শংকর কুমার দে ॥ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অপরাধ পর্যালোচনা সভায় বলা হয়েছে, শীত মৌসুমে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অজ্ঞানপার্টি ইত্যাদি ধরনের অপরাধ বেড়ে যায়। এ ধরনের শীতের মৌসুমি অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক দৃষ্টি, পুলিশী টহল বৃদ্ধি, গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) মোহাঃ শফিকুল ইসলাম। ডিএমপি সূত্রের ভাষ্য, পুলিশের তালিকায় রাজধানীর ঢাকা মহানগরীর ৫০ থানা এলাকার ২ শতাধিক স্পটে অন্তত অর্ধশতাধিক সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী দলের ৩ শতাধিক সদস্য বেপরোয়া। ছিনতাইকারী চক্রের সঙ্গে রয়েছে চোর, ডাকাত, অজ্ঞানপার্টিসহ মৌসুমি অপরাধী চক্র। শীতের মৌসুমের শুরুতেই চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অজ্ঞানপার্টি ইত্যাদি ধরনের অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হবে। ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, ডিএমপির সদর দফতরে গত অক্টোবর মাসে অপরাধ পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ডিসেম্বর-জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে শীত থাকে। এ সময় ছিনতাই ও অজ্ঞানপার্টির দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। মৌসুমি অপরাধী চক্র সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য সংগ্রহেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শীত মৌসুমে রাজধানীতে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যায়। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাজধানীতে পুলিশী টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ডিএমপির আটটি ক্রাইম বিভাগ ও গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম।
ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের উপকমিশনার ফারুক হোসেন বলেছেন, চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন কমিশনার। সাধারণত শীতে এ ধরনের অপরাধ বেড়ে যায়। ডিএমপির অপরাধ পর্যালোচনা সভায় বলা হয় ঢাকা মহানগরীতে যেন কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। সেজন্য সকল উপপুলিশ কমিশনার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেন ডিএমপি কমিশনার।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা এখন মেগাসিটি। প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত রাজধানী ঢাকায় সুযোগ পেলেই ছিনতাইকারী চক্র ছোঁ মেরে জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিচ্ছে। মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত নগরীতে ছিনতাইয়ের অনেক ঘটনা ঘটেই। পথে পথে ওঁৎ পেতে থাকা ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা দিন-দুপুরেও ছিনতাই করে। সামনেই ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি-শীতের মাস। খুব ভোরে পুলিশী নিরাপত্তার ঢিলেঢালাভাব থাকার সুযোগটা নিচ্ছে ছিনতাইকারীরা। শীতের মধ্যরাত থেকে কোলাহলমুক্ত ভোরে বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছিনতাইকারীরা। ছিনতাইয়ের প্রতিবাদ করলে দুর্বৃত্তরা আগ্নেয়াস্ত্র কিংবা ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার করে। ছিনতাইকারীরা কখনও মোটরসাইকেল, কখনও প্রাইভেটকার বা মাইক্রোবাস নিয়ে পথচারী বা রাস্তায় অপেক্ষমাণ ব্যক্তির কাছ থেকে মূল্যবান সামগ্রী, ভ্যানিটি ব্যাগ, গলার চেন, মোবাইল ফোন সেট ছিনিয়ে নেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারির মাঝেও এ ঘটনা ঘটছে।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত ছিনতাইচক্রের তৎপরতা বেশি থাকে। নগরীর ৫০ থানার দুই শতাধিক স্থানে ছিনতাইচক্র তৎপর রয়েছে। ছিনতাইকারীরা ৩-৪ জন করে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে মূলত অপরাধ সংঘটিত করে। ছিনতাইয়ের কাজে বেশির ভাগ ছিনতাইকারী মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাস ব্যবহার করে। গোয়েন্দা সংস্থার ভুয়া পরিচয় দিয়ে ছিনতাইকারীরা নিরীহ সাধারণ মানুষের সর্বস্ব লুটে নেয়। তবে ছিনতাইয়ের শিকার অধিকাংশ মানুষ পুলিশের দ্বারস্থ হন না। আবার কেউ থানায় গেলেও মামলা না নিয়ে হারানোর জিডি হিসেবে এন্ট্রি করা হয়।