ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নয়নে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২৩:১১, ২ ডিসেম্বর ২০২১

উন্নয়নে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই সময়ে উন্নয়নে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে সব সূচকে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। পোশাক শিল্পের অগ্রগতি, দারিদ্র্য নিরসন, কর্মক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি এবং দ্রুত নগরায়ণের ফলে এই সাফল্য এসেছে। এছাড়া উন্নয়নে পাকিস্তান ও ভারতে আঞ্চলিক বৈষম্য থাকলেও বাংলাদেশের সর্বত্র সমানভাবে এগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে দেশের জনগণ। অন্যদিকে পাকিস্তান নানা কারণে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বুধবার রাজধানীর লেকশোর হোটেলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলন-২০২১ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় ‘বাংলাদেশ ইন কমপারেটিভ পার্সপেক্টিভ প্রতিবেদন’ প্রকাশ করে সংস্থাটি। প্রতিবেদনটির বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন বিআইডিএস মহাপরিচালক ড. বিনায়েক সেন। এছাড়া অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক ডেপুটি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম। এছাড়া বিভিন্ন অধিবেশনে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহান, বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন, প্রফেসর ড. এসআর ওসমানি প্রমুখ। ড. বিনায়ক সেন বলেন, ভারতের তামিলনাড়ু, কর্নাটক, কেরল যেভাবে এগিয়েছে, একইভাবে উত্তর প্রদেশ ও বিহার সেভাবে এগোয়নি। এটা যেন ভারতের মধ্যে অন্য ভারত। ব্যাপক আঞ্চলিক বৈষম্য রয়েছে। আবার পাকিস্তানের ইসলামাবাদে যে উন্নয়ন হয়েছে সেভাবে বেলুচিস্তানে হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে এমন বৈষম্য নেই। দেশ স্বাধীনের আগে যেমন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য ছিল। এখন সেরকম নেই। তবে কুড়িগ্রামের দারিদ্র্য আর নারায়ণগঞ্জের দারিদ্র্য এক নয়। এটা হয়েছে এলাকার কারণে। যেমন- নদী ভাঙ্গা, উপকূলীয়, হাওড় এবং পাহাড়ী অঞ্চলে যেভাবে উন্নয়ন হওয়ার কথা সেভাবে হয়নি। এটা করাটাও কঠিন। অবস্থান ও প্রাকৃতিক কারণেই সেটা সম্ভব হয়নি। তবে সরকার এসব এলাকা উন্নয়নে কাজ করছে। বাংলাদেশের সামাজিক সূচক অনেক ভাল। তিনি বলেন, নানা সূচকে ভারত-পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। নগরায়ণ, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। এসব দেশে যেভাবে আঞ্চলিক বৈষম্য রয়েছে, বাংলাদেশে নেই। প্রতিবেদনে বলা হয়, উৎপাদন খাতে ভারত ও পাকিস্তান থেকে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ফলে মাথাপিছু আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, নগরায়ণ ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে দেশ দুটি। গত ৩০ বছরে বিশেষ করে ৯০ দশকের পর থেকে ভারত-পাকিস্তানের থেকে নানা খাতে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মাথাপিছু আয়ে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলা বাংলাদেশ ভারতের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ হারে বাড়ত অথচ এখন এটা ৫ দশমিক ০৩ শতাংশ হারে বাড়ছে। ১৯৯০ সালে ভারতের মাথাপিছু আয় ৩ দশমিক ২৬ হারে বাড়ত এখন কমে ১ দশমিক ১৪ হার হয়েছে। একইভাবে নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এটা এখন আরও কমে ০ দশমিক ৮৬ শতাংশ হয়েছে। মাথাপিছু আয়ে ৯০ দশকে পাকিস্তানের চেয়ে ৪৫ শতাংশ পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ। অথচ এখন পাকিস্তানের চেয়ে মাথাপিছু আয়ে ১০ শতাংশ এগিয়ে। উৎপাদন খাতে ভারত-পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নব্বইয়ের দশকে এ খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি ছিল ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। এখন হয়েছে ১৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অথচ উৎপাদন খাতে প্রতিনিয়ত পিছিয়ে যাচ্ছে ভারত-পাকিস্তান। একই সময়ে ভারতে উৎপাদন খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ। এখন কমে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৯৬ শতাংশ। একইভাবে উৎপাদন খাতে পাকিস্তান পিছিয়ে যাচ্ছে। ৯০ দশকে এ খাতে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ এখন কমে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এছাড়া নগরায়ণেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের নগরায়ণ হার ছিল ১৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। এখন বেড়ে হয়েছে ৩৪ দশমিক ১৭ শতাংশ। ভারতে একই সময়ে নগরায়ণের হার ছিল ২৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এখন দাঁড়িয়েছে ৩৪ দশমিক ৯২ শতাংশ। পাকিস্তানের নগরায়ণে সেভাবে অগ্রগতি নেই। নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তানে নগরায়ণ হার ছিল ৩০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এখন হয়েছে ৩৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। ফলে বাংলাদেশে নগরায়ণ বেড়ে চলেছে ভারত-পাকিস্তানের তুলনায়। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে ॥ ভারত-পাকিস্তানকে বাংলাদেশ পেছনে ফেলার অন্যতম কারণ কর্মসংস্থানে নারীর উপস্থিতি বেড়েছে। ৯০ দশকে বাংলাদেশে কর্মসংস্থানে নারী উপস্থিতির হার ছিল ২৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ। একই সময়ে ভারতে নারীর উপস্থিতি ছিল ৩০ দশমিক ২৭ শতাংশ। এখন কমে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তানে কর্মক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি ছিল ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এখন হয়েছে ২২ দশমিক ৬৩ শতাংশে। অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, গ্রামীণ সড়ক উন্নয়ন, কমিউনিটি ক্লিনিক, হাওড় উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন প্রকল্পে মন্ত্রণালয় থেকে বেশি নজর দেয়া হচ্ছে। এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। এসব কারণে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ যেসব প্রকল্প সমাজ ও দেশকে এগিয়ে নেবে সেগুলোকে উপরে রাখছি। বিআইডিএস স্বাধীনভাবে কাজ করছে। কোন হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে না। ড. মসিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। জাতির জনকের কন্যার হাত ধরে তাঁর নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের আজকের উন্নয়ন বঙ্গবন্ধু সুদূর প্রসারী চিন্তার ফসল। কেননা দেশ স্বাধীনতার পরপরেই তিনি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ খুঁজেছেন। সেই সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে। অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, পোশাক শিল্পের হাত ধরে বাংলাদেশ অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। বেসরকারী উদ্যোক্তারা এক্ষেত্রে সফল ভূমিকা পালন করেছেন। গত ৪০ বছরে ওষুধ, চামড়া, শিপবিল্ডিং ও সিরামিকসহ বিভিন্ন শিল্প বিকাশ লাভ করেছে। রফতানি ক্ষেত্রে বহুমুখীকরণ করতে হবে। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্র্যাকসহ এনজিওগুলো ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়তা করেছে। সেইসঙ্গে সামাজিক ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছে। তবে এর মধ্যে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তির উন্নয়ন ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবেলা করা। এক্ষেত্রে এখনই বাংলদেশকে প্রস্তুতি নিতে হবে। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেন, দেশের দারিদ্র্য নিরসনে অগ্রগতি হলেও আয় বৈষম্য বেড়েছে। দেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে এখনই নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।
×