ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাদিক ইসলাম

শিল্প বিচ্যুত জীবন

প্রকাশিত: ২৩:৪৫, ২৬ নভেম্বর ২০২১

শিল্প বিচ্যুত জীবন

যে জাতি সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং শিল্পকলায় যত উন্নত সেই জাতি সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবেও ততো অগ্রগামী। উঁচু মানদ-ের সাহিত্য উঁচু মানদ-ের মানসিক স্থিতি প্রকাশ করে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, চীন, জাপান, জার্মানি ইত্যাদি উন্নত দেশের একটি একমেরু সাংস্কৃতিক আদর্শ এবং বিশ্বাস রয়েছে তাই তারা বিচলিত নয়, দ্বিধান্বিত নয়, মানসিকভাবে দ্বিখ-িত নয়। সংস্কৃতি একটি জাতির চেতনাকে যেমন বহন করে তেমনি তার রুচি, মনস্তত্ত্ব, বিশ্বাস, নীতিবোধ এবং আদর্শকে ধারণ করে এবং আদর্শকে রক্ষা করে। বর্তমান যুগে আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আমরা কী পড়ছি আর কী লিখছি নিজেরাই তা জানি না। আর আমাদের ওপর প্রভাব রয়েছে বাইরের নানামুখী সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং রুচিবোধের। আমাদের অনুকরণপ্রিয় স্বভাব এক্ষেত্রে আরও বেশি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। বাবা-মা, বয়স্ক-বৃদ্ধ তাদের আদর্শ এক ধরনের; তাদের রুচিবোধ, মূল্যবোধ এক ধরনের আবার ছেলে, মেয়ে, শিক্ষার্থী তারা অতীতের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যচ্যুত হয়ে বাহ্যিক চাকচিক্যময় সাংস্কৃতিকে উন্নত মনে করে সেখানে নিজের মন মানসিকতাকে সমর্পণ করছে। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা, ইনফরমেশন টেকনোলজির বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন এবং আকর্ষণ বর্তমান প্রজন্মকে আমাদের নিজস্ব সাহিত্য, সংস্কৃতি থেকে অনেক দূরে নিয়ে গিয়েছে। আবার যারা শিক্ষিত নয় তাদের সংস্কৃতিক মূল্যবোধ অনেকটাই আলাদা। এভাবে আমরা শিল্প বিচ্যুত হয়ে, সাহিত্যিক চেতনা বোধ বিবর্জিত হয়ে দিগি¦দিক ছুটছি অন্ধকারের যাত্রীর মত। আমাদের শিল্প-সাহিত্য, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, রুচিবোধ বর্তমান যুগে খ--বিখ-িত। তাই আমাদের একে অপরের সঙ্গে বোঝাপড়া যেমন অসম্ভব তেমনি মানসিক ভিন্ন চিন্তাবোধ সমান্তরালভাবে একে অপরের চেতনাবোধের সঙ্গে মিল খায় না। এটা আমাদের জাতির জন্য চরম একটি বিভ্রান্তিকর সময় এবং সমস্যা। বহির্বিশ্বের সাহিত্য-সংস্কৃতি আমাদের মন মানসে জোরালোভাবে উন্মুক্ত তাই বিজাতীয়, মসলাদার, চাকচিক্যময়, আকর্ষণীয়, ফাঁপা জীবনাচরণ আমাদের তরুণ প্রজন্মকে তাদের অন্যের মতো করে ভাবতে শেখাচ্ছে যেটা আমাদের সংস্কৃতি, রুচিবোধ, আচার-আচরণের পুরো পরিপন্থী। এখনও গ্রামে অনেকেই, যার সংখ্যা নিতান্ত নয়, তারা শ্লোক, পুথি, পদাবলী ইত্যাদির সাহিত্য রস এর বিষয়গুলো নিয়ে গর্বিত আবার বর্তমান প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গান