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ওরা ভয়ঙ্কর ছিনতাইকারী। ওরা ছিনতাইয়ের ক্ষেত্রে কাউকে খুন করতে বুক কাঁপে না। ওরা অস্ত্র পরিচালনায় সিদ্ধহস্ত। ওদের টার্গেট মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, সিএনজি, অটোরিক্সার মতো যানবাহন ছিনতাই করা। ছিনতাইয়ের জন্য কখনও যাত্রীবেশে, কখনও বিয়ের জন্য গাড়ি ভাড়া করত ওরা। রাজধানী ঢাকার আশুলিয়ার কাঠগড়া পালোয়ান পাড়ার মোল্লা বাড়ির বাঁশঝাড় এলাকায় মোঃ শামীম বেপারি বাবু (২৮) নামে এক পাঠাও চালককে খুন করে মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে যায় ওরা। চাঞ্চল্যের এ হত্যাকান্ডের জঙ্গে জড়িত এই ছিনতাইকারী চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্ ্যা ব। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে মামুনুর রশিদ (২২), মাহবুবুর রহমান (২০) এবং মোমিন মিয়া (২০)। আশুলিয়া থানাধীন জামগড়ার রূপায়ন মাঠ এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ভিকটিম পাঠাও চালক শামীমের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও হত্যাকারীর রক্তমাখা প্যান্ট উদ্ধার করা হয় বলে পুলিশের দাবি।
র ্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, সংঘবদ্ধ পেশাদার ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা অন্যান্য ছিনতাইকারীর মতো টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন, স্বর্ণালঙ্কার ছিনতাই করেই ক্ষান্ত হয় না। এই চক্র মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, সিএনজি, অটোরিক্সার মতো ছোট যানবাহন ছিনতাই করে। ছিনতাই করা কালে ওরা মানুষ খুন করতে দ্বিধাবোধ করেন না। গ্রেফতারকৃত ছিনতাইকারীদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, দিনের বেলায় গার্মেন্টসকর্মী বা চায়ের দোকানদার কিংবা অন্য কোন পেশায় কাজ করে। রাতের অন্ধকার নেমে আসলে তাদের পেশা পাল্টে গিয়ে ছিনতাইকারী বনে যায়। এ ধরনের ছিনতাইকারী চক্র পরিকল্পিতভাবে ছিনতাই করে। প্রথমে তারা টার্গেট করে নির্ধারিত গন্তব্য ঠিক করে যানবাহনসহ চালককে নিয়ে যায়। যেখানে আগে থেকেই তাদের অন্য সহযোগীরা ওঁৎ পেতে থাকে। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছা মাত্র চালককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুন করে যানবাহন নিয়ে নিরাপদে সটকে পড়ে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, শীত মৌসুমে রাজধানীতে বেপরোয়া হয়ে উঠে ছিনতাইকারী চক্র। ছিনতাইকারী চক্র এতই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, এ দুর্বৃত্ত দলের সদস্যরা ছিনতাই কাজে বেড়ে গেছে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারও। এসব ছিনতাইকারী চক্র ছিনতাই কাজে ব্যবহার করছে মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল। ছিনতাইকারী চক্রের টার্গেট মহিলাদের ভ্যানিটিব্যাগ, ব্যাগভর্তি টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও মোবাইল ফোনসেট। রাজধানীর ৫০ থানাধীন এলাকার অন্তত ২ শতাধিক স্পটের যেসব স্থানে ছিনতাইকারী চক্র ওঁৎ পেতে থাকে। ছিনতাইকারী চক্রের টার্গেট হচ্ছে, সদরঘাট লঞ্চঘাট, কমলাপুর রেলস্টেশন, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, মহাখালী ও গাবতলী বাস টার্মিনালে যাতায়াতকারী যাত্রীরা। ভোরবেলার যাত্রীদের টার্গেট করছে ছিনতাইকারী চক্র। রাতভর মাদকসেবন করে ছিনতাইকারী চক্র কাকভোরে নামে ছিনতাইয়ে। ছিনতাই তো হচ্ছেই, বাধা দিলেই হতাহতের ঘটনা নিশ্চিত। রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম, উত্তরা পূর্ব থানা এলাকা, বাড্ডা, বনানী, খিলক্ষেত, ভাষানটেক, মিরপুর, পল্লবী, কাফরুল, দারুস সালাম, নিউমার্কেট, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, গুলিস্তান, রামপুরা, হাজারীবাগসহ মহানগরীর থানা এলাকায় অন্তত দুই শতাধিক ছিনতাইয়ের স্পটগুলোতে মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস ও অতর্কিত হামলা চালিয়ে নগদ টাকা ছিনতাই হচ্ছে।