ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বরাদ্দ পেয়েও বাসায় উঠতে পারছেন না পুলিশ সদস্যরা

প্রকাশিত: ২৩:১১, ২৮ নভেম্বর ২০২১

বরাদ্দ পেয়েও বাসায় উঠতে পারছেন না পুলিশ সদস্যরা

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ কর্তৃত্বের জেরে দুইবার বরাদ্দ পাওয়া সত্ত্বেও বাসায় উঠতে পারছেনা পুলিশ সদস্যরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ দুটি প্লটের ১৫২টি ফ্ল্যাট পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের বিভিন্ন পদমর্যাদার ১৫২ জন কর্মকর্তার নামে দুই বার বরাদ্দ দিয়েছে। বরাদ্দের বিপরীতে বরাদ্দপত্র জারির ৮০ দিনেও বাসায় উঠতে পারছেন না পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ চাচ্ছে, মন্ত্রণালয় থেকে নয়; পুলিশই বরাদ্দ প্রদান করবে এবং তারাই পরিচালনা করবে। এই কর্তৃত্বের জেরে কাজ শেষেও খালি পড়ে আছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন মাঠের পূর্বদিকে অবস্থিত মতিঝিলের ১০০০ ও ৮০০ বর্গফুট আয়তন বিশিষ্ট ১ ও ৩ নম্বর প্লটে দুটি এ্যাপার্টমেন্ট। ফলে আবাসন সঙ্কটে থাকা পুলিশ সদস্যদের বাসা বরাদ্দ পেয়েও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে রাজি না হলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পুলিশ সদস্য বলছেন, বাসায় ওঠার বিষয়ে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের নিষেধ রয়েছে। তাই বরাদ্দ পাওয়ার পরও বাসায় উঠতে পারছেন না তারা। এ সমস্যার আশু সমাধান চান তারা। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতর বলছে, ঝামেলা নিরসনে মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরের মাঝে চিঠি চালাচালি চলছে। মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে পুলিশ। অপরদিকে, পুলিশ সদস্যরা বাসায় উঠার অপেক্ষায়। পুলিশের দাবির প্রেক্ষিতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন মাঠের পূর্বদিকে অবস্থিত মতিঝিলের দুটি প্লট পুলিশকে বরাদ্দ দেয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। এরই প্রেক্ষিতে কাজ শেষে নিয়ম অনুযায়ী প্লট দুটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে দেয় গণপূর্ত বিভাগ। এরপর জননিরাপত্তা বিভাগ আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১ সেপ্টেম্বর পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার ১৫২ জন পুলিশ সদস্যের নামে বাসাগুলো বরাদ্দ দেয়। প্রথমবার বরাদ্দপত্র জারির পরও বাসায় উঠেনি পুলিশ। ফলে দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর আগের বরাদ্দপত্রের অর্ডার বাতিল করে দ্বিতীয় দফায় ৯ নবেম্বর ফের বরাদ্দপত্র ঘোষণা দেয় জননিরাপত্তা বিভাগ। জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব দেওয়ান মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত বরাদ্দপত্র জারির অনুলিপি পুলিশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে এবারও প্রেরণ করা হয়। বরাদ্দপত্র জারির ১০ দিনের মধ্যে বাসায় ওঠার নিয়মের কথা বরাদ্দপত্রে উল্লেখ থাকলেও দ্বিতীয় দফায়ও বাসায় উঠেননি পুলিশ সদস্যরা। বাসা বরাদ্দ নিয়ে ঝামেলার কথা সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তারা স্বীকার করলেও কী ধরনের ঝামেলা চলছে সেটি নিয়ে মুখ খুলেনি মন্ত্রণালয় ও পুলিশের কোন কর্মকর্তা। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয় ও পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মন্ত্রণালয় চাচ্ছে নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ই বাসা বরাদ্দ দেবে। অন্যদিকে পুলিশ চাচ্ছে, পুলিশ বরাদ্দ প্রদান করবে এবং তারাই পরিচালনা করবে। এই কর্তৃত্ব নিয়েই দ্বন্দ্ব। সৃষ্ট সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাগিদ দিলেও কোন পক্ষই ইতিবাচক না থাকায় তিন মাসেও সুরাহা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুঠোফোনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, এটি (বাসায় না উঠা ও ঝামেলার বিষয়ে) পুলিশই ভাল জানে। সব সময় সব তথ্য তো আর আমার নলেজে থাকে না। বিষয়টি নিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে বলেন তিনি। রাজারবাগ পুলিশ লাইন মাঠের পূর্বদিকে অবস্থিত মতিঝিলের ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাউন্ডারির মধ্যে গণপূর্তের মোট পাঁচটি ভবন রয়েছে। এর মধ্যে পুলিশের জন্য রাখা ১ ও ৩ নং ভবন এখনও খালি পড়ে আছে। ভেতর থেকে গেটে তালা ঝুলিয়ে ডেভেলপার কোম্পানির দারোয়ান বসে আছেন। বরাদ্দ পাওয়া পুলিশ সদস্যদের অনেকে বাসা দেখতে আসলে দারোয়ান তাদের বাসা দেখাচ্ছেন। বাসা বরাদ্দ পাওয়া একজন এএসআই ওই দিন বেলা ২টার দিকে বাসা দেখতে আসেন। তখন ১ নং ভবনের দারোয়ান শহিদ তালা খুলে দ্বিতীয় তলায় নিয়ে ওই এএসআইকে রুম দেখিয়ে নিয়ে আসেন। দারোয়ান শহিদ বলেন, বরাদ্দ পাওয়া পুলিশ সদস্যদের অনেকেই রুম দেখতে আসছেন। প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসেন। সকাল থেকেও বেশ কয়েকজন এসেছেন। বাসায় উঠতে দ্বিতীয়বার বরাদ্দপত্র জারি করার বিষয়টি দারোয়ান শহিদ জানলেও বরাদ্দপ্রাপ্তরা কেন উঠছে না তা তিনি জানেন না। ওখানে কিছু সময় অপেক্ষা করার পর আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে বাসা দেখতে আসতে দেখা গেছে। তবে তারা পোশাক পরিহিত অবস্থায় ছিলেন না। কেউ কেউ বাসা দেখে দক্ষিণ পাশের চায়ের দোকানে বসে চা পান করছিলেন। একই সময়ে আরেকজন বাসা দেখে বের হওয়ার সময় চা পান করা অবস্থায় পুলিশ সদস্য গিয়ে পরিচিত হচ্ছেন। বাসা বরাদ্দ পেয়েছেন কিনা, একে অপরকে এমনটি জিজ্ঞেস করছেন। চায়ের দোকানে বসে আড্ডারত অবস্থায় বাসায় না উঠার কারণ নিয়ে একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করছেন। এরই মধ্যে আরও দুজন পুলিশ সদস্য এসে যোগ দেন। তারাও বাসার কথা শুনে পাশ থেকে কথার উত্তর দিলেন। বরাদ্দ পাওয়া বাসা দেখতে আসা চারজনের মূল কথা হলো- তারা বাসা পেলেও উর্ধতন স্যাররা তাদের বাসায় উঠতে নিষেধ করেছেন। তাই তারা উঠতে পারছেন না। বাসা দেখতে আসা ডিএমপিতে কর্মরত এক এসআই জানান, দ্বিতীয়বার জারি করা বরাদ্দপত্রে তার নাম থাকার বিষয়টি তিনি কদিন পরে জানতে পারেন। জানার পর ওইদিনই বাসা দেখতে আসেন। এরই মাঝে তার ইউনিটের আরেক পুলিশ সদস্য তার বাসা দেখতে আসার বিষয়টি জানতে পেরে তাকে কল করে বলেন, বাসা দেখতে গেছেন, দেখে আসেন। কিন্তু কোন কাগজপত্র জমা দেবেন না। আগে এডিসি স্যারের (ডিএমপির যে কর্মকর্তা এ বিষয়টি দেখাশোনা করেন) সঙ্গে দেখা করে কথা বলেন। তাই কোন কাগজপত্র জমা দেননি এসআই। আরেক জন পুলিশ সদস্য জানান, প্রথমবার বরাদ্দপত্রে তার নাম আসার পর তিনি বাড়িওয়ালাকে বাসা ছাড়ার কথা বলে দিয়েছেন। সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করা নিয়েও টুকিটাকি কথা হচ্ছিল। এরই মধ্যে তার ইউনিটের স্যাররা বললেন, কোনমতে যেন বাসায় না উঠি। দ্বিতীয়বার ঘোষণা করা বরাদ্দপত্রেও তার নাম রয়েছে। কিন্তু এবারও একই অবস্থা। কি করব, জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে তো বিবাদ করা সম্ভব নয়। স্যারদের কথা না শুনলে চাকরির সমস্যা হতে পারে। তার কথা হলো- বাসা নিয়ে যে ঝামেলাই হোক, তা যেন দ্রুত নিরসন করা হয়। আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্য জনকণ্ঠকে জানান, তাদের বেতন-ভাতাসহ সুযোগ সুবিধা কম। বেতনের টাকা দিয়ে সংসার চালানোই দায়। এরপর সন্তানের লেখাপড়ার খরচ, বাসা ভাড়া। কষ্টে থাকার কারণেই বাসার জন্য আবেদন করেছেন। বাসা বরাদ্দ পাওয়ার খবরে খুশিও হয়েছেন। কিন্তু এই খুশি যেন মুহূর্তে ভেস্তে গেছে। কেননা, দীর্ঘদিন পর বাসা বরাদ্দ পেলেও ঝামেলার কারণে স্যাররা বাসায় উঠতে নিষেধ করেছেন। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। তবে অধিকাংশ পুলিশ সদস্য মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ দেয়া বাসায়ই উঠতে চাচ্ছেন। তাদের মতে, পুলিশের বরাদ্দ দেয়া বাসা ২/৩ তিন বছর পর ছেড়ে দিতে হয়। অনেক সময় এক বছর মেয়াদ বাড়ানো যায়। আবার অনেক সময় সম্ভবও হয়না। আর গণপূর্ত কিংবা মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ দেয়া বাসায় ঢাকার বাইরে বদলি না হওয়া পর্যন্ত থাকা যায়। বাসায় না উঠতে উর্ধতনদের পক্ষ থেকে বার বার নির্দেশনা আসায় এবং বিষয়টি নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য কতিপয় পুলিশ সদস্য জানলেও বেশির ভাগই জানেন না। তাই বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বিমত দেখা দিয়েছে এবং একেকজন একেক রকম তথ্যও দিচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, রাজারবাগ রাজধানীর টার্নিং পয়েন্টে হওয়ায় ওইসব বাসায় এএসপি ও এসপি পদমর্যাদার অনেক কর্মকর্তা উঠতে চাচ্ছেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশের যে সকল বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তারা কর্মরত রয়েছেন, ওই বাসায় উঠতে পারলে তাদের সুবিধা হবে। কেননা, ওই বাসা থেকে তাদের অফিসের দূরত্ব মাত্র দুই/এক মিনিটের পথ। তাই তারা উঠতে চাচ্ছেন। যদিও এ কথার কোন ভিত্তি নেই। এরকম নানামুখী কথা ছড়াচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, যারা তদবির করতে পেরেছেন, মন্ত্রণালয় তাদের বাসা দিয়েছে। এই কর্তৃত্ব পুলিশের থাকলে আবার পুলিশ সেভাবে বরাদ্দ দিত। জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ) মোঃ আবু হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, বাসা বরাদ্দ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটু ঝামেলা চলছে। ঝামেলা নিরসনে আমরা চিঠি চালাচালি করছি। আমাদের পক্ষ থেকে কিছুদিন আগেও একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই আমাদের চিঠির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এ মুহূর্তে এ বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। কর্তৃত্ব নিয়ে ঝামেলা কিনা, এমন প্রশ্নে এআইজি না বললেও কী ধরনের ঝামেলা সেটিও নিশ্চিত করেননি তিনি। বরাদ্দ পাওয়া পুলিশ সদস্যদের বাসায় না উঠতে উর্ধতনদের নিষেধ করার অভিযোগটি সত্য নয় বলেও জানান তিনি। ওই বাউন্ডারির মধ্যে বাকি ৩টি প্লটে সরকারী বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা উঠছেন। ওখানকার একটি ভবনের নিচ তলায় মতিঝিল গণপূর্ত বিভাগের অফিস রয়েছে। যারা বাসা বরাদ্দ পেয়েছেন, তারা গণপূর্তের কর্মকর্তাদের কাছে কাগজপত্র জমা দিচ্ছেন। তবে পুলিশ সদস্যদের জন্য রাখা ১ ও ৩ নং ভবনের জন্য এ পর্যন্ত মাত্র ৪-৫ জন কাগজপত্র জমা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন গণপূর্তের ওই অফিসের ওয়ার্কস্টেট এনামুল। তিনি বলেন, ৯ তারিখের অর্ডারের পর আমরা মন্ত্রণালয় থেকে আর কোন চিঠি পাইনি। যে ক’জন পুলিশ সদস্য বাসার জন্য কাগজপত্র জমা দিয়েছেন, তাদের নামে ওই বাসাগুলো পাস করে ফেলব। কাগজপত্র স্বাক্ষরের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গণপূর্ত অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, ভবন দুটির নির্মাণ কাজ চলাকালীন পুলিশের কিছু সংখ্যক সদস্য ফ্ল্যাটের জন্য গণপূর্তে আবেদন করেছিলেন। কাজ শেষে ভবন দুটি যখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে দেয়া হয়, তখন বাসার জন্য গণপূর্তে আবেদন করা পুলিশ সদস্যদের তালিকাও মন্ত্রণালয়কে দেয়া হয়। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তালিকা দিয়ে বলেছি, এরা আমাদের কাছে বাসার জন্য আবেদন করেছিল। এদের বিষয়টি আপনারা বিবেচনা করবেন। গণপূর্তের কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশ সদস্যরা এখন বাসায় উঠলেও তাদের অনেককে পরে নেমে যেতে হতে পারে। কারণ, একজন কনস্টেবল বাসা ভাড়া বাবদ সরকার থেকে ছয় হাজার টাকার মতো পান। কিন্তু ১০০০ ও ৮০০ বর্গফুটের বা ৩-৪ রুমের একটি বাসার ভাড়া মাত্র ৬ হাজার টাকা হতে পারে না। এতে গণপূর্তের বা সরকারে আর্থিক ক্ষতি হবে। যদিও মন্ত্রণালয় স্বল্প আয়ের পুলিশ সদস্যদের জন্য বাসাগুলো বরাদ্দ দিয়ে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে।
×