শোনে কিন্তু জানে না কোনটা রবীন্দ্রনাথের গান কোনটা নজরুলের গান। যেহেতু গানের কথা, গানের বাণী তারা বুঝে না কিংবা তাদের হৃদয়ের গভীরে কোন আবেদন সৃষ্টি করে না তাই তার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় অন্যদেশের হৃদয় কাঁপানো সংগীত। তাই অতিকায় স্পিকারের চুম্বকমুখী আকর্ষণ অগ্রাহ্য করার মতো শক্তি কচি, অপরিপক্ব মানসিকতার নেই। জারি, সারি, ভাটিয়ালি গান যেগুলো আমাদের শেকড়; ইতিহাস, ঐতিহ্যকে ধারণ করে সেগুলো আমরা আধুনিক করে আমাদের নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে পারিনি। কেউ বা এদেশে জন ডেনভার, কাইলি মিনোগি, গিগি হাদিদ, ভিন ডিজেলে নিমজ্জিত, কেউ বা পছন্দ করে ময়মনসিংহ গীতিকা আবার কেউ বা আনা কারেনিনা, কেউ শেক্সপিয়ারের অনুরক্ত; একদল দেখা গেল ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি এখনও ভুলতে পারে না, আবার নতুন শিক্ষায় শিক্ষিত তারা ভাওয়াইয়া পল্লীগীতিকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করে। আর একদল রাতে আমেরিকান ট্যালেন্ট আর আমেরিকান এইচডি ফাইটিং মুভি না দেখে ঘুমাতে যায় না। এটা হতে পারে একজন একটা বিষয় পছন্দ করবে কিন্তু স্বজাতীয় চেতনা হারিয়ে মানসিকভাবে অন্ধ হয়ে যাওয়াটা আমাদের চরম দুর্ভাগ্য। আমরা গোটা জাতি কী চাই আমরা তা জানি না। দাদা-দাদি যা চায় বাবা-মা তা চায় না, বাবা-মা যা চায়, ছেলে মেয়ে তা চায় না, আবার নাতি-নাতনি ইংরেজী না শিখলে পিছিয়ে পড়ে গোটা বিশ্ব থেকে। এ এক চরম সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক নিরব দ্বন্দ্ব এবং প্রকট বিভীষিকাময় সাহিত্যিক টানাপোড়েন। চীন রাষ্ট্রের মতো আমরা পারি না ইউরোপকে বাদ দিতে আবার পারি না নিজের আপন কে তুলে এনে নতুন রূপ দিয়ে নতুন প্রজন্মের জন্য আধুনিক করতে। একেকজনের মাথায় চিন্তার ক্রিয়া-কলাপ একেক ধরনের। শারীরিক দ্বন্দ্বের চেয়ে মানসিক দ্বন্দ্ব আমাদের একে অপরের প্রতি দূরে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা কেউ কাউকে বুঝতে পারছি না এটা আমাদের ভীষণ বড় একটা দুর্ভাগ্য। কিন্তু একশ’ বছর আগে ব্যাপারটি এ রকম ছিল না কিংবা বলতে পারি বিশ-ত্রিশ বছর আগেও ব্যাপারটি এ রকম ছিল না কারণ তখন এতবেশি সোশ্যাল মিডিয়া, স্যাটেলাইট চ্যানেল, এবং ইনফরমেশনের সহজ প্রবাহ ছিল না। সব দেশেই এটি ঘটছে কিন্তু আমাদের দেশের মতো এত গোলমেলে অবস্থা কোথাও সৃষ্টি হয়নি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিম, শরত, মীর মশাররফ হোসেন, কালীপ্রসন্ন এই সমস্ত বিখ্যাত লেখকরা নিজের সময়ের আসল নির্যাসটুকু সাহিত্যে তুলে আনতো আর মানুষের মাঝে তা সঞ্চারিত হয়ে তাদের মানসিক গঠন শুধু নয় তাদের চিন্তা চেতনার জগতে বিশিষ্ট মনীষীদের ভাবনা গেঁথে যেত। তখনকার যুগের সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্ম সমাজে অনেক