ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দেশের সর্বপ্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ॥ সৈয়দপুর পাওয়ার হাউস নিশ্চিহ্নের পথে

প্রকাশিত: ১৮:০৮, ৩০ নভেম্বর ২০২১

দেশের সর্বপ্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ॥ সৈয়দপুর পাওয়ার হাউস নিশ্চিহ্নের পথে

সংবাদদাতা, সৈয়দপুর, নীলফামারী ॥ দেশের সর্বপ্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ কেন্দ্র সৈয়দপুর পাওয়ার হাউসটি দুষন ও লোকসানের অজুহাতে বিলুপ্ত করা হয়। পরিচর্যা না হওয়ায় এ প্লান্টটি এখন জঙ্গলাকীর্ন হয়ে পোকামাকড়ের আদর্শ বসতিতে পরিণত হয়েছে। এতে ইতিহাসের সাক্ষী নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। সৈয়দপুর রেলওয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ সুত্র মতে, ১৮৬৫ সালে রেলওয়ে কারখানা সৈয়দপুরে স্থাপন করেন। এতে এ শহরটি রেলওযের জনপদে পরিণত হয়। রেলওয়ে কারখানায় উৎপাদন ও শ্রমিকদের সুবিধার্থে সৈয়দপুর রেলষ্টেশনের পুর্ব দিকে রেলওয়ে আতিয়ার কলোনী সংলগ্ন এলাকায় ৮ একর জমির ওপর ১৮৮২ সালে নির্মিত হয় সৈয়দপুর রেলওয়ে পাওয়ার হাউস। কয়লা জ্বালিয়ে জেনারেটরের দ্বারা বাস্পের তাপের মাধ্যমে ৫ মেগাওয়াড বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হত। মুলত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে ১৮২০ থেকে ১৮৩০ এর দশকে প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদনের বুনিয়াদী তত্ত্ব আবিষ্কারের পর বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রে বৈদ্যুতিক জেনারেটরের সাহায্যে উৎপাদনের বিষয়টি নীরিক্ষন করা হয়। এই সফলতা এ শহরে রেলের গোড়াপত্তনকারী ব্রিটিশরা স্বদেশী গবেষকের আবিস্কার সংযোগ ঘটান দক্ষিন এশিয়ার এ দেশে। রেলের এ শহরে প্রথম জীবাস্ম পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করে। এ তাপ বিদ্যুতে কারখানার কর্তাবাবু কিংবা শ্রমিকদের সাইরেণ বাজিয়ে কাজে যোগদান, ছুটি, বিরতি সব কাজে ব্যবহার হত। যার শব্দ পৌঁছাত ৫ কিলোমিটার দুরে। এমনকি বিশেষ দিবসে এর উচ্চ আওয়াজের সাইরেন ব্যবহার হত। পাশাপাশি সৈয়দপুর রেলকারখানা, সেতুকারখানা, সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ পুরো শহর ও পার্বতিপুর লোকোমোটিভ কারখানা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মরতদের বাসাবাড়ি, প্রমোদখানাসহ সকল স্থাপনা আলোকিত হয় এ পাওয়ার হাউসের বিদ্যুতে। নির্বিঘেœ চলে রেলের উৎপাদন ব্যবস্থা। তবে পটপরিবর্তনে ১০৯ বছরে লোকসান আর পরিবেশ দুষনের কারণ দেখিয়ে বিলুপ্ত করা হয়। ১৯৯১ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার সমকালীন বাজার মুল্য প্রতি ইউনিট ২ টাকা ও কয়লায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যায় ১৪ টাকা দেখিয়ে এই পাওয়ার হাউসটি নাম মাত্র দরে বিক্রি করেন। সচল ৬০টি মটর, কয়লা ভাঙ্গা মেশিন, স্পেয়ার পার্টস, ৪টি বিশাল অলটানেটর জেনারেটর, ৬ টি ব্রয়লার, ২টিক্রেন, ৪টি টারবাইন, পানি শোধনাগার, ৬টি ট্রান্সফরমার, ট্রলি ও আনুসাঙ্গিক যন্ত্রপাতিগুলোকে ওজনে ২ হাজার টন হিসাবে প্রায় ৮০ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। অথচ এ সকল সচল মেশিন ও যন্ত্রপাতির তৎকালীন বাজার মুল্য ছিল প্রায় ১ হাজার কোটি টাকারও উর্ধ্বে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সৈয়দপুর রেলওয়ে পাওয়ার হাউসের সাবেক এক উর্ধ্বত্বন উপসহকারী প্রকৌশলী জানান, ১৯০১ সালে শুধু ঢাকায় প্রথম বিদ্যুতের আলো জ্বলে। তবে এ বিদ্যুৎ প্লান্টের মাধ্যমে তারও ১৯ বছর আগে সৈয়দপুরসহ পার্শ্ববতি পার্বতিপুর রেল শহর বিদ্যুতের আলোর যুগে প্রবেশ করে। আবার অনেকের অভিমত দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে সর্বপ্রথম এ দুই রেল এলাকা আলোকিত হয়েছিল। যা ইতিহাঁস। অথচ তৎকালীন সরকার ক্ষমতায় গিয়েই রেল ধ্বংসের প্রধম আঘাত হানেন সৈয়দপুর পাওয়ার হাউসকে বিক্রি করে। সরেজমিন দেখা যায়, ৬০ ফুট উচ্চতার পাওয়ার হাউসটির দ্বীতল ভবন। এর অভ্যন্তরে বিশালাকার ঘন জঙ্গল আর অচেনা গাছের বন ছাড়া কোন কিছুই নেই। যা পোকা মাকড়ের আদর্শ বসতি। সামনে সংরক্ষিত গভীর পানির আধার ১ একরের পুকুর। পাওয়ার প্লান্ট হতে মাটির নিচ দিয়ে সংযোগ পাইপটি কয়লার বাস্প দ্বারা তৈরী বিদ্যুতের সাক্ষ্য বহন করছে। উর্ধ্বত্বন উপসহকারী প্রকৌশলী চন্দন কুমার জানান, এখন আমরা নেসকোর গ্রাহক। ৩৩ কেভি নিয়ে স্টপ ডাউনে ১১ কেভিতে ৪৪০ ভোল্ট রুপান্তর করে সরবরাহ করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট রেলওয়ে এলাকায়। এতে কারখানার উৎপাদন ও বাসাবাড়িতে ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়া সাইরেনে মাত্র ৩ কিলোমিটার শব্দ যায়। কথা হয় সৈয়দপুর রেলওয়ের বিভাগীয় নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ খায়রুল আলমের সাথে। তিনি জনকন্ঠ’কে বলেন, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে নি:সন্দেহে সৈয়দপুর একটি ঐতিহাসীক স্থান। তবে এর সঠিক ইতিহাঁস সংরক্ষন নাই। তবে রেলওয়ের বিলুপ্ত বিদ্যুতের পাওয়ার প্লান্ট স্থানটিকে সংশ্লিষ্টরা পরিকল্পিত ভাবে এর সুষম ব্যবহার করলে রেলওয়ের গৌরবজ্জল ইতিহাঁস টিকে থাকবে।
×