ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দু’জনার ছাড় দেয়ার মন

প্রকাশিত: ২১:১৪, ২ ডিসেম্বর ২০২১

দু’জনার ছাড় দেয়ার মন

বিবাহ বিচ্ছেদ বর্তমান সমাজে একটি মারাত্মক ব্যাধি হয়ে গেছে। ছেলেবেলার সেই চড়ুইভাতি খেলার মতো। ইচ্ছে হলো খেলতে শুরু করলাম। ভালো লাগছে না - বাদ দিয়ে দিলাম। শিক্ষিত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই ইদানীং এই বিচ্ছেদ বেশি হচ্ছে। অন্য নারীর সংগে স্বামীর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সামাজিক বন্ধনমুক্ত থাকার প্রবণতাসহ বিভিন্ন কারণে শিক্ষিত ও স্বচ্ছল নারীরাই বেশি তালাকের আবেদন করে থাকেন। সম্পূর্ণ ভিন্ন মন-মানসিকতার দু’জন মানুষ বিয়ের মাধ্যমে একত্রে বসবাস করে। দু’জনেই দু’জনকে কিছু ছাড় দিলে কোন জটিলতা থাকে না। কিন্তু আমাদের সমাজে বাড়ির বউকেই যত ছাড়, যত মানিয়ে নেয়া সব করতে হয়। মেয়েদের এমনিতেই পুরোটা জীবন ছাড় দিতে হয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা পরিবেশে এসে অচেনা কিছু মানুষকে আপন করে সারাজীবন তাদের সাথে থাকার জন্যে নিজেকে তৈরি করতে হয়। যা কোন ছেলেকে করতে হয় না। অনেক ছেলে বউকে মানুষ হিসেবেই মূল্যায়ন করে না। বউ মানে সংসার সামলানোর একটা যন্ত্র। আবার কখনো মেয়েটাও নিজেকে কিছু ছাড় দিতে হবে, তা মানতে চায় না। ফলে শুরু হয় পারিবারিক দ্বন্দ্ব। আগে আমাদের দাদী-নানীদের সময়ে বাড়ির বউদের কোন মূল্যায়নই ছিল না। তারা মুখ বুজে অনেক অন্যায় অত্যাচার সহ্য করেছে। এখন ধীরে ধীরে নারীরা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। ফলে বেড়েছে বিবাহ বিচ্ছেদ। কেউ আর এখন এত ছাড় দিয়ে, এত অত্যাচার সহ্য করে সংসার টিকিয়ে রাখতে নারাজ। সেটা হতে পারে আমাদের ধৈর্য্যশক্তি কমে গেছে। হতে পারে আমাদের সচেতনতাও বেড়েছে। পড়ে পড়ে মার খেয়ে, লোকলজ্জা আর মান-সম্মানের ভয়ে কেউ আর অশান্তি আর কষ্টের জীবন টেনে নিতে চায় না। তাই বেড়েছে বিবাহ বিচ্ছেদ। একটা সময় ছেলে-মেয়েরা ‘ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান’ বলে আখ্যা পাবে ভেবে দিনের পর দিন স্বামীর নির্যাতন সহ্য করে মেয়েরা সংসার টিকিয়ে রাখত। হয়ত তাই বলা হত- ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’। রমণীরা এখন আর এমন সনাতন অর্থে ‘গুণবতী’ হতে চায় না। বেশীরভাগ মেয়েই এখন শিক্ষিত, স্বনির্ভর। এক্ষেত্রে অনেক সময় স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর কর্মক্ষেত্রে বেশী যোগ্যাতার ফলে স্বামীরা হীনম্মন্যতায় ভোগে। তাতেও শুরু হয় দ্বন্দ্ব। সূত্রমতে, আবেদনের প্রায় ৭০ শতাংশ বিবাহ বিচ্ছেদই মেয়েদের পক্ষ থেকে হচ্ছে। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে তালাকের ঘটনা বেড়েছে ১৭ শতাংশ। প্রায় সব আবেদনেরই কারণ ছিল বনিবনা না হওয়া। পরিসংখ্যান থাকুক আর না থাকুক, স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ হলে সবচেয়ে বড় প্রভাব গিয়ে পড়ে তাদের সন্তানদের ওপর। ভেঙে যাওয়া পরিবারগুলোর সন্তানদের বেড়ে উঠতে হয় অনেকটাই বিচ্ছিন্নভাবে, একা একা। এক্ষেত্রে সন্তানের দায়িত্ব মায়েরা নিলেও যখন সে আবার বিয়ে করে বাচ্চাটা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। একদিকে বাবা মাকে একসাথে না পাওয়ার কষ্ট, অন্যদিকে নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ- সব মিলিয়ে বাচ্চাটা হয়ে পড়ে অসহায়। ফলে তাদের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ বা সামাজিকীকরণের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। বাবা-মায়ের হাত ধরে বেড়ে ওঠা প্রতিটি সন্তানের জন্মগত অধিকার। এটাই প্রকৃতিগত নিয়ম। কিন্তু যখন বাবা-মায়ের মধ্যে ডিভোর্স হয়, ঘুম থেকে চোখ মেলে তার পাশে বাবা বা মা’কে দেখে না, তখন তারা স্বভাবতই মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়। কারণ যাই হোক, বিবাহবিচ্ছেদ সন্তানদের জীবনে কুৎসিত ও অবাঞ্ছিত দাগ ফেলে। প্রতিটা শিশুর জন্য তাদের জীবনে বাবা-মায়ের উপস্থিত থাকা গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিবাহবিচ্ছেদকে একপাশে রেখে প্রতিটি পিতা-মাতার উচিত নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এড়ানো বা সন্তানকে এর বাইরে রাখা। রামপুরা, ঢাকা থেকে
×