বড় প্রভাব রাখত। সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি এক সময় ছিল পরিবর্তনের হাতিয়ার। কিন্তু আমরা এখনও অনেকটাই শিল্প বিচ্যুত জীবনযাপন করছি। মাত্র অল্প কিছু বছর আগের কথা হুমায়ূন আহমেদে আর ইমদাদুল হক মিলনের জীবনমুখী, বাস্তববাদী নাটক আর উপন্যাস গোটা জাতির জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। তখন আমাদের শিল্পচেতনা ছিল একমুখী। তারও আগে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্কিম এবং শরৎচন্দ্রের উপন্যাস, গান, কবিতা এগুলোর বিখ্যাত বাণীগুলো সবার মুখে মুখে ফিরত। কিন্তু বিভিন্ন কারণে আমরা আমাদের মহান সৃষ্টিকর্মের মহাকাব্যিক চেতনা বিচ্যুত হয়ে গিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী অনেক সিনেমা আমাদেরকে আমাদের অস্তিত্ব আর শিকড় চেনাতে সাহায্য করেছিল। সিনেমার গানে আমরা যেমন প্রেরণা পেয়েছি তেমনি এর শিল্পগুণ আমাদের মননকে সমৃদ্ধ করেছিল। কিন্তু কালের যাত্রায় আজ আমরা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সবকিছু বিচ্যুত হয়ে একটি ফাঁপা শিল্প বিবর্জিত এবং পশ্চিমা ধাঁচের শিল্পে নিজেদেরকে প্রকাশ করতে উদ্গ্রীব হয়ে গিয়েছি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, অর্থনৈতিক পরিবর্তন এবং পুঁজিবাদের উত্থান আমাদের চিন্তার জগতে নতুন বোধের সৃষ্টি করেছে যা আমাদের হাজার বছরের পুরনো চর্চিত শিল্পের একেবারেই বিপরীত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাচীন বাংলার সাহিত্য সম্পদ এবং এর সঙ্গে ব্রিটিশ সাহিত্যের নির্যাসটুকু নিয়ে যে শিল্পকর্ম তৈরি করেছিলেন তা ছিল অনেক জীবনঘনিষ্ঠ। বাংলা, বাঙালী আর বাংলা ভাষা সবার চেয়ে বেশি মূল্যবান ছিল তার কাছে। বাঙালী চিন্তা, চেতনা, ভাবনা, ভাললাগা তার প্রতিটা সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে। এজন্যই তিনি বছরের পর বছর যেমন জনপ্রিয় আধুনিক কালেও তেমনি আধুনিক। বাঙালী মননের একেবারে ভেতরের দিকটা তিনি চিনতে পেরেছিলেন এবং তার সাহিত্যকর্মে ধারণ করেছেন। নজরুল ইসলাম ছিলেন বিপ্লবী, দেশের প্রতি গভীর ভালবাসা তার সাহিত্যকে করে তুলেছিল প্রতিবাদী। তাই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তার সাহিত্যের জ্বালাময়ী বাণী এ দেশের জন্যই জয়গান গেয়েছে এবং এখনও গেয়ে যায় বাংলা এবং বাঙালীর জন্য। সাহিত্য জীবনের বাস্তবতাকে ধারণ করে আবার কালজয়ী সাহিত্য বাস্তবজীবনে প্রভাব ফেলে। সাহিত্যের মূল তিনটি বিষয় হচ্ছে মানব, প্রকৃতি এবং সৃষ্টিকর্তার জয়গান। মানুষকে ছাড়া সাহিত্য কখনও পরিপূর্ণ সাহিত্য হতে পারে না। মানব জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ঘাত-প্রতিঘাত অঙ্কিত হয় সাহিত্যে। আমরা দেখেছি ইংরেজী সাহিত্যে ডলস হাউসের মতো সাহিত্য কিভাবে পুরো ইউরোপিয়ান চেতনাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল নারীদের