ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চলছে মাঠ পর্যায়ে মোটিভেশন

বাল্যবিয়ে রোধে কাজীদের সচেতন করতে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে

প্রকাশিত: ২৩:২৮, ২ ডিসেম্বর ২০২১

বাল্যবিয়ে রোধে কাজীদের সচেতন করতে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে

সমুদ্র হক ॥ দেশে এই প্রথম বাল্য বিয়ে রোধে সরকার জাতিসংঘের সহায়তায় মুসলিম ও হিন্দু ম্যারেজ রেজিস্ট্রারদের (কাজী) বিশেষ প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এছাড়াও বিয়ে ও বাল্যবিয়ের যে জটিল বিষয়গুলো আছে তা উপস্থাপন এবং সুষ্ঠুভাবে নিরসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিয়ের বিভিন্ন বিষয় এখনও অনেকের অজানা। যার কিছু অংশে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। বিষয়গুলো সুধীজনকে জানাতে, সচেতন করতে এবং প্রতীকারে মাঠ পর্যায়ে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচীও নেয়া হয়েছে। সরকারীভাবে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) সহযোগিতায় ও কনসার্নড উইমেন ফর ফ্যামলি ডেভলপমেন্টের (সিডাব্লিউএফডি) আয়োজনে দেশজুড়ে প্রতিটি জেলায় পর্যায়ক্রমে এই কর্মসূচী বাস্তবায়িত হচ্ছে। বগুড়া মুসলিম ম্যারেজ রেজিস্ট্রার কল্যাণ সমিতির সচিব কাজী মুহঃ মুন্জুরুল হক জানান, কোভিড-১৯ কালে অনেক বিয়ে রেজিস্ট্রেশন হয়নি। চরাঞ্চলে এবং নিভৃত গ্রামে অনেক বাল্যবিয়ে হয়েছে (এখনও হচ্ছে)। বিয়েগুলো হয়েছে মৌলভীদের দ্বারা বর ও কনের মুখে শুধু কবুল পাঠ করিয়ে। বিয়ে আইনে রেজিস্ট্রেশন না থাকায় এসব বিয়ের আইনগত ভিত্তি নেই। কোভিড-১৯ এর সুযোগে গ্রামের অনেক অভিভাবক বাল্য বিয়ে দিয়েছেন। তবে সচেতন মানুষ করোনাকালে ছেলেমেয়েদের রেজিস্ট্রি বিহীন বিয়ে দেননি। যে কারণে বর্তমানে প্রতিটি এলাকায় বিয়ে অনুষ্ঠানের হার বেড়েছে। শীত মৌসুমে বিয়ে আয়োজনের হার বেশি। গোপনে কিভাবে বাল্যবিয়ে হচ্ছে এই বিষয়ে খোঁজখবর করে জানা যায়, কখনও আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে কখনও কাজীদের নিয়োজিত সহকারীদের (সাব কাজী) অসাধুতা ও দুর্নীতির মাধ্যমে বাল্যবিয়ে হচ্ছে। নাম প্রকাশ করতে না চেয়ে এক সূত্র জানান, প্রত্যেক কাজী অফিসে বিয়ে, তালাক এবং মহরানা খরপোস আদায়ের কম্প্রোমাইজের তিন ধরনের ফর্মের বই থাকে। বিয়ের (নিকাহনামা) ফরমের প্রতিটি এক শ’ পাতার বই থাকে বেশি। এই বই পেতে জেলা রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে ইন্সপেক্টর জেনারেল রেজিস্ট্রারের (আইজিআর) কাছে চাহিদা পাঠানো হয়। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে চালানের ফি জমা দিতে হয়। বই অনুমোদন হয়ে এলে আঞ্চলিক ফরম্স অফিসে গিয়ে বই আনতে হয়। এক্ষেত্রে অনেক অসাধু কাজী বেশি চাহিদাপত্র পাঠান। তার মাধ্যমে সাব কাজী কিছু বই কিনে নেয়। মাঠ পর্যায়ে এই সাব কাজী বাড়তি অর্থের বিনিময়ে গোপনে ভুল তথ্যে কথিত বাল্য বিয়ে রেজিস্ট্রি করেন। ওই ফরমে কাজীদের ভুয়া নাম নকল সিল থাকে। পরবর্তী সময়ে ছেলে ও মেয়ের জন্ম সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিয়ে