ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আত্মজা ও একটি করবী গাছ

প্রকাশিত: ২৩:৫১, ২৬ নভেম্বর ২০২১

আত্মজা ও একটি করবী গাছ

(পূর্ব প্রকাশের পর) কিন্তু ভেতরে কি ঠাণ্ডা নেই। একই রকম, একই রকম। দেশ ছেড়েছে যে তার ভেতর বাইরে নেই। সব এক হয়ে গেছে। সবাই ভেতরে আসতে করবী গাছটার একটা ডাল ঝটকানি দেয়-পায়ের নিচে মাটি ঠাণ্ডা শক্ত আর সেজন্য ইনামের গোড়ালিতে ব্যথা করছে। ভিতরে কালো রঙের চৌকিটা পড়ে আছে। ঘুমের মধ্যে মুরগিগুলো কঁ কঁ করে উঠলো। আবার হু-উ-উ চিৎকার এলো। বিলে বাতাস উঠছে শোনা গেল। ভাঙা চেয়ারে ভদ্রলোকটি বসে। হারিকেন মাটিতে নামানো। ওরা তিনজন চৌকিতে কাছাকাছি বসেছে। কেউ কথা বলছে না। বুড়োর অ্যাজমার কষ্টের নিশ্বাস পড়ছে। তুখোড় লোকটা এখন চুপ-ভস ভস বাতাস ছাড়ছে মুখ দিয়ে। খোঁচা খোঁচা শাদা দাড়ি দেখা যাচ্ছে। শিরাওঠা আঙুলগুলো চেয়ারের হাতলে পড়ে আছে। নোংরা নখ দীর্ঘদিন কাটা নেই। গলার কাছে শ্লেষ্মা এসে জমলে বাতাস যাওয়া আসা প্রায় বন্ধ হয়ে এলো। ইনামের ইচ্ছা হলো একটা নল দিয়ে সাফ করে দেয় ফুটোটা। তারপর কি খবর? এ্যাঁ? সব ভাল তো? ঘড় ঘড় করে একটানা কথা আরম্ভ হয়। আক্ষেপ বিলাপ, মরে গেলেই তো হয় এখন, কি বলো তোমরা? টক করে মরে গেলাম ধরো। তারপরে? আমার আর কি-ড্যাং ড্যাড্যাং ড্যাং, চলে গেলাম, বুঝে মরগে তুই বুড়ি—ছানাপোনা নিয়ে বুঝে মরগে।...এই তোমরা একটু আধটু আসো, যখন তখন এসে খোঁজখবর নাও। সময় অসময় নেই বাবা তোমাদের। তোমরাই ভরসা, আমার পরিবার তোমাদের কথা বলতে অজ্ঞান। ফেকু ভয় পেয়ে গেছে এখন। বুড়ো মুখের দিকে বার বার চেয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চাইছে আর সিঁটিয়ে যাচ্ছে। সুহাস চোখ দুটো গোল গোল করে চেয়ে আছে। বুড়ো মুখ এখন বহুরূপী। সুহাস ভাবছে, বুড়োটা খুন করবেনে মনে হতিছে আমার। আজ ক্যানো যে আলাম! না আসলিই ভাল হতো। ...তোমরা না থাকলে না খেয়ে মরতে হতো এই জঙ্গলে জায়গায়-বুড়ো বলছে, বাড়ির বাগান থেকে অন্ন জোটানো আবার আমাদের কম্ম-হ্যাঃ। ওসব তোমরা জানো। আমরা শুকনো দেশের লোক, বুইলে না? সব সেখানে অন্যরকম, ভাবধারাই আলাদা আমাদের। এখানে না খেয়ে মারা যেতাম তোমরা না থাকলে বাবারা! ছেলেমেয়েগুলো তোমাদের কি ভালই না বাসে! এই দ্যাখো না, বড় মেয়েটা, রুকু এখন চা করতে যাচ্ছে তোমাদের জন্যে-একটা শ্লেষ্মার দলা শ্বাসনালীটাকে একবারে স্তব্ধ করে দেয়, তাতে চোখ কপালে তুলে বুড়ো কাশছে। কথার খই ফুটছিল অথচ এখন মরে যাবে নাকি? আমরা চা খাবো না, আমরা চা খাবো