প্রতি পুরুষের উপেক্ষাকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে। আবার অবশ্যই একটি দেশের সামাজিক, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক এবং বিশেষ করে রাজনৈতিক পরিম-ল সাহিত্যকে প্রভাবিত করে। লেখক মাত্রই সুন্দরের পূজারি। সৌন্দর্য স্পৃহা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। শিল্পীর চোখে সব সৌন্দর্য আরও বেশি নান্দনিক হয়ে ওঠে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক রুঢ়তা লেখকের সুন্দর শিল্প মনকে রক্তাক্ত করে তোলে; কিন্তু বেশিরভাগ লেখকই হচ্ছে প্রতিবাদী তাই তাদের অব্যক্ত এবং কোমল অনুভূতি সৌন্দর্যের ক্ষয় দেখে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। মানবতা এবং বাস্তবতা এগুলোকে সর্বাগ্রে রেখে এগিয়ে যায় লেখকের কর্মস্পৃহা। বাস্তবজীবনের ওপর দাঁড়িয়ে থেকে শিল্পী মহৎ সৃষ্টির প্রয়াস পান। শিল্পী বাস্তবকে নিজের মতো করে দেখে নিজের বোধ এবং মত দিয়ে সেটাকে শিল্পীত করে তোলেন। বাস্তবকে বাদ দিয়ে অতি আদর্শ আর শুধু শিল্পসৃষ্টি শিল্পের কাজ হতে পারে না। আদর্শ এককালে এবং একেক স্থানে একেক রকম কিন্তু মানব সবকালে একই রয়ে যায়। বাংলা সাহিত্যে প্রথম জীবনবাদ এবং চেতনার পৌরষদীপ্ত পত্তন ঘটে মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতে উনিশ শতকেই। রবীন্দ্রনাথ যদিও ভাববাদী ধারণায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন কিন্তু তিনি কখনও মানব বিবর্জিত নন। তার গল্প-কবিতা-গান, উপন্যাস, নাটক সব মানব জীবন কেন্দ্রিক। এটা সত্য তিনি ছিলেন একেশ্বরে বিশ্বাসী এবং তার সমস্ত লেখা সেই এক ঈশ্বরের প্রতি ভক্তের ভক্তি বস্তুনিষ্ঠভাবে ফুটে উঠেছে। কিন্তু তার গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস সবখানে মানব কেন্দ্রে থাকে। তার একটি গান ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে।’ আরেকটি গান- ‘আকাশ ভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি, আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান’ তার ‘বলাকা’ কবিতা সৃষ্টি রহস্যের মাঝে মানব এবং স্রষ্টার নিগূঢ় সত্য উপলব্ধি করতে চায়। তার প্রবন্ধ পল্লী প্রকৃতি, হলকর্ষণ, অরণ্য দেবতা, স্বদেশ, আত্মপরিচয় তার কবিতা মাটির ডাক, রূপনারানের কূলে এগুলো মানবকে কেন্দ্র করে রচিত এবং বাস্তব নিষ্ঠ। যদিও অতিমাত্রায় ভাববাদ তাকে গ্রাস করেছিল কিন্তু শেষের দিককার লেখাগুলোয় তিনি বাস্তবজগতে ফিরে এসেছিলেন। তাই তিনি বলতে পেরেছিলেন ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম।’ আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় এই গানটিতে রবীন্দ্রনাথ আসমানদারি ছেড়ে মাটির জমিনে চলে আসেন, অনিন্দ্যসুন্দর বাংলা প্রকৃতির রূপ তাকে মুগ্ধ করে। কিংবা আরেকটি গানে ‘আমি কেবলই স্বপন করেছি বপন বাতাসে, তাই আকাশ-কুসুম করিনু চয়ন হতাশে।’ যে ছিল আমার স্বপনচারিণী তারে বুঝিতে পারিনি এটা দ্বারা রবীন্দ্রনাথের ভাববাদের প্রতি হতাশা ফুটে ওঠে। এভাবে আরও অনেকখানে দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ বাস্তবকে অকাতরে গ্রহণ করেছেন। আর তার অনেক গান মানবের মান, অভিমান, পাওয়া, না পাওয়া, অপ্রাপ্তি নিয়ে রচিত। নজরুল একদিক দিয়ে অনন্য হয়ে আছেন তিনি প্রথম বস্তুতান্ত্রিকতা বাংলা সাহিত্যে সম্যকভাবে নিয়ে আসেন। যদিও চেতনার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন রোমান্টিক তারমধ্যে ছিল বাস্তববাদী এবং গণতান্ত্রিক চিন্তা। নজরুল স্বদেশী চেতনাকে বেগবান করেছিল। নজরুল ছিল নিপীড়িত এবং অসহায় মানুষের মুক্তির কা-ারি। তার আরেকটি বিশেষ গুণ তিনি হিন্দু এবং মুসলিম এই দুই ধর্ম এবং সংস্কৃতির মানুষকে এক করে দেখতে পেরেছিলেন। তাই মানবের জয় গান নজরুলের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত বারেবারে। বাঙালী যেহেতু অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী তাই তিনি নিয়ে এসেছিলেন বাঙালীর মনে উদ্দীপনার জোয়ার। উনিশ শতকে ছিল জীবনবাদের প্রেরণা, বিশ শতকে ছিল জীবন সংঘর্ষের জটিল প্রক্রিয়ার মানব মননে প্রভাব বিস্তারকারী রূপ। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা কোন মতবাদেই নির্দিষ্ট হতে পারছি না। আমাদের জীবন ভেতরে ভেতরে নিরস, নিষ্প্রভ, বন্ধা, অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ছে ক্রমশ। আমরা জীবন অন্বেষায় গভীর না হয়ে দীপ্তিহীন বুদ্ধিচর্চায়, অপুষ্ট একঘেয়েমিতে মগ্ন। রবীন্দ্রনাথ সুগভীর ব্যঞ্জনার সাহিত্য সৃষ্টি করে এবং নজরুল সাহিত্য বিপ্লবের মাধ্যমে তাদের সময়কার সামাজিক-অর্থনৈতিক দুর্যোগের সুপ্রকাশ করেছিলেন শিল্পমাধ্যমে। কিন্তু আধুনিক যুগে এসে আমাদের সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে কিন্তু সাহিত্যে তার প্রকাশ সম্যকভাবে কিংবা একেবারেই ঘটেনি বললে চলে। আহমেদ রফিক তার বই ‘শিল্প-সংস্কৃতি জীবন’ এখানে বলেন সামাজিক ক্ষয়, ভঙ্গুরতা, সমাজের অন্তঃসারশূন্যতা, অর্থহীনতা, জটিলতা এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও রাজনৈতিক সঙ্কট কবিতায় আসে নি বরঞ্চ দুর্বোধ্যতা কবিতাকে আরও বেশি মানুষের থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। মীর মশাররফ হোসেন এদিক দিয়ে ব্যতিক্রমধর্মী তার লেখনীতে অসাম্প্রদায়িক গণচেতনার রূপায়ণ দেখতে পাওয়া যায়। তার লেখনী বাস্তবজীবন এবং মানুষের অসহায়ত্ব স্পষ্ট করে তুলে এনেছে। এক্ষেত্রে ‘বিষাদসিন্ধু’র নাম করতে হয়। অবশ্য তার আগে কালীপ্রসন্ন এবং দীনবন্ধু তারাই মীর মশাররফ কে এই পথ দেখিয়েছেন। তাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য আত্মসাৎ করেই মীর মশাররফ ঋদ্ধ হয়েছিলেন। বিষাদ সিন্ধু মরমী প্রাণের সুধা রস সকরুণ ঢেউয়ে হিল্লোলিত করেছেন। সেই করুণ ¯িœগ্ধতাই