ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের প্রথম বর্জ্য বিদ্যুত কেন্দ্র অবশেষে বাস্তবায়ন হচ্ছে

প্রকাশিত: ২৩:২১, ২ ডিসেম্বর ২০২১

দেশের প্রথম বর্জ্য বিদ্যুত কেন্দ্র অবশেষে বাস্তবায়ন হচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অবশেষে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছেন রাজধানীর উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) বাসিন্দারা। এতদিন শুধু আলোচনা এবং পর্যবেক্ষণ পর্যায়ে থাকলেও এবার বাস্তবে রূপ পেতে যাচ্ছে দেশের প্রথম বর্জ্য থেকে বিদ্যুত তৈরি প্রকল্প। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অধীনে সাভারের আমিনবাজারে প্রায় ৩০ একর জায়গাজুড়ে হবে এ ‘৪২.৫ মে.ও. বর্জ্য বিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্প’। এ লক্ষ্যে চীনা কোম্পানি ‘চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন’ এর সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয়েছে ৪টি চুক্তি। শুধু আমিনবাজারেই নয় দেশজুড়ে এ রকম অন্তত আরও ৪টি বর্জ্য বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের বর্জ্য নিঃসরণ নিয়ে তৈরি হওয়া সব ধরনের জটিলতার অবসান হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বৃহৎ এই কর্মসূচীকে বাস্তবে রূপ দিতে বুধবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে চায়না প্রতিষ্ঠান সিএমইসি’র সঙ্গে ৪টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ সময় জানানো হয়, দেশে এটিই প্রথম এই জাতীয় প্রকল্প। ৪২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুত কেন্দ্রটির নির্মাণ কাজ করবে চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন (সিএমইসি)। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৩২৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। গতবছরের ১২ নবেম্বর সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত কমিটিতে চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। জানা যায়, বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড এবং প্রক্রিয়াকরণ কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে প্রাইভেট সেক্টর পাওয়ার জেনারেশন পলিসির আওতায় বিওও ভিত্তিতে আইপিপি হিসেবে চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন (সিএমইসি) ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ৪২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার বর্জ্য বিদ্যুতকেন্দ্রে ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট’ এর ভিত্তিতে ইনসিনারেশন পদ্ধতিতে বিদ্যুত উৎপাদন করবে। যা আর্থিক সমাপনী হিসাবের চূড়ান্তকরণের দিন থেকে ২৪ মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। ২৫ বছর মেয়াদী এ চুক্তির প্রেক্ষিতে স্পন্সর কোম্পানি নিজ ঝুঁকিতে প্লান্ট স্থাপন, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বহন এবং বিদ্যুত বিভাগের কাছে উৎপাদিত বিদ্যুত বিক্রির মাধ্যমে তাদের ব্যয় নির্বাহ করবে। এতে সিটি কর্পোরেশন প্লান্ট স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জমির সংস্থান এবং নিয়মিত বর্জ্য সরবরাহ করবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, প্লান্টটি চালু হলে সেখানে প্রতিদিন ৩ হাজার টন বর্জ্য সরবরাহ করতে হবে। এ পরিমাণ বর্জ্য সরবরাহ করতে না পারলে উত্তর সিটি কর্পোরেশনকে প্রতি টন ঘাটতি বর্জ্যরে জন্য ১ হাজার টাকা হারে স্পন্সর কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। যেহেতু প্রতিদিন ৩ হাজার টন বর্জ্য প্রয়োজন হবে তাই এ পরিমাণ বর্জ্য সংগ্রহ করতে হলে আর যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকবে না। এ প্রক্রিয়ায় বর্জ্য প্রায় সম্পূর্ণরূপে দহন করে বর্জ্যরে আয়তন প্রায় ৯০ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব এবং এর ফলে বর্জ্য ফেলার জমির চাহিদাও হ্রাস পাবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদ্যুতকেন্দ্র ইনসিনারেশন প্রযুক্তি প্রয়োগে বর্জ্যরে দহনের মাধ্যমে সৃষ্ট গ্যাসীয় নিঃসরণ মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। গ্রহণ করা হবে ইইউ/২০১০/৭৫ ইইউ মানদণ্ড যা বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭-এর মানদণ্ড থেকে বেশি পরিবেশবান্ধব এবং বর্তমানে উন্নত দেশগুলোতে অনুসরণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটির সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে দেশের সব সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও জেলা পর্যায়ে ইনসিনারেশন পদ্ধতিতে বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উৎপাদন করবে সরকার। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী, উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম। এ সময় মন্ত্রী বলেন, এই বাস্তবায়ন হলে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় এ রকম প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ঢাকা শহরের অন্যতম সমস্যা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ গ্রহণ করি। বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য দফায় দফায় সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা এবং অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সভা করেছি। এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের লক্ষ্যে যেসব দেশ বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উৎপাদন করছে এমন বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করার পাশাপাশি এ বিষয়ে অভিজ্ঞ দেশী-বিদেশীদের মতামতও নিয়েছি। এই প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়ন হলে দেশের সব সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা এবং জেলা পর্যায়ে ইনসিনারেশন পদ্ধতিতে বিদ্যুত উৎপাদন করবে সরকার। আর এর মাধ্যমে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের জন্য নতুন দ্বার উন্মোচন হতে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, কঠিন এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যেকোন চ্যালেঞ্জ নিতে রাজি হয়েছে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। এর জন্য তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। এই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হলে দেশের বিদ্যুত খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে বলে আমরা মনে করছি। তিনি বলেন, বর্তমানে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে যে পরিমাণ বিদ্যুত উৎপাদিত হচ্ছে তা যথেষ্ট নয়। জল, সৌর ও বায়ু থেকে ইতোমধ্যে বিদ্যুত উৎপাদিত হচ্ছে। আর এবার বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো। এতে করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য থেকে চীনা কোম্পানি নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মোচন করবে বলে আমি মনে করি। এ সময় ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, এর মধ্যে আমাদের নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলোতে পুরোদমে বর্জ্য সংগ্রহ শুরু করব শীঘ্রই। আমাদের এখন বিপুল পরিমাণ বর্র্জ্য আমিনবাজারে রয়েছে। এছাড়া সাভার থেকেও ময়লা সংগ্রহ করতে পারি। আমাদের ময়লার কোন ঘাটতি হবে না। তিনি বলেন, দায়িত্ব নেয়ার পরপরই আমরা এটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মোতাবেক আমরা কাজ করছি। এর বাস্তবায়নে যেকোন চ্যালেঞ্জ নিতে আমরা প্রস্তুত আছি। এ সময় বিদ্যুতের ক্রয় সংক্রান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের সচিব সাইফুল ইসলাম ও চায়না সিএমইসি’ ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ওয়াং পেংফি, বর্জ্য সরবরাহকরণ এবং ভূমি ব্যবহারের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ সেলিম রেজা, ও ওয়াং পেংফি, প্রকল্প বাস্তবায়ন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী, উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব মোহাম্মদ নূর-ই-আলম সিদ্দিকি, বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুত বিভাগের যুগ্ম-সচিব মোহাম্মদ নাজমুল আবেদিন, পাওয়ার গ্রীড কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ লিমিটেডের কোম্পানি সেক্রেটারি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আজাদ এবং সিএমইসি’র ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ওয়াং পেংফি।
×