ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তেল চুরির নেশায় তারা ময়লাবাহী গাড়ি চালাত

প্রকাশিত: ২২:৫৮, ২৮ নভেম্বর ২০২১

তেল চুরির নেশায় তারা ময়লাবাহী গাড়ি চালাত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার পরও তিনি ময়লাবাহী ভারি গাড়ি চালাতেন শুধু তেল চুরির নেশায়। তিন বছর ধরেই তিনি এভাবে গাড়ি চালিয়ে মোটা টাকা কামিয়েছেন আবার মানুষও মেরেছেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর পান্থপথে তার গাড়ির চাকার নিচেই নির্মমভাবে প্রাণ হারান গণমাধ্যমকর্মী আহসান কবির খান (৪৬)। মূলত যাদের নামে গাড়ি বরাদ্দ সেসব চালকের কেউ ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি চালান না, গাড়ি চালায় বাইরের লোক। তেল চুরি করে টাকা আত্মসাত করাই তাদের লক্ষ্য। সম্প্রতি সিটি কর্পোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় দুজন নিহতের ঘটনার পর এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। দুর্ঘটনায় জড়িত চালকদের কেউই পেশাদার বা কর্পোরেশন নির্ধারিত চালক নয়। হানিফ নামের এই ঘাতককে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে যা বেরিয়ে আসে তা হচ্ছে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতো ঘটনা। র‌্যাব ধরার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই তিনি অবলীলায় স্বীকারও করেছেন এ ধরনের অবিশ্বাস্য কীর্তিকলাপ। এদিকে ওই নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীকে যেই ময়লার গাড়ি দিয়ে হত্যা করা হয় সেই গাড়ির মূল চালক হারুনকে দুদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। র‌্যাব জানিয়েছে, ঘাতক ডাম্প ট্রাকচালক, হানিফের ছিল না কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স। তিনি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কোন পেশাদার চালকও নন। তিনি ডিএনসিসির গাড়ি মেরামত ওয়ার্কশপে মূল মেকানিকের সহযোগী হিসেবে ৭ বছর ধরে কর্মরত। অথচ অবৈধভাবে তিন বছর যাবত তিনি সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন ধরনের হালকা ও ভারি যানবাহন চালাতেন। সর্বশেষ গত এক বছর যাবত তিনি ময়লাবাহী ডাম্প ট্রাক চালাচ্ছিলেন। ডিএনসিসির গাড়ি পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত একজনের সঙ্গে সখ্যের সুবাদে তালিকাভুক্ত কর্মচারী বা চালক না হয়েও ময়লাবাহী ভারি ডাম্প ট্রাকটি বরাদ্দ দেয়া হয়, যা চালানোর জন্য তার নেই পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স। শনিবার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন র‌্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন-গত ২৪ ও ২৫ নবেম্বর রাজধানীতে ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় দুজন নিহত হন। ২৪ নবেম্বর গুলিস্তান এলাকায় নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাইম খান ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় নিহত হন। এইচএসসি পরীক্ষার্থী ওই শিক্ষার্থীর নিহতের ঘটনায় ময়লাবাহী ডাম্প ট্রাকের মূল চালক হারুনকে গত ২৬ নবেম্বর আটক করে র‌্যাব-৩ এর একটি দল। অন্যদিকে গণমাধ্যমকর্মী আহসান কবির খান পান্থপথের বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের উল্টোদিকে ময়লাবাহী আরেকটি গাড়ির চাপায় নিহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে- সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আহসান কবির খান গত ২৫ নবেম্বর তার মগবাজারের বাসা থেকে মিরপুরের কর্মস্থলে রাইড শেয়ারিং এ্যাপের একটি মোটরসাইকেলে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার পথে আনুমানিক দুপুর আড়াইটার দিকে সোনারগাঁ মোড় থেকে পান্থপথে যাওয়ার রাস্তার সিগন্যালে অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় অন্যান্য গাড়ির সঙ্গে ডিএনসিসির একটি ময়লাবাহী ডাম্প ট্রাক সেখানে অপেক্ষা করছিল। সিগন্যাল ছাড়ামাত্রই আহসান কবির খানের মোটরসাইকেল ধাক্কা খেলে তিনি মাটিতে ছিটকে পড়েন। ময়লাবাহী গাড়ির চালক গাড়িটি না থামিয়ে তার ওপর দিয়েই চলে যায়। এ সময় অন্যান্য মোটরসাইকেল চালক ও স্থানীয় লোকজন গাড়িটিকে ধাওয়া দিলে, ময়লাবাহী ডাম্প ট্রাকটি গ্রীনরোড সিগন্যাল পর্যন্ত গিয়ে চালক ও তার সহকারী গাড়িটি রেখে পালিয়ে যায়। উপস্থিত পথচারীরা আহসান কবিরকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার কাছ থেকে পাওয়া পরিচয়পত্র থেকে তাকে শনাক্ত করা হয়। ওই ঘটনায় নিহতের স্ত্রী নাদিরা পারভীন বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। নিহত আহসান কবির খান দৈনিক সংবাদে কর্মরত ছিলেন। এর আগে তিনি প্রথম আলোসহ বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে কাজ করেছেন। মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনায় র‌্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে। তারপরই সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে তাকে ধরে র‌্যাব। র‌্যাব-২ এর অভিযানে শুক্রবার চাঁদপুরের হাইমচর এলাকায় অভিযান চালিয়ে হত্যাকা-ের সময় ময়লাবাহী ডাম্প ট্রাকের চালক মোঃ হানিফ ওরফে ফটিককে (২৩) গ্রেফতার করা হয়। তার বাড়ি কুমিল্লার সিটিপল্লীতে-১৪ মধ্য বস্তিতে। বাবার নাম কামাল মিয়া। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার হানিফ দুর্ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্বীকার করেছে। গ্রেফতার হানিফকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কমান্ডার মঈন বলেন- গত ২৫ নবেম্বর কাওরান বাজার থেকে গাবতলীতে ময়লা পরিবহনের কাজে নিয়োজিত ছিল। সকালে দুবার ময়লা নিয়ে গিয়েছিল। ময়লা নিয়ে তৃতীয়বার যাওয়ার সময় ময়লাবাহী ট্রাক দিয়ে মোটরসাইকেল আরোহীকে চাপা দেয়। এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজন তাকে ধাওয়া করলে সে কৌশলে গাড়ি থেকে নেমে লোকাল বাসে করে গাবতলীতে চলে যায়। গাবতলী থেকে ওই দিনই সদরঘাট হয়ে লঞ্চে হাইমচরে আত্মগোপন করে। সে প্রথমে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি মেরামত ওয়ার্কশপে মূল মেকানিকের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। গাড়ি পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত দুজন ব্যক্তির সঙ্গে সখ্যের সুবাদে ৭ বছর ধরে সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চালাতেন। র‌্যাব জানতে পেরেছে- কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গত তিন বছর ধরে তিনি সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন ধরনের হালকা ও ভারি যানবাহন চালাতেন। সর্বশেষ গত এক বছর যাবত সে ময়লাবাহী ডাম্প ট্রাক চালাচ্ছিলেন। সিটি কর্পোরেশনের তালিকাভুক্ত কর্মচারী বা চালক না হয়েও তিনি ময়লাবাহী ডাম্প ট্রাকটি বরাদ্দ পান। এজন্য তাকে কোন নির্দিষ্ট বেতন দেয়া না হলেও, বকশিশ ও গাড়ির জন্য বরাদ্দকৃত তেল বিক্রিই আয়ের উৎস বলে জানান। ময়লাবাহী ডাম্প ট্রাক একটি ভারি যানবাহন। যা চালানোর জন্য পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রয়োজন হলেও তার নামে হালকা যানবাহন চালানোর একটা ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে বলে জানান হানিফ। এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মঈন বলেন, সরাসরি ঘাতক ময়লার ডাম্প গাড়িটি কার নামে বরাদ্দ, কে মূল চালক তা জানে না গ্রেফতার হানিফ। তবে আমরা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মূল চালকের তথ্য পেয়েছি। সেটি আমরা ডিএনসিসিকে জানাব। তারা এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবে। এ ছাড়া অপর প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব গণমাধ্যম প্রধান বলেন, নটর ডেম ছাত্র নিহতের ঘটনায় গ্রেফতার হারুন ছিলেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তার কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। মূল চালক ছাড়াই সে দেড় বছর ধরে চালক হিসেবে গাড়িটি চালাচ্ছিল। আর ঘটনার দিন গাড়ি চালাচ্ছিল সহকারী রাসেল। তারা চালক হিসেবে বেতন পেতেন না। বকশিশ ও তেল চুরিই তাদের মজুরি। তারা ১৭ থেকে ২০ লিটার তেল বাঁচিয়ে মজুরি বা বেতন হিসেবে তুলে নিতেন। গাড়ি দুর্ঘটনার খবর পেয়ে হারুন আত্মগোপনে চলে যায়। পরে তাকে যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেফতার করা হয়। সহযোগী রাসেলও দুই-তিনজন ডিএসসিসির কর্মকর্তার যোগসাজশে ট্রাক চালাচ্ছিল। তিনিও চুরি করা তেল বিক্রি করতেন। রাসেলকেও গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আর পান্থপথে গণমাধ্যমকর্মী আহসান কবির নিহতের ঘটনায় জড়িত গ্রেফতার হানিফও পেশাদার চালক নন। তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
×