অত্যাচারিত জনের প্রতি সমবেদনায়, আক্রোশে, ক্রোধে অগ্নিগর্ভ। তার লেখনী নীল চাষীর প্রতি দরদ, জমিদার মহাজন অত্যাচারে জর্জরিত কৃষকের প্রতি সহানুভূতিতে, সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধিতায় সমুজ্জ্বল। মীর মশাররফ হোসেন সাহিত্যে গণতান্ত্রিক ধারা নিয়ে এসেছিলেন। সে যুগের অতি দুর্লভগুণ অসাম্প্রদায়িক চেতনা সেটা তিনি লালন করেছিলেন তার উৎসর্গীকৃত জীবনে। তেমনিভাবে সামন্তপ্রভু ও নীল বণিকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ ছিল আশ্চর্য রকমের দৃপ্ত। তার চেতনায় হিন্দু-মুসলমান আলাদা কিছু ছিল না সবাই ছিল শোষিত শ্রেণীর প্রতিনিধি। মীর মোশাররফের মতো বাস্তবকে এত চমৎকারভাবে কেউ সাহিত্যে তুলে আনেননি। তার রচনায় সমাজের নিচু তলার তীব্র জ্বালাময় প্রবহমান গোপন স্রোতের নির্বিশেষ রূপ শুধুমাত্র আভাসে নয়, পুরনো অবয়ব নিয়ে ধরা পড়েছিল। ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ যেমন সেকালের একটি সুন্দর সামাজিক দর্পণ ঠিক তেমনিভাবে একালে ও প্রযোজ্য সমানভাবে একশো বছর আগে আমাদের অবক্ষয় যেমন ছিল এখনও তেমনি রয়ে গেছে। উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য একটি উক্তি ‘হাকিম কুলের লাম্পট্য ও অবিচার, আমলা ও পুলিশ অফিসারদের দক্ষিণ হস্তের লীলা, জমিদার গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র, অত্যাচার ও প্রতারণা, হিন্দু মুসলমান বিদ্বেষ’ একশো বছর আগে যেমন ছিল এখনও তেমনি রয়ে গেছে। সাহিত্যের কষাঘাত আমাদের বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। ভদ্র জীবনের কৃত্রিমতা এবং যান্ত্রিকতা থেকে দূরে সরে এসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে একেবারে নিরাভরণ বাস্তবধর্মী গরিব জেলেদের কাহিনী নিয়ে রচনা করতে দেখা যায় ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। মানবজীবন ও মানব প্রকৃতির গোপন রহস্যের আবিষ্কার এবং তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও বর্ণনার মাধ্যমে তিনি যে সত্যের নগ্ন মূর্তি পাঠকের সামনে উপস্থাপিত করেছেন বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ অভিনব। কয়েকজন মাঝি, নাম কুবের ও গণেশ ও ধনঞ্জয়। তবে ধনঞ্জয় মাঝি হলেও পুঁজির প্রতিনিধি! কারণ নৌকোটা ওর। জেলে পাড়ার বেশিরভাগ মাঝিরই নৌকো নেই, জাল নেই! নৌকো ও জালের মালিকরা তাদের নানা কৌশলে ঠকায়, শোষণ আর বঞ্চনাই যেন তাদের নিয়তি। অপরদিকে, প্রকৃতিও তাদের অনুকূলে নয়। বর্ষার জল ভাসিয়ে নেয় তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই। নড়বড়ে ঘরগুলো সামান্য ঝড়েই বিধ্বস্ত হয়। রোগ-শোক, জরা-মৃত্যু এখানকার জেলেদের নিত্যসঙ্গী। তাদের এ করুণ অবস্থা দেখে মনে হয়, তাদের প্রতি ঈশ্বরও যেন মুখ তুলে তাকান না। শুধু ধনীদের দিকেই তাঁর নজর। জেলে পাড়ায় ঈশ্বরের উপস্থিতি নিয়েও লেখক