ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অবৈধ দখলদারদের কবলে চট্টগ্রামের সড়ক ও ফুটপাথ

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ২৮ নভেম্বর ২০২১

অবৈধ দখলদারদের কবলে চট্টগ্রামের সড়ক ও ফুটপাথ

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের মোট ফুটপাথ রয়েছে ২৮১ কিলোমিটার। পথচারী চলাচলের এই ফুটপাথের সিংহভাগই চলে গেছে অবৈধ দখলদারদের কবলে। ফুটপাথের পাশাপাশি মূল সড়কও দখল করে চলছে চাঁদাবাজি। খোদ সরকারী সেবা সংস্থা, হকার, বিভিন্ন স্থাপনা মালিক দখল করে রাখার ফলে বাধ্য হয়ে মানুষ হাঁটছে যানবাহন চলাচলের সড়কে। এতে করে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে মূল সড়ক। ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোটবড় অসংখ্য দুর্ঘটনা। তবে এসব দখলের পেছনে রয়েছে কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য। এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারী সংস্থাগুলো মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও এলাকার নেতাকর্মীদের কারণে তা পুরোপুরি সম্ভব হচ্ছে না দখলমুক্ত রাখতে। শুধু তাই নয় সিটি কর্পোরেশন অভিযান চালাতে গেলে দখলকারীরাও তাড়া করে তাদের। সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় থেকে পতেঙ্গা আর শাহ আমানত সেতু থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত নগরীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরলেই দেখা মিলবে ফুটপাথই যেন দোকান বসানোর আদর্শ স্থান। এসবের পেছনে রয়েছে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের কোটি টাকার বাণিজ্য। অবৈধভাবে এসব টাকা আদায় হয় ফুটপাথে বসা দোকান থেকে। যা চট্টগ্রামে ওপেন সিক্রেট। ভাগবাটোয়ারা হয় এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপ উপগ্রুপ হয়ে এসব টাকা পৌঁছায় স্থানীয় থানা পর্যন্ত। ফুটপাথকেন্দ্রিক দখলবাজির এ বাণিজ্যে যুক্ত এলাকাভিত্তিক রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ সদস্যরা। নগরবাসী বলছেন, কোন মেয়র এবং প্রশাসন যদি ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে না পারে তাহলে এই শহরের অভিভাবক আছে কিনা তা সন্দেহ থেকে যায়। স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী সিটি কর্পোরেশন অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান থাকলেও তা মাঝেমধ্যে দৃশ্যমান, তবে স্থায়ী কোন সমাধান নেই। নগরীর প্রাণকেন্দ্র জিইসি মোড় থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত সড়ক আর ফুটপাথ একাকার। ফুটপাথে চা নাস্তার দোকান থেকে শুরু করে কাপড়ে দোকান রয়েছে। এদিকে লালখান বাজার এলাকার সামনে থেকে শুরু করে বাগঘোনা এম আর সিদ্দিকী, মতিঝর্ণা পর্যন্ত সড়কের দুইপাশেই রয়েছে অবৈধ স্থাপনা। বাগঘোনা এলাকা লালখান বাজার ওয়ার্ডের। এ এলাকায় পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে অবৈধ দখলদাররা মূল সড়ক দখল করেই চলছে বছরের পর বছর। সেখানে রীতিমতো বাজার গড়ে উঠেছে। খুলশী থানা আওতাধীন এই এলাকা হলেও তারা এ সড়ক থেকে অবৈধ দখলদার হঠাতে তৎপর নয়। সিটি কর্পোরেশনও এ বিষয়ে আগ বাড়িয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়না। স্থানীয় রাজনীতিতেও রয়েছে ত্রিমুখী সংঘাত। লালখান বাজার ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর আবুল হাসনাত বেলাল স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা। তার সঙ্গে রয়েছে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নানা কারণে আলোচিত সমালোচিত দিদারুল আলম মাসুম ও সাবেক কাউন্সিলর এফ কবির মানিকের রয়েছে বিরোধ। তিনজনের বিরুদ্ধেই রয়েছে নানা অভিযোগ। