ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ স্বাধীনতার সুবণৃ জয়ন্তী

বিজয়ের গৌরবগাথা ॥ মুক্তি সংগ্রামের গ্রীন সিগন্যাল

প্রকাশিত: ২১:১১, ২ ডিসেম্বর ২০২১

বিজয়ের গৌরবগাথা ॥ মুক্তি সংগ্রামের গ্রীন সিগন্যাল

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সত্যিকার অর্থে একটি অনন্য জনযুদ্ধ বা চPeople’s War। সারাবিশ্বের ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অধিকার বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের এক ঐতিহাসিক ত্যাগের সংগ্রাম। এই জনযুদ্ধের মহানায়ক জাতির পিতা, বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাঁর সুদূরপ্রসারী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বে সমগ্র জাতি একতাবদ্ধ হয়েছিল। সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছে কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ছাত্রাবস্থা থেকেই গণমানুষের দাবি আদায়ের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানী শাসকদের এ জনপদের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার যে অপকৌশল চলছিল, বঙ্গবন্ধু তা যথার্থ উপলব্ধি করতে পেরে সমগ্র জাতিকে নিয়ে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। হয়ে ওঠেন এ জনপদের নিপীড়িত, নিষ্পেষিত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালী জাতির জন্য অনুপ্রেরণামূলক। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ঘোষণা মুক্তিকামী জনসাধারণের কাছে গ্রীন সিগন্যাল বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডের পৃষ্ঠা ৪ ও ৫-এ ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ শীর্ষক স্বাধীনতার সনদ সন্নিবেশ রয়েছে। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর এবং ১৯৭১ সালের জানুয়ারি ও মার্চ মাসে সমগ্র পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গে এককভাবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা জয়লাভ করে। নির্বাচিত আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা অর্পণ না করে পাকিস্তানী সামরিক চক্র পূর্ববঙ্গের নিরস্ত্র বাঙালী জাতির ওপর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের লেলিয়ে দেয়। এতে লাখ লাখ নিরীহ মানুষ শহীদ হন। প্রায় এক কোটি বাঙালী সীমান্ত সংলগ্ন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নেয়। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নির্বাচিত এমএনএ এবং এমপিএরা সীমান্ত অতিক্রম করে কৌশলগত স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন। ২৫ মার্চের ভয়াল রাতের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে প্রথমে ঝিনাইদহ যান। মার্চের ৩০ তারিখে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং পরে দিল্লীতে ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও সাক্ষাত করেন। তাজউদ্দীন আহমদ ভারতে অবস্থান গ্রহণকারী এমএনএ এবং এমপিএদের নিয়ে একটি গোপন স্থানে অধিবেশন আহ্বান করেন। তাঁরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়ায় তাদের ওই অধিবেশনের আইনগত ভিত্তি ছিল। তাঁরাই গণপরিষদ গঠন করেন এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ওই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ এবং সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। অধিবেশনে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। নিযুক্ত করা হয় মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য। এভাবে ১০ এপ্রিল সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিসভা গঠনের কথা বিশ্ববাসীকে অবহিত করেন। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ১৭ এপ্রিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত সংলগ্ন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শত শত দেশী-বিদেশী সাংবাদিক এবং উপস্থিত জনগণের সামনে শপথ গ্রহণ করেন। সেদিনের সেই ঘোষণাপত্রই বাঙালী জাতির স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র গ্রন্থে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মুদ্রিত রয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভিত্তি ছিল ঢাকায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্বত্র প্রচারের জন্য চট্টগ্রামে প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণা। বার্তাটি ছিল নিম্নরূপ : ঞযরং সধু নব সু ষধংঃ সবংংধমব, ভৎড়স ঃড়ফধু ইধহমষধফবংয রং রহফবঢ়বহঃবহঃ. ও পধষষ ড়ঢ়বহ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ইধহমষধফবংয যিবৎব ধৎব ুড়ঁ সরমযঃ নব ধহফ রিঃয যিধঃবাবৎ ুড়ঁ যধাব, ঃড় ৎবংরংঃ ঃযব ধৎসু ড়ভ ড়পপঁঢ়ধঃরড়হ ঃড় ঃযব ষধংঃ. ণড়ঁৎ ভরমযঃ সঁংঃ মড় ড়হ ঁহঃরষ ঃযব ষধংঃ ংড়ষফরবৎ ড়ভ ঃযব চধশরংঃধহ ড়পপঁঢ়ধঃরড়হ ধৎসু রং বীঢ়বষষবফ ভৎড়স ঃযব ংড়রষ ড়ভ ইধহমষধফবংয ধহফ ভরহধষ ারপঃড়ৎু রং ধপযরবাবফ. (এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারির মোকাবেলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে)। স্বাধীনতার ঘোষণাবার্তার ভিত্তিতে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে অর্পিত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ‘আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়োগ আদেশ ১৯৭১’ জারি করেন। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে পর্যুদস্ত পাক হানাদার বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে। ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হয়। পাকিস্তানের কারাগারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্তরীণ থাকায় তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যগণ উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলেন। বাঙালী কূটনীতিকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বন্ধুভাবাপন্ন রাজনৈতিক নেতা এবং সাধারণ মানুষের দাবির মুখে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের সাংবিধানিক রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি একটি বিশেষ বিমানে লন্ডন যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। লন্ডন থেকে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরদিন অর্থাৎ ১১ জানুয়ারি (১৯৭২) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিসভার সঙ্গে হেয়ার রোডে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাসভবনে দু’দফা বৈঠক করেছিলেন। এই বৈঠকে শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতি তথা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সাময়িক সংবিধান আদেশ ১৯৭২ জারির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির সাময়িক সংবিধান আদেশ জারি হয়। ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ (পূর্বাহ্ন) রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিচারপতি আবু সাদাত মোঃ সায়েমকে সাময়িক সংবিধান আদেশের ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ করেন। ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ (অপরাহ্ন) প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে শপথ বাক্য পাঠ করান এবং এর পরপরই বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির পদ হতে পদত্যাগ করেন। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির পদ হতে পদত্যাগ ঘোষণা করার পর, সাময়িক সংবিধান আদেশের ৮নং ধারাবলে মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগদান করা হয়। অতঃপর প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করান। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী চৎড়ারংরড়হধষ ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হধষ ঙৎফবৎ ১৯৭২-এর ৭ ধারা বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগদান করেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং ১১ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার সদস্যগণ দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। এভাবেই প্রথম রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়। ১৭ এপ্রিল তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার সদস্যগণের শপথ গ্রহণ, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ভূখ-ে হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের স্বাধীন বাংলাদেশ পূর্ণতা লাভ করে। স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত দলিলপত্র, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ব্রিটেনের বিদেশ মন্ত্রকের অনেক গোপনীয় নথি ও প্রামাণ্য তথ্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রকৃত তথ্য-প্রমাণের উল্লেখ রয়েছে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং অসংখ্য মা-বোনের ত্যাগ ও অবিরাম সংগ্রামের মাধ্যমে এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ সারাবিশ্বে উন্নয়নের মডেল বলে পরিচিত লাভ করেছে। লেখক : গবেষক [email protected]
×