বিভ্রাট ঘটলে থলের বিড়াল বের হয়ে আসে। তখন ভবিষ্যত প্রজন্মের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। এদিকে কোভিড-১৯ সুযোগে শুধু মৌলভী ডেকে এনে যে বাল্যবিয়ে হয়েছে তারা বিপাকে পড়ছে। কারণ এই বিয়ের আইনগত ভিত্তি নেই। বর্তমানে এসব বিয়ে আয়োজনের অভিভাবকগণ কথিত বিয়ের রেজিস্ট্রেশন করার জন্য কাজীদের কাছে যাচ্ছেন। এখানেও বিপত্তি ঘটছে। কাজী সাহেবগণ বয়স প্রমাণে জন্মসনদ অথবা এনআইডি কার্ড দেখতে চাইছেন। একজন কাজী সাহেব জানালেন বাল্য বিয়ে দেয়ায় কোন অভিভাবক যদি মনে করেন মেয়ের ১৮ বছর ও ছেলের ২১ বছর পূর্ণ হলে রেজিস্ট্রি করাবেন তাহলেও বিপাকে পড়বেন। কারণ বিয়ে রেজিস্ট্রির আগে সন্তান জন্মগ্রহণ করলে অন্য ধরনের বিপাকে পড়তে হবে। দেশের অনেক মানুষ বিশেষ করে গ্রামের মানুষ এই বিষয়গুলোতে সচেতন নয়। বাল্য বিয়ে রোধে বিষয়গুলো সামনে এনে সাধারণের মধ্যে উদ্বুদ্ধকরণের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। মুসলিম ম্যারেজ রেজিস্ট্রার মনজুরুল হক জানান, কোন এলাকায় বাল্য বিয়ে রোধে সরকারী কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধি ব্যবস্থা নেন। তারপর বাল্য বিয়ের বরকনের অভিভাবক নকল জন্ম সনদ তুলে অন্য এলাকায় কাজী অফিসে গিয়ে দুইজন স্বাক্ষী সংগ্রহ করে বিয়ে রেজিস্ট্রি করেন। এক্ষেত্রে আইনের ফাঁকফোকর হলো-জেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের সরকারী নিযুক্ত কাজী তার এলাকার বাইরে গিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে পারবেন না। তবে অন্য এলাকার বরকনে দুইজন স্বাক্ষী ও অভিভাবক নিয়ে কোন কাজী অফিসে গেলে সেখানে বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে পারবেন। এই সুযোগ অনেকেই নিচ্ছে। বর্তমানে যে বিয়ে রেজিস্ট্রি হচ্ছে তা অনলাইনে লিপিবদ্ধ হয়। বিয়ে তালাক ও কম্প্রোমাইজের তিন ধরনের ফরম থাকে কাজী অফিসে। বিয়ের (নিকাহনামা) ফরমের বই ‘এ’ ক্যাটাগরির। এই বই বেহাত হয়ে গেলে বাল্যবিয়ে ও দুর্নীতির বিয়ে বেড়ে যায়। ‘বি’ এবং ‘ডি’ ক্যাটাগরির বই যথাক্রমে ছেলে মেয়েকে এবং মেয়ে ছেলেকে তালাক দেয়ার রেজিস্ট্রি বই। ‘সি’ ক্যাটাগরির বই বিচ্ছেদের পর মহরানা ও খরপোস আদায়ের রেজিস্ট্রি বই। কম্প্রোমাইজের বিষয়টি দিনে দিনে জটিল আকার ধারণ করছে। বিচ্ছেদের পর কোনপক্ষ কে কিভাবে খরপোস দেবে কিভাবে মহরানার অর্থ আদায় হবে এ নিয়ে সুষ্ঠু সমাধানে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। কখনও বিষয়টি নিয়ে আইনী মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আবার মহরানার ফি এমনভাবে ধার্য হয়েছে যা ধনীদের স্বার্থ হাসিল হরা হচ্ছে। চার লাখ টাকা পর্যন্ত মহরানার সরকারী ফি ৫ হাজার টাকা। এরপর প্রতি লাখে মহরানার ফি এক শ’ টাকা করে বাড়বে। ধরা যাক মহরানা ধার্য হলো দশ লাখ। তাকে সরকারী ফি দিতে হবে ৫ হাজার ৬শ’ টাকা। দেশে হিন্দু ম্যারেজ রেজিস্ট্রার নিয়োগ হয়েছেন ২০১৩ সালে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সাত পাকে বেঁধে বিয়ের মন্ত্র পাঠ করান পুরোহিত। অতীতে তাদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশন হয়নি।
×