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ নানা অভিযোগের বিস্তর পাহাড় তিনজনের নামেই। সম্প্রতি দুদক চারটি মামলা দায়ের করেছে সাবেক কাউন্সিলর মানিকের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে এই তিনজনই লালখান বাজার এলাকার একেকটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের অনুসারীদের প্রশ্রয়ে সড়ক ফুটপাথের দখল বাণিজ্য। স্থানীয় থানাও তাই এ বিষয়ে অত সোচ্চার নয়। সিটি কর্পোরেশনও আগ বাড়িয়ে এ বিষয়ে অভিযান চালাতে আসে না। ওই এলাকায় পাহাড়ে অবৈধ বসতি উচ্ছেদেও নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হয় প্রশাসন। এদিকে, টাইগারপাস থেকে নিউমার্কেট, কাজির দেউড়ি, কোতোয়ালি, আগ্রাবাদ, কদমতলী, বারিক বিল্ডিং, ইপিজেড, বন্দরটিলা, চকবাজার, জুবিলী রোড, এনায়েত বাজার, সদরঘাট এলাকার ফুটপাথ, নালা এমনিক খোদ সড়কই দখল করে ভাসমান হকার এবং দোকান মালিকরা। ফলে বাধ্য হয়ে পথচারীরা নামছেন সড়কে। ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছে দুর্ঘটনায়। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে তৎকালীন সিএমপি পুলিশ কমিশনার মাহবুবর রহমান নিরাপদ সড়ক চাই চট্টগ্রাম শাখার এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ফুটপাথে যারা ব্যবসা করছেন, তারা কীভাবে ব্যবসা করছেন, তা আমরা জানি, আপনারাও জানেন। যারা ফুটপাথে ব্যবসা করেন তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের এসব সমাধান করতে হবে। ভোটের রাজনীতির জন্য, ফুটপাথ সুন্দর একটি বিষয়। ফুটপাথ উচ্ছেদ করতে হলে রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে উদ্যোগ নিতে হবে। যদিও পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ফুটপাথ দখলকারীদের কাছ থেকে মাসোহারা ও চাঁদাবাজির অভিযোগ বেশ পুরনো। তবে এসব বিষয়ে সিএমপি শুরু থেকেই বলে আসছে , পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এসব অপরাধের সঙ্গে পুলিশ জড়িত নয়। সচেতন নাগরিকরা বলছেন, ফুটপাথে হাঁটার অধিকার হরণ করা হচ্ছে, শুধু দখল ব্যবসা জিইয়ে রাখতে। ফুটপাথে হাঁটতে গিয়ে হকার ও অবৈধ দখলদারদের রোষানলেও পড়তে হচ্ছে স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের। নগরীর শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ছে এই ফুটপাথ দখলের ফলে। নগরীর নিউমার্কেট এলাকা থেকে জিপিও পার হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত উভয়পাশে ফুটপাথ হকারদের দখলে। এমনকি স্থায়ীভাবে দোকান মালিকরা টাইলস দিয়ে ফুটপাথ দখল করে তাদের মালপত্র রেখেছে। জিপিওর দুপাশেই রয়েছে ফলের ভ্যানগাড়ি। তার অপরপাশে দোস্ত বিল্ডিং আশপাশ এলাকায় ফুটপাথ হারিয়ে গেছে হকারের চাপে। অপরদিকে সদরঘাট কালিবাড়ি সড়কে সাইকেলের দোকানদাররা দখল করে রেখেছে ফুটপাথ। ওই এলাকার ফুটপাথ হারিয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর। আইস ফ্যাক্টরি রোড থেকে কদমতলী রোডের যেন ফুটপাথ উধাও। আন্দরকিল্লা থেকে সাব এরিয়ার সড়কের পাশে ফুটপাথ দখল করে বসানো হয়েছে অস্থায়ী কাঁচাবাজারটি। পুরাতন নগর ভবনের পাশে এমন অবস্থা যেন দেখার কেউ নেই। দায়িত্ব পালনকারী সংস্থাগুলোর অবহেলা এবং নজরদারি না থাকায় নগরীর অধিকাংশ ফুটপাথ প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে বলছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। চট্টগ্রামে ফুটপাথ দখলে হকারের পাশাপাশি স্থাপনাগুলোর মালিকরাও জড়িত। বহুতল ভবন কিংবা স্থাপনার সামনে বর্ধিত অংশ করে দখল করে রাখাটা যেন নিত্যনৈমিত্তিক কর্মকা-ের অংশ। সিটি কর্পোরেশনের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, লালখান বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় উচ্ছেদ অভিযানে গেলে বাধা আসে স্থানীয়দের কাছ থেকে। এসবের নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক গ্রুপের চাঁদাবাজি। পুলিশ নিয়ে ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে অভিযানে গিয়েও সকল পর্যায়ে সদিচ্ছা না থাকায় ফলপ্রসূ হয়না। তাই অভিযানের দুয়েকদিন পরেই আবারও দখল হয়ে যায় ফুটপাথ।
×