ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দ্বিতীয় দিনেই বিবর্ণ বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২৩:০২, ২৮ নভেম্বর ২০২১

দ্বিতীয় দিনেই বিবর্ণ বাংলাদেশ

মোঃ মামুন রশীদ, চট্টগ্রাম থেকে ॥ সাগরিকায় দুদিনে দুরকম বাংলাদেশকে দেখা গেল। সাদা পোশাকে ঝলমলে আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে প্রথম দিন শুরুর আঁধার দূরীভূত করেছিলেন মুশফিকুর রহিম ও লিটন কুমার দাস। আড়াই সেশনে তাদের টলাতে পারেনি পাকিস্তানী বোলাররা। তবে দ্বিতীয় দিন সকালেই দুজনের দৃঢ়তা ভেঙ্গে খানখান! তিন পাক পেসার ৯ উইকেট নিয়ে রঙিন বাংলাদেশকে বিবর্ণ করে দিয়েছেন। ব্যাটারদের ব্যর্থতায় এক সেশনে ৭৭ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ৩৩০ রানে গুটিয়ে গেছে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস। দিনের প্রথমাংশের কঠিন সময়টা ব্যর্থতার মিছিলে বয়ে নিয়ে গেছেন বাংলাদেশী ব্যাটাররা। এরপর ব্যাটিং সহায়ক হয়ে ওঠা জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের উইকেটে বিনা উইকেটে ১৪৫ রান তুলে দ্বিতীয় দিন শেষ করেছে পাকরা। আবিদ আলী ও অভিষিক্ত আব্দুল্লাহর জোড়া অর্ধশতক ভাল একটি অবস্থানে নিয়ে গেছে সফরকারীদের। পুরো পরীক্ষাটা দিতে হবে বাংলাদেশের দুই পেসার ও দুই স্পিনারকেই, যারা দ্বিতীয় দিন ছিলেন পুরোপুরি ধারহীন। কিন্তু সেঞ্চুরিয়ান লিটন কুমার দাসের দাবি ম্যাচটি এখনও দুই পক্ষেই আছে। প্রমাণটা দিতে হলে আজ প্রথম থেকেই জ¦লে উঠতে হবে বাংলাদেশী বোলারদের। দুদিনের প্রথম সেশনে বিপর্যস্ত অবস্থা যেন চিরাচরিত নিয়ম বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে। টেস্ট ক্রিকেটে এমনটা অহরহই হয়ে থাকে বাংলাদেশের। এবারও সাগরিকায় সেই বেহাল দশা দেখা গেল। মাঝে লিটন-মুশফিকের দৃঢ় প্রাচীরে বরং পাকিস্তানের বোলাররাই অসহায় ছিলেন। তাই প্রথম দিন সকালের সেশনে বিধ্বংসী পাক পেসাররা আক্ষেপে চুল ছিঁড়েছেন বাকি দিনটা। তারা দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন দ্বিতীয় দিন সকালে। বিশেষ করে হাসান আলীর পেস আর সুইংয়ের সামনে অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে বাংলাদেশী ব্যাটারদের। ১ রান যোগ করে ১১৪ রানে লিটন এলবিডব্লিউ তার বলে, এরপর অভিষিক্ত ইয়াসির আলী রাব্বি শাহীন শাহ আফ্রিদিকে চার হাঁকালেও হাসানের দারুণ লেন্থে ফেলা বলে লাইন হারিয়ে বোল্ড, মুশফিকও ফাহিম আশরাফের পেসে কট বিহাইন্ড। ক্যারিয়ারে চতুর্থ ও চট্টগ্রামে তৃতীয়বার নব্বইয়ে (৯১) আউট হন মুশফিক। বাংলাদেশের দুর্দান্ত ব্যাটিং চিত্র করুণ হতে সময় লেগেছে মাত্র ১ ঘণ্টা ও ১৩.৫ ওভার। ১০ মিনিট আগেভাগে শুরু করা দ্বিতীয় দিনের খেলায় সকালের ভেজা উইকেট ও আর্দ্র আবহাওয়ার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন পাক পেসাররা। শেষ পর্যন্ত মেহেদি হাসান মিরাজের ৬৮ বলে ৬ চারে অপরাজিত ৩৮ বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে ৩৩০ পর্যন্ত। এ বছর ৭ টেস্টে পঞ্চমবারের মতো ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়ে স্বাগতিকদের ব্যাটিংকে ধসিয়ে দিয়েছেন হাসান। পুরো এক সেশনে ২৯.৪ ওভারে ৭৭ রানে ৬ উইকেট হারিয়েছে বাংলাদেশ। প্রথম দিনের চেয়ে তা আরও খারাপ হয়েছে, আগের দিন প্রথম সেশনে ৪ উইকেটে ৬৯ করে তারা ২৮ ওভারে। এমন পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিটন বলেন, প্রথম দিন যেটা ছিল, আমাদের মধ্যাহ্ন বিরতির আগে যখন ৪ উইকেট পড়ে যায় হয়তো সবাই ধারণা করছিল বাংলাদেশ অল্পতে অলআউট হয়ে যাবে। ওখান থেকে আমি আর মুশফিক ভাই অনেক ভাল জুটি গড়ে প্রত্যাবর্তন করেছিলাম। আমরা যখন দিন শেষ করেছি, আমাদের ইচ্ছা ছিল একটা ভাল সংগ্রহের দিকে নিয়ে যাব কাল। কিন্তু এটাই ক্রিকেট। যেটা আগের দিন হয় সেটা পরেরদিন হয় না।’ বাংলাদেশের ব্যাটাররা সকালের কঠিন সময়টা পার করে দিয়েছেন এবং এরপরই লাঞ্চ বিরতি হয়েছে। দুপুরে তাই ব্যাটিং শুরু করে উইকেটটা সহজই পেয়েছেন পাক ওপেনাররা। তারা কোন সুযোগই দেননি বাংলাদেশী বোলারদের। উভয়ের অর্ধশতকে বিনা উইকেটে ১৪৫ রানে দ্বিতীয় দিন শেষ করেছে পাকরা। বোলিংয়ে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর পর আবিদ-শফিকের ওপেনিং জুটি হতাশায় পুড়িয়েছেন বাংলাদেশী বোলারদের। এখনও তারা ১৮৫ রানে পিছিয়ে। চলতি টেস্টে নিয়ন্ত্রণ পেতে হলে আজ সকালের সেশনে বাংলাদেশের বোলারদের জ¦লে উঠতে হবে। সেক্ষেত্রে দুই পেসার এবাদত হোসেন চৌধুরী, আবু জায়েদ রাহী এবং দুই স্পিনার তাইজুল ইসলাম ও মিরাজের ওপরেই ভরসা করতে হবে। কারণ বিকল্প কোন বোলার নেই, ৪ বোলারকেই দিতে হবে অগ্নিপরীক্ষা। নয়তো দিনশেষে লিটন যা বলেছেন তা সত্য হওয়ার উপায় নেই। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান ভাল অবস্থায় আছে কারণ কোন উইকেট হারায়নি। এই বোর্ডে যদি ২/৩ উইকেট থাকত, এই রানে বা এর থেকে বেশি ১৬০ রানে ৩ উইকেট থাকত তাহলে স্কোর দেখতেও ভাল লাগত। আমার মনে হয় আমরা যদি কাল খুব সকালে ২-৩ উইকেট নিতে পারি তাহলে একই জায়গায় চলে আসবে (অবস্থান)। এখন পর্যন্ত খেলা দুই পক্ষেই আছে।’ কিন্তু বাস্তবে দ্বিতীয় দিনে বাংলাদেশের ব্যাটি-বোলিং ব্যর্থতা অনেক এগিয়ে দিয়েছে পাকদের। এখনও ১০ উইকেট আছে তাদের হাতে। প্রথম সেশনে ৪/৫ উইকেট আজ হারিয়ে ফেললেও মাত্র ১৮৫ রানে পিছিয়ে থাকায় তাদের লিড নেয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই অভাবনীয় কিছুই করতে হবে। আগের দিন বাংলাদেশের ব্যাটিং কোচ এ্যাশওয়েল প্রিন্স বলেছিলেন ৪০০-৫০০ রানও হয়তো এমন উইকেটে নিরাপদ হবে না। কারণ ব্যাটিং স্বর্গ হয়ে উঠেছে সাগরিকার উইকেট। দ্বিতীয় দিনশেষে লিটনও বললেন, আমি ও মুশফিক ভাই যদি আরেকটু ভাল ব্যাটিং করতাম তাহলে ৪০০-৪৫০ রান থাকত। তাহলে ভিন্ন দৃশ্যপট থাকত। আবার বোলিংয়ে ২-৩ উইকেট নিতে পারতাম তাহলেও দৃশ্যপট ভিন্ন হতে পারত। উইকেটে দ্রুত রান করা কঠিন। ওদিক থেকে ধরলে খেলা দুই পক্ষে আছে। কালকের (আজ) দিনের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। বাংলাদেশের বোলারদের নখ-দন্তহীন বোলিং দেখা গেছে দ্বিতীয় দিন দুই সেশন। ৪ জন স্পেশালিস্ট বোলারের পাশাপাশি বিকল্প আর কেউ নেই। অধিনায়ক মুমিনুলকেও হয়তো সেজন্য কিছুটা বোলিং করতে হবে। এমন ব্যাটিং উইকেটে তাই ব্যাটারদের ব্যর্থতায় রানই কম করেছে বাংলাদেশ। তাই স্বাগতিকদের বোলিং লাইনআপ দুর্বলই মনে হয়েছে। কিন্তু লিটনের দাবি, এবাদত, রাহী এরা দুজনেই টেস্ট বোলার এবং অনেক উপকারও করেছে, সাহায্য করেছে, উইকেটও নিয়েছে। তাইজুল-মিরাজকে নিয়ে তো সন্দেহই নেই। তো এখানে দুর্বল বোলিংয়ের তো কিছু নেই। সবমিলিয়ে তাই মনে হচ্ছে চলতি টেস্টের গতি-প্রকৃতি বোঝা যাবে আসলে আজ প্রথম সেশনেই। এখানে যারা সফল হবে তারাই সাগরিকায় পেয়ে যাবে নিয়ন্ত্রণ। টেস্টের ভাগ্যটাও হয়তো ঝুলে যাবে তাদের দিকে। প্রথম দিন খেলা হয়েছে ৮৫ ওভার আর দ্বিতীয় দিনে ৮৬.৪ ওভার। সাগর পাড়ের এই মাঠে খেলছে আগেভাগে আলো হারানো সূর্যটাও, তাই ২ দিনে নষ্ট হয়েছে টেস্টের ৮ ওভারের বেশি। হারিয়ে ফেলা সেই ওভারগুলো ফিরে পেতে আজও আগেভাগেই মাঠে গড়ানোর কথা ম্যাচ। সেটি হলে সকালের ভেজা পরিবেশ আর সাগর থেকে ভেসে আসা শীতল হাওয়ায় পাক ব্যাটারদের চেপে ধরাটাই হবে বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য। নয়তো দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সাঁঝ গড়ানোর অনেক আগেই আরও বিবর্ণ হতে থাকবে বাংলাদেশ দলের সাজঘর।
×