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, ডিএমপির আটটি ক্রাইম জোনে এসব ছিনতাইয়ের স্পট আর জায়গায় সক্রিয় রয়েছে ছিনতাইকারী চক্র। এর মধ্যে মোহাম্মদপুরের কলেজ গেট থেকে রিং রোড, কল্যাণপুর, গাবতলী থেকে মিরপুর-১, আগারগাঁও সংযোগ সড়ক, খিলক্ষেত থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়ক, কালশী রোড, মৌচাক মার্কেট থেকে মগবাজার, সদরঘাট থেকে সূত্রাপুর, সদরঘাট থেকে দয়াগঞ্জ, ওয়ারী, উত্তরা থেকে আব্দুল্লাহপুর, ঝিগাতলা থেকে রায়েরবাজার, ঝিগাতলা থেকে শংকর, মিরপুরের রূপনগর বেড়িবাঁধ, গুলিস্তান থেকে পল্টন, সার্ক ফোয়ারা থেকে রমনা পার্ক, কাঁটাবন থেকে নীলক্ষেত, পলাশী থেকে আজিমপুর এবং যাত্রাবাড়ীর দোলাইরপাড় থেকে শ্যামপুর এলাকায় টানা পার্টি বেশি সক্রিয়। এসবের মধ্যে রমনা, পল্টন, হাইকোর্ট মোড়, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর রোড, কাঁটাবন, এলিফ্যান্ট রোড ও মৌচাক এলাকায়ও সাদা গাড়ি নিয়ে টানা পার্টি সক্রিয়। ভুক্তভোগীরা বলছে, ভোরে রাস্তায় পুলিশের টহল থাকে না। নির্ধারিত চেকপোস্টেও থাকে না পুলিশ। কিছু এলাকায় রাতে ও ভোরে চেকপোস্ট থাকলেও সেখানে ট্রাফিক পুলিশের মতোই কেবল গাড়ির কাগজপত্র যাচাই করা হয়। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অবাধে অপরাধ করছে ছিনতাইকারীরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনার সুনির্দিষ্টভাবে পুলিশের কাছে সঠিক তথ্য বা পরিসংখ্যান নেই। কারণ ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া সত্ত্বেও মানুষ বাধ্য না হলে থানায় গিয়ে কোন অভিযোগ করেন না হয়রানি হওয়ার ভয়ে। অনেকে ছোটখাটো আঘাতপ্রাপ্ত হয়েও থানায় বিষয়টি অবহিত করেন না। ফলে ছিনতাই বৃদ্ধির বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও অনেকাংশে অজানা থেকে যাচ্ছে। পুলিশের কাছে যে পরিসংখ্যান আছে তাতে প্রতি মাসে রাজধানীতে ২০ থেকে ২৫টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। তবে আলোচ্য সময়ে বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকের হিসাব মতে, ছিনতাইয়ের প্রকৃত ঘটনা পুুলিশের হিসাবের চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি অর্থাৎ শতাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা ভ্যানিটি ব্যাগ, ব্যাগ, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকাসহ মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নিচ্ছে। ছিনতাইকারীর থাবায় পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন কেউ কেউ। রাজধানীর অন্তত দুই শতাধিক ছিনতাই স্পটে প্রায়ই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এসব ছিনতাইকারী চক্রের প্রত্যেকটি দলে ৫ থেকে ৭ জন করে সদস্য রয়েছে। যারা বিভিন্ন স্পটে শিকারের আশায় ওঁৎ পেতে দাঁড়িয়ে থাকে। এদের কেউ কেউ মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার নিয়েও সংশ্লিষ্ট এলাকায় টহল দিতে থাকে। বিশেষ করে ভোর বেলা লঞ্চ, বাস ও ট্রেনে করে যারা ঢাকায় আসছেন কিংবা ঢাকার বাইরে যান তাদের টার্গেট করা হয়। এছাড়া ট্রাফিক সিগন্যালে কিংবা ব্যস্ততম সড়কে যানজটের অপেক্ষায় থাকে ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা। শীত মৌসুমে ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চোর, ডাকাত ও অজ্ঞানপার্টি তৎপরতা শুরু করে।
পুলিশী টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি জোরদারের নির্দেশ
রাজধানীর দুই শতাধিক স্পটে বেপরোয়া ছিনতাইকারী চক্র
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: