ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুমন্ত রায়

বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু

প্রকাশিত: ২১:০২, ২৯ নভেম্বর ২০২১

বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু

এই নবেম্বর মাস আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর জন্ম ও মৃত্যু মাস। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৫৮ সালের ৩০ নবেম্বর এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৯৩৭ সালের ২৩ নবেম্বর। তাঁর পৈতৃক বাড়ি মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরের রাঢ়ীখাল গ্রাম। বিজ্ঞানীর পৈত্রিক বাড়িটি এখন স্কুল ও কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মূল ভবনটি তিন কক্ষবিশিষ্ট একতলা। প্রায় ২৫০ বছরের পুরনো। ১৯৯৫ সালে ‘জগদীশচন্দ্র বসু ফাউন্ডেশন’-এর উদ্যোগে একটি কক্ষ সংস্কার করে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়। মূল দায়িত্ব পালন করেন ইঞ্জিনিয়ার ড. এম এ কাসেম। পরে তিনি ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট অধ্যাপক রফিকুন নবীর নেতৃত্বে চারুকলার একদল শিক্ষার্থী জগদীশচন্দ্র, তাঁর পরিবার এবং তাঁর আবিষ্কারের বড় বড় পেইন্টিং আঁকেন। ভবনের সামনে জগদীশচন্দ্র বসুর আবক্ষ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন প্রখ্যাত শিল্পী বিজয় সেন। জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন জগদীশচন্দ্র বসুর ভাগ্নে বিজ্ঞানী দিবাকর সেন ও কবি বেগম সুফিয়া কামাল। বর্তমানে মূল ভবনটি পূর্ণাঙ্গ জাদুঘরে রূপান্তরের জন্যে সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে এবং ভবনের সংস্কার কাজ চলছে। জাদুঘরের মূল্যবান সামগ্রী সাময়িকভাবে বোর্ডিং বাড়ির একটি কক্ষে সংরক্ষণ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের নামে আছে প্রায় ২৩ একর সম্পত্তি। প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন প্রায় ১০ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘স্যার জেসি বোস কমপ্লেক্স’। এটি মূলত শিক্ষাসফর এবং পিকনিক স্পট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখানে আছে বিশাল বিশাল দুটো পুকুর, শান বাঁধানো ঘাট, কৃত্রিম পাহাড়, লেক, সুদৃশ্য কাঠের পুল, বাচ্চাদের খেলাধুলার বিভিন্ন রাইড। আছে কিচেন, টয়লেট। প্রবেশমূল্য ২০ টাকা। ঢাকা-মাওয়া বিশ্বরোডের পাশে শ্রীনগর-দোহার রোডের মূলসড়ক সংলগ্ন অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে এর অবস্থান। ঢাকার গুলিস্তান থেকে বাস (আরাম, নগর)-এ সময় লাগে মাত্র এক ঘণ্টা। ভাড়া ৬০ থেকে ৭০ টাকা। ইতোমধ্যে এ স্থাানটি শিক্ষাসফরের জন্য একটি আদর্শ স্থাান হয়ে উঠেছে। পুকুরের চারপাশ দিয়ে নৈসর্গিক পরিবেশে যখন আপনি হেঁটে যাবেন, কচিকচি কিশলয় যখন পরশ বুলিয়ে যাবে- তখন আপনার বার বার আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর কথাই মনে পড়বে- যিনি বলেছিলেন, ‘গাছেরও প্রাণ আছে।’ বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসুই পৃথিবীর প্রথম মাইক্রোওয়েভ বা ক্ষুদ্রতরঙ্গ আবিষ্কার করেছিলেন। আজ নেটওয়ার্কিং প্রযুক্তি বা কানেকটিভিটির যে জয়জয়কার তার সূত্রপাত এই যন্ত্রের মাধ্যমেই করেছিলেন আমাদের বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু। তিনি নিজ হাতে ট্রান্সমিটিং এন্টেনা এবং রিসিভিং এন্টেনা আবিষ্কার করেছিলেন। যার সুফল আজকের সুদৃশ্য মোবাইল টাওয়ার পর্যন্ত পৌঁছেছে। তিনি শতাধিক আশ্চর্যজনক যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। যার মধ্যে আছে : মাইক্রোওয়েভ, গ্যালেনা ডিটেক্টর, স্পাইরাল স্প্রিং ডিটেক্টর, মেটাল কন্ট্যাক্ট ডিটেক্টর, ক্রেস্কোগ্রাফ (গাছের বৃদ্ধিমাপক যন্ত্র), ফটোসিনেটিক বাবলার, রেজোন্যান্ট রেকর্ডার ইত্যাদি। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বাংলা ভাষার প্রথম বিজ্ঞান লেখক। তিনি তাঁর আবিষ্কারগুলো নিয়ে ইংরেজীতে বই লিখেছেন ১৪টি। পাশাপাশি তিনি বাংলা ভাষায়ও প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর সেই মহামূল্যবান প্রবন্ধসমূহ নিয়ে বেরিয়েছে বই ‘অব্যক্ত’। বিজ্ঞানাচার্য তাঁর সারা জীবনের সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে গড়ে তুলেছেন বিজ্ঞান গবেষণাগার ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’। বসু বিজ্ঞান মন্দির বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা গবেষণাগার। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ড. সি.ভি রমন, বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ড. সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ড. মেঘনাদ সাহা প্রমুখ বসু বিজ্ঞান মন্দিরের কৃতী ছাত্র ছিলেন। ৩০ নবেম্বর এই বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীর ১৬৪তম জন্মজয়ন্তী উদ্্যাপন করবে রাঢ়ীখাল স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ইনস্টিটিউশন ও কলেজ। এ উপলক্ষে ‘ক্ষুদ্র তরঙ্গ এবং গাছেরও প্রাণ আছে’ শীর্ষক বিজ্ঞান সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। উদ্বোধন করবেন বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম খাঁন, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। প্রধান অতিথি থাকবেন প্রফেসর ড. মোঃ মাহবুব সরফরাজ, অধ্যক্ষ শ্রীনগর সরকারী কলেজ। বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকবেন সফিক ইসলাম (সহযোগী অধ্যাপক ও বিজ্ঞান লেখক), মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল (সভাপতি, মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাব ও সম্পাদক দৈনিক সভ্যতার আলো)। প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মোঃ ফরহাদ আজিজ জানালেন, বিজ্ঞানীর কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ ছিল না। অনেক শ্রম দিয়ে আমি সেই কঠিন কাজটি করেছি। ইতোপূর্বে বিজ্ঞানীর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ দিনগুলোতে তাঁকে স্মরণ করা হতো না। কারণ, এই সময়টায় বার্ষিক পরীক্ষা থাকে। তবুও আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি বিশেষ দিনগুলোতে তাঁকে স্মরণ করার জন্য। আমরা প্রতিষ্ঠানটির শতবর্ষ (১৯২১-২০২১) পালন করার জন্য বেশ কয়েকটি প্রস্তুতিমূলক সভা করেছিলাম, ভার্চুয়াল মাধ্যমেও আলোচনা অনুষ্ঠান করেছি। করোনা মহামারীর কারণে আমরা মূল অনুষ্ঠানটি করতে পারিনি। গবর্নিং বডির মেয়াদ শেষ। নতুন কমিটি গঠন হলে আমরা শতবর্ষ উদযাপনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। ১৯২৭ সালে লন্ডনের ‘ডেইলি এক্সপ্রেস’ লিখেছিল ‘জগদীশচন্দ্র, গ্যালিলিও এবং নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী।’ আর বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘জগদীশচন্দ্র বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য যতগুলো তথ্য দান করিয়াছেন, তাহার যে কোনটির জন্য স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।’ বিশ্ববিজ্ঞানের অনন্য স্থাপতি, এই উপমহাদেশের বিজ্ঞানের জনক আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর জন্ম-মৃত্যুর এই মাসে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। লেখক : সাবেক শিক্ষক, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ইনস্টিটিউশন ও কলেজ
×