না-চিৎকার করে ওঠে সুহাস আর ফেকু। খাবে না? বুড়ো সামলে নিয়ে শান্তভাবে বলে ও, ঠিক আছে। তাহলে তোমরা এখন চা খাবে না-এ্যাঁ-আচ্ছা, ঠিক আছে। বিল থেকে বাতাসটা উঠে আসছে। এখন অশথ গাছটার মাথায় ঘুরছে, পাক খাচ্ছে, এগিয়ে আসছে, খঞ্জনির বাজনাও এগিয়ে এলো সঙ্গে, খোলের চাটি আর কি বিশাখার কথা, কি তমালের কথা-সব এসে আবার দূরে চলে গেল। সুহাসের চাদরের মধ্যে নোট খড়মড় করে। সেগুলো নিয়ে ফেকু নিজের পকেট থেকে দুটো টাকা বের করে, দলা পাকায়, ভাবে, ভয় পায়, শেষে বুড়োর দিকে ঝুঁকে পড়ে, সুহাস আর আমি দিচ্ছি। চেয়ারের ওপর লোকটা ভয়ানক চমকে ওঠে। পড়ে যাবার মত হয়। খটাখট নড়ে পায়াগুলো, তোমরা দিচ্ছ, তুমি আর সুহাস? দাও। আর কত যে ধার নিতে হবে তোমাদের কাছে! কবেই-বা শুধতে পারব এই সব টাকা? সুহাস উঠে দাঁড়ায়। চলে যাবে এখন? এত তাড়াতাড়ি? রুকু রাগ করবে-চা করতে দিলে না ওকে। ওর সঙ্গে দেখা না করে গেলে আর কোনদিন কথা বলবে না। দাঁড়াও-হারিকেনটা রেখে বুড়ো বেরিয়ে যায়। ছায়াটা ছোট হতে হতে এখন নেই। মুরগিগুলো আবার কঁ কঁ করে ওঠে, কথা বলে ওঠে এক বৃদ্ধা স্ত্রীলোক। তীক্ষè গালাগালি অন্ধকারকে ফাড়ে, চুপ, চুপ, মাগি চুপ কর, কুত্তী-এবং সমস্ত চুপ করে যায়। বুড়ো ফিরছে এখনÑমাথা নামিয়ে কাঁধ ঝুলিয়ে ঘরে ফিরে এসে ফিস ফিস করে, যাও তোমরা, কথা বলে এসো, উই পাশের ঘরে। ইনাম তুমি বসো, এখখুনি যাবে কেন? এসো গল্প করি। বুড়ো গল্প করছে, ভীষণ শীত করছে ওর, চাদরটা আগাগোড়া জড়িয়েও লাভ নেই। শীত তবু মানে, শ্লেষ্মা কিছুতেই কথা বলতে দেবে না তাকে। আমি যখন এখানে এলাম, আমি যখন এখানে এলাম, হাঁপাতে হাঁপাতে, কাঁপতে কাঁপতে সে বলছে, বুঝলে যখন এখানে এলাম ... তার এখানে আসার কথা আর কিছুতেই ফুরোচ্ছে না-সারারাত ধরে সে বলছে, এখানে যখন এলাম-আমি প্রথম একটা করবী গাছ লাগাই ... তখন হু হু করে কে কেঁদে উঠল, চুড়ির শব্দ এলো, এলোমেলো শাড়ির শব্দ আর ইনামের অনুভবে ফুটে উঠল নিটোল সোনারঙের দেহ-সুহাস হাসছে হি হি হি-আমি একটা করবী গাছ লাগাই বুঝলে? বলে থামলো বুড়ো, কান্না শুনল, হাসি শুনল, ফুলের জন্যে নয়, বুড়ো বলল, বিচির জন্যে, বুঝেছ, করবী ফুলের বিচির জন্যে। চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে। আবার হু হু ফোঁপানি এলো আর এই কথা বলে গল্প শেষ না করতেই পানিতে ডুবে যেতে, ভেসে যেতে থাকল বুড়োর মুখÑপ্রথমে একটা করবী গাছ লাগাই বুঝেছ আর ইনাম তেতো তেতো-এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন কাঁদতিছ তুমি? (সমাপ্ত)
×