জানি ওইসবের অতীত ও বর্তমান। স্পটে যেতে হলে ভ্রমণ করতে হয়। ভ্রমণ করে এবং ওইখানকার মানুষের ইন্টারভিউ করে যা জানি তা নিয়ে লিখতে বসি। লিখতে লিখতে নতুন কিছু যোগও হয়। ভ্রমণ হয়ে যায় লেখার গুরুত্বপূর্ণ পার্ট। ‘তিস্তা’, ‘চাকরিনামা’ এবং ‘বদলে যাওয়া ভূমি’ তিনটি উপন্যাস তিন রকম বিষয় নিয়ে লেখা। বিস্তারিত বলবেন যে বিষয়গুলো এসেছে উপন্যাসে তা নিয়ে? হারুন পাশা : ‘তিস্তা’ উপন্যাস বাংলাদেশ ভূখ-ের তিস্তা নদী নিয়ে। পানি না থাকায় নদী শুকিয়ে গেছে। তিস্তাবাসীরা পানি পাচ্ছে না, ঠিকমতো আবাদ করতে পারছে না। নানা সমস্যায় আক্রান্ত নদী ও মানুষ। তাদের আখ্যান ‘তিস্তা’। আমাদের সমাজবাস্তবতায় বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলছে, কিন্তু কর্মের ব্যবস্থা সেরকম হচ্ছে না। বেকার সব সময় অবহেলিত ও বঞ্চিত হয়ে আসছে রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের কাছে। এমনকি প্রেমিকার কাছেও। বেকারের মনোকষ্ট, বঞ্চনা, সংগ্রাম, সফলতার আখ্যান হলো ‘চাকরিনামা’। করোনা আমাদের সব কিছুই উলোট-পালট করে দিয়েছে। বদলে গেছে সমাজ ও দেশের সঙ্গে মানুষের মনস্তত্ত্ব ও অর্থনৈতিক অবস্থান। বদলে গেছে বিশ^রাজনীতি। সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে লেখা ‘বদলে যাওয়া ভূমি’। আপনার গল্প-উপন্যাসে কবিতা, ছড়া, গানের বিভিন্ন পঙ্ক্তি পাওয়া যায়। পঙ্ক্তিগুলো কখনও আপনার লেখা, আবার কখনও অন্যের। এ থেকে কি বার্তা দিতে চান? হারুন পাশা : এগুলো গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়। গল্প-উপন্যাসের প্লটের সঙ্গে মিশে গিয়ে নির্ধারিত বিষয়ে পাঠককে তথ্য দেয় কিংবা নির্ধারিত বিষয়কে পোক্ত করে। আমার সাহিত্যে ব্যবহৃত কবিতা, ছড়া, গান, প্রবাদ প্রত্যেকটি মিনিংফুল। চরিত্রের বক্তব্যকে সমৃদ্ধ করে এবং তাদের অপ্রকাশিত কথা প্রকাশ করে। ‘হয় নতুন স্বর তৈরি করো, না-হয় গোল্লায় যাও। লেখালেখি ছেড়ে ব্যবসা কর। সংসার কর’। আপনার এই উচ্চারণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। আপনি নিজস্ব স্বর, বাঁক বা উচ্চারণ করতে পেরেছেন বলে আমরা পাঠক এবং বাংলা সাহিত্যের আলোচকরাও স্বীকার করেন। এ বিষয়ে আপনার ভাবনা বিস্তারিত জানতে চাই। হারুন পাশা : সাহিত্যে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে নতুন স্বর তৈরি করা জরুরী। নিজের বলার ভঙ্গি থাকা জরুরী। নিজস্বতা না-থাকলে পরনির্ভরতা নিয়ে বেশিদিন লাস্টিং করা যায় না। আমাদের সাহিত্যে যাঁরা স্থায়ী আসন নিয়ে আছেন তাঁরা প্রত্যেকেই নতুন স্বর কিংবা প্রকরণরীতি নির্মাণ করেছেন বলেই টিকে আছেন। এবং আজ অবধি আমাদের মনোযোগ ধরে রাখতে পেরেছেন। নইলে তারা হারিয়ে যেতেন। নতুন কিছু সাহিত্যে যোগ করতে না পারলে টিকে থাকা দুরূহ। এজন্য ওই কথা বলেছি।
×