ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার জরুরী

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ৩০ নভেম্বর ২০২১

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার জরুরী

বাংলাদেশ রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় তো অবশ্যই। কর জিডিপি কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারছে না। প্রতিবছর জাতীয় বাজেটের লক্ষ্যমাত্রানুযায়ী রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। যার কারণে মোটা অঙ্কের বাজেট ঘাটতি, আর ঘাটতি মেটাতে মোটা অঙ্কের ঋণ নিতে হচ্ছে সরকারকে। এমতাবস্থায় জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ যাচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধে। গত অর্থবছর রাজস্ব বাজেটে সুদ খাতে যেখানে ১৮ দশমিক ১ শতাংশ অর্থ ব্যয় করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছিল, সেখানে মাত্র ৬ মাসেই সুদ খাতে বাজেট ব্যয়ের ২৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এক কথায় বলতে গেলে সুদের চাপ বেড়েই চলেছে। রাজস্ব আয়ের গতি কম হওয়ায় বাজেট ঘাটতি বাড়ছে, একই সঙ্গে বাড়ছে সরকারের ঋণের বোঝা। ঋণের সুদ মেটাতে বাজেটের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়ন খাত। রাজস্ব বৃদ্ধি করতে না পারলে বাজেট ঘাটতি বাড়তেই থাকবে, ঘাটতি মেটাতে সুদের পরিমাণ বাড়বেই। পরিস্থিতি বদলাতে রাজস্ব বৃদ্ধি ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। বাংলাদেশ রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের কর জিডিপি ছিল দশ শতাংশের কাছাকাছি, একই সময়ে এশিয়ার অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে কর জিডিপি ছিল ২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ। আমরা যদি ২০২০ সাল থেকে পূর্ববর্তী পাঁচ বছরের দিকে নজর দেই তাহলে দেখা যায় যে, প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে রাজস্ব আদায়ের পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক। নেপাল একটি ছোট দেশ। সে দেশ রাজস্ব জিডিপিতে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। যেমন-২০১৯ সালে নেপালে কর জিডিপির হার ছিল ২৬ দশমিক ০২ শতাংশ, একই সময়ে বাংলাদেশে ছিল ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। ভারতে ছিল ১৯ দশমিক ০৬ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৪ দশমিক ০৭ শতাংশ। গত ২০২০ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড় রাজস্ব প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২৫ দশমিক ০৬ শতাংশ, ২০১৯ সালে ছিল ২৫ দশমিক ০৩ শতাংশ, ২০১৮ সালে ছিল ২৬ দশমিক ০১ শতাংশ। যাই হোক, বাংলাদেশের রাজস্ব খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে ঠিকই, তবে আশানুরূপ নয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজস্ব খাতে প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশে পৌঁছলেও করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক ধাক্কায় কমে আসে ৪ দশমিক ০২ শতাংশে। বর্তমান সরকার রূপকল্প-২০৪১ ঘোষণা করেছে। উন্নত দেশে যেতে রূপকল্প-২০৪১ এর রোডম্যাপ বা পথচিত্র তৈরি করা হয়েছে। আগামী ২০ বছরের জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনার কথাও বলা হয়েছে। ওই সময়ে বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ, আর কর জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭ শতাংশ। এমতাবস্থায় রাজস্ব আহরণের গতি অবশ্যই বাড়াতে হবে। অপরদিকে টেকসই লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বিশ্বব্যাপী আগামী ২০৩০ সাল পর্যন্ত ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত বিনিয়োগ দরকার। বাংলাদেশের দরকার ৯২৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রতিবছর অতিরিক্ত ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ লাগবে। ব্যাপক এই বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে রাজস্ব খাতে ব্যাপক সংস্কার করে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। শুধু তাই নয়, প্রকল্প বাস্তবায়নের দক্ষতা বাড়াতে হবে, আঞ্চলিক সহযোগিতাও বাড়াতে হবে। বেসরকারী বিনিয়োগ খাতকে রাজস্ব আহরণে উৎসাহিত হয় সেই নীতিও গহণ করতে হবে। আমাদের দেশের রাজস্ব উন্নয়ন খাতে রয়েছে নানামুখী জটিলতা। এর মধ্যে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবলের অভাব। রাজস্ব উন্নয়নের বিষয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রের রাজনীতির কাছাকাছি অবস্থানে থাকে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত হন তারা বেশিরভাগই অনভিজ্ঞ এবং রাজনীতির অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট। রাজস্ব বোর্ডের যারা নেতৃত্বে থাকেন তারা তাদের কর্মদক্ষতা ও বিচক্ষণতাই রাজস্ব খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের প্রশাসনের অভ্যন্তরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্যাডারের কর্মকর্তারা পররাষ্ট্র সচিব হয়ে থাকেন। আইন ও বিচারের অভিজ্ঞতায় জেলা জজের পক্ষ থেকে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়ে থাকেন। কিন্তু কর বা শুল্ক ক্যাডার সাধারণত কোয়াসি জুডিশিয়াল সার্ভিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, অর্থাৎ কমিশনার কিংবা সদস্যদের পক্ষ থেকে সচিব পদমর্যাদায় অভিসিক্ত হন না। কিছু ক্ষেত্রে শুল্ক এবং কর ক্যাডারের কর্মকর্তা প্রশাসনিক ক্যাডারে অবস্থানের কারণে মাঝে-মধ্যে শুল্ক ও কর ক্যাডারের কর্মকর্তা সচিব পর্যায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান। শুল্ক ও কর ক্যাডারের সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হলে রাজস্ব আহরণের সবদিকে উন্নয়ন বয়ে আনে। অপরদিকে প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মকর্তারা চেয়ারম্যান হলে তাদের রাজস্ব ব্যবস্থা বুঝতেই অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। আমরা যদি প্রতিবেশী ভারতের দিকে থাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রত্যক্ষ এবং পরক্ষ কর দুটি বিভাগে পৃথক পৃথক মর্যাদায় অভিসিক্ত করে নেতৃত্বকে বিশেষ নিরাপত্তা হিসেবে পদমর্যাদা দেয়া হয়ে থাকে। যার ফলে রাজস্ব বিভাগের গুরুত্ব অন্যান্য বিভাগের চেয়ে সম্পূর্ণ পৃথক ভূমিকায় অবস্থান করে। আর রাজস্ব আদায়ের কার্যক্রম হলো দিনের কাজ দিনেই শেষ করতে হবে, কাল বলতে কিছু নেই। পাকিস্তানে এক সময় রাজস্ব বিভাগ চলত অন্য বিভাগ দ্বারা, বর্তমানে কর ক্যাডারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা রাজস্ব খাতের নেতৃত্ব দিয়ে কর আদায় ব্যবস্থাকে অনেক এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কাজেই বাংলাদেশের রাজস্ব বিভাগকে আন্তর্জাতিক মানের করতে হলে অবশ্যই কর ক্যাডারের কর্মকর্তাদের হাতে দায়িত্ব দিতে হবে। আমাদের দেশে মেধাবী সন্তানরাই শুল্ক ও কর ক্যাডারে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পদস্থ বা নির্বাচিত হয়ে থাকেন, যা শতভাগ কোয়াসি জুডিশিয়াল। অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা হঠাৎ (জুডিশিয়াল) করে রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমকে বেগবান করতে পারবেন না, বরং প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করবেন। আমাদের দেশে শুল্ক ও কর ক্যাডারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পরিদর্শন বিভাগ, জরিপ বিভাগ ও প্রশিক্ষণ বিভাগের মর্যাদাও অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ের। সংশিষ্ট দফতরের কর্মকর্তাদের মহাপরিচালক বলা হলেও প্রশাসনিক দিক থেকে অবস্থান সে পর্যায়ে থাকে না। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় কর সংশ্লিষ্ট দফতরের প্রতি গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় একমাত্র হাতিয়ার হলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আহরণ কর্যক্রম। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিভাষায় রাজস্ব আহরণ তথা রাষ্ট্রের উন্নয়ন কার্যক্রমকে শক্তিশালী করতে হলে এই প্রতিষ্ঠানের সকল পর্যায়ের প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন। ভারত, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়াতে রাজস্ব বোর্ডের পদমর্যাদা অত্যন্ত শক্তিশালী। যার ফলে অনায়াসে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম থাকে গতিশীল। কাজেই আমাদের দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি শুল্ক ও কর ক্যাডারের কর্মকর্তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। দক্ষ, অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের দিয়ে ঢেলে সাজাতে হবে রাজস্ব খাতকে। সংস্কার করতে হবে রাজস্ব বোর্ডকে। তাহলেই রাজস্ব আদায়ের গতি বাড়বে। লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোঃ লিঃ
×