ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

ওরা ভাল থাকলে ভবিষ্যত থাকবে সুরক্ষিত

প্রকাশিত: ২১:০৬, ৩০ নভেম্বর ২০২১

ওরা ভাল থাকলে ভবিষ্যত থাকবে সুরক্ষিত

বাস ভাড়া হাফ করার জন্য রাস্তায় নেমেছে বংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। আজকাল দেশে কোন দ্রোহ-বিদ্রোহ নেই। মানতে মানতে সবকিছু গা সওয়া এক পরিবেশ। অবশ্য সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সরগরম রাজনীতি। রাজনীতি সরগরম হলেও এখন আর কিছু যায় আসে না। বেগম জিয়া একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী। তার জনপ্রিয়তাও ব্যাপক। তবু আন্দোলন হয় না- এটাই বাস্তবতা। এই অবরুদ্ধতার ভেতর মাঝে মাঝে আমাদের তারুণ্য পথে নামে। যতবার রাস্তায় নেমেছে ততবার নিউজ হেডলাইন হয়েছে তারা। এটা সত্য যে, তারা কোমলমতি। তদের বুদ্ধি-বিবেচনা অপরিপক্ব। তাই তাদের পথভ্রষ্ট করা সহজ। সে চেষ্টা আমরা আগেও দেখেছি। বর্তমান সরকারের শাসন আমলে কোন আন্দোলন-সংগ্রাম কখনও দানা বাঁধতে পারেনি। একদিকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞা। এ দুইয়ের কবলে পড়ে বিরোধী রাজনীতি উধাও। তাদের না আছে নেতা, না আছে কোন এজেন্ডা। সত্যিকার জনমানস পাঠ করতে না পারা এই রাজনীতিকে পরোয়া করে না সরকারী দল। এটা মানার পরও বলি, তারুণ্যের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো এই প্রজন্ম জাতির ভবিষ্যত। তারা যখন অসহায় হয়ে রাজপথে নামে তখন প্রশ্ন জাগে- কি হচ্ছে সমাজে? এবার তারা বাস ভাড়া হাফ করার জন্য নামলেও তাদের মনের রাগ-ক্রোধ মাঝে মাঝেই উগড়ে দেয় তারা। সমাজের নানা স্তরে অনেক অপমান আর বঞ্চনা । এই অপমানে অভিভাবকদের দগ্ধ হতে দেখলে কার ভাল লাগে? করোনার কঠিন সময় এখনও পার হয়নি। এখনও কোভিডের ছোবল ওমিক্রন আঘাত হানছে। এই মহামারী দুনিয়াকে বদলে দিয়েছে অনেকটাই। উন্নত দেশ নামে পরিচিত দেশগুলোর অর্থনীতিও খেয়েছে প্রচ- ধাক্কা। দেশে দেশে অর্থনীতিতে নেমেছে ধস। সেখানে আমাদের দেশ ভাল সামাল দিয়েছে বটে, কিন্তু করোনার অপপ্রভাব কেউ এড়াতে পারেনি। দেশে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছের সংখ্যা বেড়েছে অনেক। অন্যদিকে কোটি কোটি মানুষ আজ বিপন্ন। মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত ধুঁকছে। সরকার মুখে যাই বলুক তারা ভাল করেই জানে যে, মানুষের দিনকাল ভাল যাচ্ছে না। কোনক্রমে ঠেলেঠুলে সংসার চালানো এসব মানুষের সন্তানরা অবোধ নয়। তারা তাদের অভিভাবকের আয়-রোজগার জানে। এটাও বোঝে তাদের কষ্ট আর দুঃখ কতটা। এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে, ভাড়া হাফ করার দাবিটা এসবের সঙ্গে রিলেটেড নয়। এগুলো একটা অপরটার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কচিকাঁচাদের যে চেহারা আর আর্তি দেখলাম তাতে এটা স্পষ্ট যে, তারা অসহায় এবং বয়সের কারণে তারা দ্রোহী। এখানে একটা কথা বলা দরকার, সমাজে গোঁজামিল আর আপোস এমন এক জায়গায় চলে গেছে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে আর ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। যারা পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের আমরা চিনি। বাইরে দলবাজি থাক বা না থাক এসব খাতে কিন্তু গোপন সমঝোতা চলছে। এখানে ভাগবাটোয়ারায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি সবাই আছে। কাজেই এর সুরাহা সহজ কিছু নয়। সব কিছুর মতো প্রধানমন্ত্রীর হাত ছাড়া সমাধানও অসম্ভব। ক’দিন ধরে তারুণ্যের এই আন্দোলন আরও একটি বিষয়ে ভাবিয়ে তুলেছে। দেশে চলমান ক্রিকেট নিয়ে যা চলছে তার পেছনে আছে ষড়যন্ত্র। পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে মাঠে পতাকা নিয়ে যারা গিয়েছিল তারা তো উড়ে আসেনি। তারা আমাদেরই সন্তান। তাদের পরিবার এ দেশের নাগরিক। এসব ভূমি সন্তানদের মুখে পাকিস্তানের জয়গান আর মাঠে পতাকা বহন করার বিষয়টা বহু কিছুর সঙ্গে জড়িত। আপাতত জোর করে আমাদের প্রগতিশীল চেতনা তাদের থামালেও উপসর্গ যে রোগে পরিণত হয়ে গেছে তাতে সন্দেহের কোন কারণ দেখি না। এসবের পেছনে তারুণ্যের মনে কি কোন বেদনা কাজ করেনি? স্বাধীন দেশটি ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে জানে না কি তার প্রকৃত ইতিহাস। জানে না কিভাবে তার বীরদের এক এক করে মেরে ফেলা হয়েছিল। তারা এখন মিডিয়ার প্রচারে শুধু বঙ্গবন্ধুকে জানলেও তাদের অজানা থেকে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত কাহিনী। যে কোন দেশের ভবিষ্যত তার তারুণ্য। তারা যে কি করতে পারে আর পারে না এর বড় প্রমাণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তখন তারুণ্য রুখে না দাঁড়ালে বা প্রাণ দিতে এগিয়ে না এলে বাংলাদেশ হতো না। যে তারুণ্যের রক্তে একদিন দেশ হানাদারমুক্ত হয়েছিল আজ সে দেশের তারুণ্য নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে আমাদের। আমরা নিশ্চিত যে প্রজন্ম মাঠে নেমে বাস ভাড়া হাফ করার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা যদি পথভ্রষ্ট হয় তাহলে দুর্ভোগের সীমা থাকবে না। যে বয়সে উন্নত দেশের ছেলেমেয়েরা নির্বিঘেœ নিজেদের গাড়ি চড়ে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে যায়, যাদের খাবারে পুষ্টির অভাব থাকে না, যাদের আনন্দ-বিনোদন আকাশ সমান, সে বয়সে আমাদের দেশের সন্তানরা কেন রাজপথে? কেন তারা এমন উগ্র আর জেদী আচরণ করছে? অস্বীকার করা যাবে না যে, মেট্রোরেল, উড়াল সেতু, রাস্তাঘাট অবকাঠামোগত উন্নয়ন সবকিছু দৃশ্যমান। কিন্তু ভেতরটা? এর জবাব অজানা কিছু নয়। শুরুতেই বলেছি, অল্প কিছু ভাগ্যবান মানুষ ছাড়া বাকি আমজনতা ভাল নেই। যাদের সন্তানরা বাসে চেপে স্কুল-কলেজে যায় ভাল নেই তারা। তাই সামান্য বাস ভাড়ার জন্য রাজপথ উত্তপ্ত করে রেখেছে তারা। যা আর যাই হোক সরকারের জন্য তো বটেই, সমাজের জন্যও ভাল কিছু না। ধামাচাপা দিয়ে সমস্যার সমাধান হয় না। সাময়িক চাপা দিয়ে রাখা গেলেও কালের গর্ভে জমা থাকে সবকিছু। তাই তারুণ্যের রাগ, অভিমান বা বেদনা কতটা ন্যায্য সেটা বিবেচনা করা সরকারের কর্তব্য। তারুণ্যের মন বোঝার জন্য অনুরোধ জানাই সবাইকে। লেখক : সিডনি প্রবাসী [email protected]
×