সন্দিহান! তাইতো আক্ষেপ করে তিনি বলেন: ‘ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্র পল্লীতে- এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে নাথ! ‘পুঁজি আছে শ্রম কম, পুঁজি নেই শ্রম বেশিথ এটি পদ্মা নদীর মাঝির মার্কসীয় দর্শন। সমাজ সচেতনতা একজন শিল্পীকে সত্যিকার অর্থে মহৎ করে তোলে। বাস্তব জীবনের নানাবিধ সমস্যা একজন শিল্পীর লেখায় প্রতিফলিত হওয়া অনেক জরুরী। তা সত্ত্বেও আজকাল বেশিরভাগ শিল্পীর মধ্যে রয়েছে সমাজের প্রতি বিমুখতা ও জীবনবোধ থেকে নিজেকে সযতেœ আড়াল করে রাখার প্রবৃত্তি। এখন শিল্পী পরিপূর্ণভাবে সমাজ কে ধারণ করেন না বরঞ্চ পুঁজিবাদের প্রভাব শিল্পভুবনে প্রকট। ফলে তার চারদিকের সমস্যা জর্জরিত পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে পরিপূর্ণভাবে একজন ইনডিভিজুয়াল, পরগাছা। আজকে শিল্পীর অহঙ্কার বুর্জোয়া শ্রেণীর খামখেয়ালির কাছে শৃঙ্খলিত। এর জন্য দায়ী সমাজব্যবস্থা ও বহিরাঙ্গের প্রভাব। বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা আমাদের সত্যিকারের বাস্তবতা দেখতে দেয় না। রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে বিষ্ণু দে, অমিও চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ কবিরা রোমান্টিক ফ্যান্টাসি ছেড়ে বাস্তবতাকে গ্রহণ করেছিলেন। তবে নজরুল রবীন্দ্রনাথ রোমান্টিক সাহিত্যের পুরোধা কবি হলেও তারা পুরোপুরি রোমান্টিক ফ্যান্টাসিতে ডুবে যাননি; নিচু তলার, গ্রামীণ আর উপেক্ষিত জনদের বাদ দেননি তাদের সাহিত্যকর্ম থেকে। জীবনানন্দ দাশ কবিতায় প্রকৃতি রূপায়নে সমুজ্জ্বল হলেও একটু বেশি পরাবাস্তব ধাঁচের ছিলেন। তবে অদ্বৈত মল্লবর্মণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ মহীরুহ উপন্যাসিকেরা চাক্ষুষ জীবনের নিদারুণ ক্লেশ রূপায়িত করে গেছেন অবিস্মরণীয়ভাবে। নিরন্ন মানুষের জীবন, আটপৌরে, অসহায় মানুষের বেদনা, গ্রামীণ গল্প-গাথা যে কত বড় অসামান্য হতে পারে তারা তা যেমন দেখিয়ে গিয়েছেন তেমনিভাবে মানুষের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক শোষণের বিষয়গুলো বাস্তববাদী করে আমাদের সামনে নিঃসংকোচে তুলে এনেছেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা প্রচুর লেখা পাই তা জীবনঘনিষ্ঠ নয় যেমন তেমনি উদ্দেশ্যবিহীন শিল্পচর্চার নামান্তর। মানব, প্রকৃতি এবং সমাজ বাস্তবতা, মানবিক সঙ্কট যদি আবার সাহিত্যে ফিরে আসে নির্ভীকভাবে, সত্যরূপে তাহলে আমরা একটি নিজস্ব সাহিত্যের আদর্শ দাঁড় করাতে পারব যেখানে আমাদের মনস্তত্ত্ব এবং বিশ্বাস প্রকাশিত হবে সেখানে আমাদের চেতনাও পরিপুষ্ট হবে। তেমনিভাবে আমাদের সমাজ জীবনের দোষ-ত্রুটি, দুর্বলতা, অসারতা, ভঙ্গুরতা, ক্ষয়িষ্ণু দিক এবং পচনশীলতা প্রকাশিত হবে শুদ্ধ হবার জন্য আবার আমাদের আত্মপরিচয় বিকশিত হবে এবং সৃজনশীলতা রক্ষা পাবে এ কথা কিঞ্চিৎ করে হলেও বলা যায়।
×