ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আরও চার বিভাগীয় অফিস হচ্ছে

প্রকাশিত: ২২:২৩, ৩০ নভেম্বর ২০২১

প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আরও চার বিভাগীয় অফিস হচ্ছে

সমুদ্র হক ॥ প্রত্ন ও সাংস্কৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে বিদ্যমান আইনকে যুগপোযোগী করে তুলতে প্রায় ছয় বছর আগে ২০১৫ সালে খসড়া আইন তৈরি করা হয়। কথা ছিল, প্রত্ন বিষয়ক অভিজ্ঞ ব্যক্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক, সুধীজনের মতামতের ভিত্তিতে আইনের সংযোজন বিয়োজন করে মন্ত্রিসভার বৈঠকে উঠবে। তারপর আইনটি সংসদে পাস করা হবে। সূত্র জানায় খসড়া আইনটি কাগজ কলমে তৈরি হয়ে আছে। এদিকে দেশেপ্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের চারটি বিভাগীয় অফিসের সঙ্গে আরও চারটি বিভাগীয় অফিস স্থাপনের কাজ চলছে। এই বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের মহাপরিচালক রতন চন্দ্র পন্ডিত এই প্রতিবেদককে জানান, খসড়া আইনটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের কেবিনেটে আছে। সেখানে কাজ চলছে। একই সঙ্গে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কাজকে গতিশীল করতে বর্তমানে চারটি বিভাগীয় অফিসের সঙ্গে আরও চারটি বিভাগীয় অফিস স্থাপনের কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। শীঘ্রই প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর আটটি আঞ্চলিক অফিসকে প্রযুক্তিসহ সার্বিকভাবে আধুনিকায়নে যাত্রা শুরু করবে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার (রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ) আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা বলেন, যুগোপযোগী আইন না থাকায় প্রাচীন ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণে বিঘ্ন ঘটছে। অনেক প্রত্ন সম্পদ দুর্বৃত্তরা রাতে মাটি খুঁড়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ইতিহাসের চিহ্ন প্রত্নভূমির অনেক স্থাপনার কোনটি কেটে সমতল ভূমি বানিয়ে দখল করা হচ্ছে। ঐতিহ্যের সাংস্কৃতিক অনেক অবকাঠামো ভেঙ্গে রূপান্তর করা হচ্ছে। ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণীত আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে সম্পদ লুট হয়ে যাচ্ছে। প্রত্ন সম্পদ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় বিদ্যমান আইনকে যুগপোয়োগী করে তুললে দেশের ঐতিহ্য রক্ষা হবে। বিশ্বের পর্যটকদের আগমন পথ প্রশস্ত হবে। দেশে বর্তমানে ৫১৮টি প্রত্ন সাইট আছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝে মধ্যেই নতুন প্রত্ন সাইট উদ্ভাবিত হয়ে প্রত্ন সাইট বাড়ছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের লোকবল বাড়েনি। মহাপরিচালক জানান চারটি বিভাগীয় অফিসে ৪শ’রও কম জনবল দিয়ে অধিদফতর পরিচালিত হচ্ছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরে বর্তমানে চারটি বিভাগীয় অফিস হলো বগুড়া,খুলনা ঢাকা ও কুমিল্লা। নতুন চারটি বিভাগীয় অফিসের প্রস্তাবনা করা হয়েছে, রংপুর, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও বরিশাল। উল্লেখ্য দেশের প্রাচীন বিশাল এলাকা পুন্ড্রবর্ধনভুক্তির রাজধানী মহাস্থানগড় হওয়ায় পুরাতন রাজশাহী বিভাগের ১৬ জেলার আঞ্চলিক অফিস বগুড়ায় স্থাপিত হয়। প্রতিবছর মহাস্থানগড়ে বাংলাদেশ-ফ্রান্স যৌথ প্রত্নখননে ইতিহাসের মহামূল্যবান প্রত্ন নিদর্শন বের হয়ে আসছে। যা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে দুই দেশে। দেশের বিভিন্নস্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক হেরিটেজ রক্ষায় লোকবল অনেক কম। বহু বছর ধরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরে অভিজ্ঞ ব্যক্তি নিয়োগ নেই। প্রত্নসাইট পাহাড়ার নিজস্ব লোকবল নেই। কোন অঘটন ঘটলে পুলিশ আসে। অনেক স্থানে পুলিশ টহলও নেই। ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম পর্যটকদের সুবিধা নিয়ে। সূত্র জানায় বর্তমানে পুরাকীর্তি রক্ষা ও সংরক্ষণের তিনটি আইন আছে। ট্রেজারারস ট্রুভ এ্যাক্ট ১৮৭৮, এ্যানসিয়েন্ট মনুমেন্ট প্রিজারভেশন এ্যাক্ট ১৯০৪, এ্যান্টিকুইটজি এ্যাক্ট ১৯৪৭। ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণীত এই তিনটি আইন দেশ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর একই রেখে বাংলাদেশ পেনাল কোড তৈরি হয়। দিনে দিনে অপরাধের ধরন পাল্টে গিয়েছে। প্রত্ন ও সাংস্কৃতিক সম্পদ নানাভাবে ও নানা কৌশলে লুট করা হচ্ছে। প্রত্ন সম্পদ লুটেরারা পর্দার আড়ালে কলকাঠি নেড়ে সাধারণ ছিঁচকে চোর দিয়ে বড় কাজ সেরে নেয়। কালেভদ্রে এই চোরেরা ধরা পড়ে। কঠিন আইন না থাকার তারা পার পেয়ে যায়। অনেক সময় চোরকে থানা পর্যন্ত নেয়া যায় না স্বাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে। ঐতিহ্যের সম্পদ রক্ষার প্রথম আইন ট্রেজারারস ট্রুভ এ্যাক্টের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, প্রত্ন সম্পদ প্রাপ্তির সময় থেকে মাটির ওপরে ও নিচে থাকা যে কোন বস্তু একশ’ বছরের পুরানো হলেই তার মালিক সরকার। এই বস্তু নিকটের ট্রেজারিতে জমা করা বাধ্যতামূলক। আইনটিতে ১৮৯১ এবং ১৯০৭ সালে কিছু সংশোধনী আনা হয়। এই আইন দিয়ে বর্তমানে দ্রুত কোন ব্যবস্থা নেয়া যায় না। এ্যানসিয়েন্ট মনুমেন্টস প্রিজারভেশন এ্যাক্ট ১৯০৪ সালে প্রণীত। পুরাকীর্তি পাচার রোধ, ঐতিহ্যের অবকাঠামো রক্ষা, প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও শিল্পকলার নিদর্শন সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের লক্ষ্যে এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়। একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এই আইন প্রয়োগে অনেক সময় একাধিক সংস্থার অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। যেমন কোন প্রাচীন ইমরাত নড়বড়ে হয়ে পড়লে তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়। জানমাল রক্ষায় কর্তৃপক্ষ এই ইমরারত ভেঙ্গে ফেললে আইনে আটকানো যায় না। দেশের অনেক প্রাচীন ইমরাত এভাবে ভেঙ্গে ফেলে তার ওপর আধুনিক শৈলীতে ইমারত নির্মিত হয়েছে। পুরাকীর্তি পাচারকে সাধারণ ঘটনা হিসাবে ধরা হয়। পুরাকীর্তি লুট ও পাচারের মতো কৌশলী অপরাধ এই আইন দিয়ে মোকাবেলা করা যাচ্ছে না। এ্যান্টিকুইটিজ এ্যাক্টটি অনেকটাই এক্সপোর্ট কন্ট্রোল। এই আইনে বিশাল ফাঁকফোকর রয়ে গেছে। মুখোশের আড়ালে বড় অপরাধীরা সুকৌশলে দেশের মহামূল্যবান প্রত্ন সম্পদ বিদেশে পাচার করছে। কখনও দুর্বৃত্তরা পীঠ বা ভিটা হিসাবে পরিচিত উঁচু ভূমি (প্রত্ন ভাষায় মাউন্ট) কেটে সমতল করছে। ঐতিহাসিক নগরী মহাস্থানগড়ের প্রত্ন ইট চুরি করে নিয়ে বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। রাতের অন্ধকারে প্রত্ন সম্পদ এলাকা খনন করে সম্পদ লুট করা হচ্ছে। প্রত্নতত্ত্ববিদগণ বলছেন এই তিন আইনের যত ফাঁকফোকর আছে তা বন্ধ করে একবিংশ শতকের উপযোগী করে আইনগুলোর সংশোধনী আনা দরকার। প্রত্নসম্পদ রক্ষায় আইনকে যুগপোযোগী করতে যে খসড়া তৈরি হয়েছে তার মধ্যে আছে- প্রত্ন সম্পদের চারপাশে ২৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে বিশেষ সংরক্ষিত এলাকা (বাফার জোন) এবং এর বাইরে এক কিলোমিটারের মধ্যে সকল ধরনের স্থাপনা নির্মাণের ওপর বিধিনিষেধ।
×