ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দানবের মতো চলছে সিটি কর্পোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ি

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ২৬ নভেম্বর ২০২১

দানবের মতো চলছে সিটি কর্পোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ি

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ রাজধানীর রাস্তায় সিটি কর্পোরেশনের ময়লাবাহী গাড়িগুলো দানবের মতো চলাচল করছে। ময়লাবাহী গাড়িগুলোর স্টিয়ারিংয়ে থাকা চালকের কাছে মানুষকে মানুষই মনে হয় না। অন্য যানবাহনকেও যানবাহনই মনে করেন না তারা। যেন ট্যাঙ্কার নিয়ে দাপিয়ে বেড়ান নগরীতে। চালকদের এরূপ বেপরোয়া ও উগ্র মনোভাবের ফলে সংস্থার গাড়িগুলো প্রায়ই দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে। চলতি বছরের ১১ মাসে ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন। সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ দায়ী চালকদের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেও এর মধ্যে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি রয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অধিকাংশ গাড়ির কাগজপত্র নেই, নেই ফিটনেসও। তা সত্ত্বেও কেবল সরকারী সংস্থা হওয়ায় এসব গাড়ি ও এর চালকের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিচ্ছে না পুলিশ। সিটি কর্পোরেশনও দায় স্বীকার করে বলছে, পরিবহনের তুলনায় অর্ধেক সংখ্যক চালক রয়েছে তাদের। তাও অনেকের লাইসেন্স নেই। যেহেতু কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেহেতু লাইন্সেসধারী চালক নিয়োগ দিয়ে গাড়িগুলো চালানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা। সিটি কর্পোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় নিহতের সংখ্যা কোন সংস্থার কাছে নেই। তবে কয়েক বছরে রাজধানীতে ময়লাবাহী গাড়ি চাপা ও ধাক্কায় বেশ কয়েকজন হতাহত হয়েছেন। গত ১৬ এপ্রিল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের একটি ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় মোস্তফা (৪০) নামের এক রিক্সাচালক নিহত হয়েছেন। এই ঘটনায় আহত রিক্সা আরোহী হরেন্দ্র দাস (৭০) আহত হয়েছেন। ওইদিন ঘটনার পরপরই স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা ময়লাবাহী গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় মামলা হলেও দায়ী গাড়ি চালক বশির উল্লাহ আকন্দকে (৫৩) সাড়ে সাত মাসেও গ্রেফতার করেনি পুলিশ। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোঃ আব্বাস উদ্দিন বলেন, মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। আসামি সিটি কর্পোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির চালক। তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে সরকারী গাড়ি ভাংচুরের ঘটনায় সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষও অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি মামলা করেছে। এর আগে ১৭ জানুয়ারি গে-ারিয়ার দয়াগঞ্জ মোড়ে ডিএসসিসি’র ময়লার গাড়ির ধাক্কায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) টেলিফোন বিভাগের স্টাফ খালিদ (৫০) নিহত হয়েছেন। ঘটনার বছর ঘুরতে চলছে। জানতে চাইলে গে-ারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজু মিয়া বৃহস্পতিবার জানান, এ ঘটনায় ময়লাবাহী গাড়ির চালককে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছিল। চালককে অভিযুক্ত করে চার্জশীটও দেয়া হয়েছে। আদালত সূত্রে জানা গেছে, মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। এরপর ১৬ মে শাহজাহানপুর টিটিপাড়ায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ময়লার ট্রাক চাপায় স্বপন আহমেদ দীপু (৩৩) নামে এক ব্যাংক কর্মচারী নিহত হয়েছেন। বুধবার গুলিস্তানে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ি চাপায় নাঈম হাসান নামে নটর ডেম কলেজের এক ছাত্র নিহত হয়েছেন। নাঈমকে চাপা দেয়া গাড়িটির আসনে ছিল একজন পরিচ্ছন্নকর্মী। নাঈম হত্যার দাবিতে ওইদিন সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেছিল নটর ডেমের শিক্ষার্থীরা। পরের দিন বৃহস্পতিবারও গুলিস্তান ও নগর ভবন ঘেরাও করে আন্দোলন করেছে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই বৃহস্পতিবার বসুন্ধরা সিটির উল্টোদিকে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় প্রাণ হারালেন আহসান কবির খান নামের আরেকজন। কবির খান প্রথম আলোর সাবেক কর্মী। বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনার চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের গাড়ির ধাক্কায় দক্ষিণে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছ। চলতি বছরের পাঁচটি ঘটনার মধ্যে তিনটিই দক্ষিণে ঘটেছে। জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ উদ্দিন আহাম্মদ জনকণ্ঠকে বলেন, তাদের যে পরিমাণ পরিবহন রয়েছে, সেই সংখ্যক চালক নেই। বলা যায়, পরিবহনের তুলনায় অর্ধেক চালক রয়েছে। তাই অনেক সময় পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কেউ কেউ চালকের স্টিয়ারিংয়ে বসছে। তার মতে, ময়লাবাহী গাড়ির চালকদের কাগজপত্র আছে ঠিকই, তবে পেশাদার চালকের সঙ্কট রয়েছে। তিনি বলেন, লক্কড় ঝক্কড় ও ফিটনেই নেই এমন ৮০ শতাংশ গাড়ি নিলামে ওঠানো হয়েছে। বাকি ২০ শতাংশ ও নতুন ক্রয় করা কিছু সংখ্যক গাড়ি দিয়ে ময়লা টানা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত নগরীর ময়লা এক স্থান থেকে অন্যত্র নেয়ার নিয়ম রয়েছে। প্রায় তিন শতাধিক গাড়ি এ সময়ে ময়লা নিচ্ছে। তবে ৭-৮টি গাড়ি রয়েছে যেগুলো অনুরোধের প্রেক্ষিতে সকালে চলাচল করে। বুধবার সকালে নাঈমকে চাপা দেয়া গাড়িটিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে ময়লা নিয়ে ফিরছিল। এ ঘটনায় চালকের আসনে থাকা পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাসেলকে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা হিসেবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে যেসব ঘটনায় মামলা হয় এবং সিটি কর্পোরেশনের স্টাফ দোষী প্রমাণ হলে সেক্ষেত্রে চাকরিচ্যুতও করা হয়। নতুন করে লাইসেন্সধারী চালক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা লাইসেন্সধারী চালক নিয়োগ দিচ্ছি। ইতোমধ্যে ১৯ জন নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আগামী মাস ছয়েকের মধ্যে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এ সঙ্কট কেটে উঠবে এবং লাইসেন্সধারী চালক দ্বারা প্রতিটি গাড়ি চালানো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। ডিএসসিসি’র তথ্যানুযায়ী, ডিএসসিসিতে মোট যানবাহন আছে ৫১৩টি। এর মধ্যে ১৫০টি গাড়ি নিবন্ধিত। আর নগর সংস্থাটির নিবন্ধিত চালকের সংখ্যা মাত্র ১৪৭। ২০০ গাড়ি চলে মাস্টাররোলে নিয়োগপ্রাপ্ত চালক দিয়ে। বাকি ১৬৬টি গাড়ি কিভাবে চলে তার সঠিক কোন তথ্য দিতে পারেনি ডিএসসিসির পরিবহন খাত। এ যেন সর্ষের মধ্যেই ভূত, নিয়মের মধ্যেই অনিয়ম। নিবন্ধন ছাড়াই সড়কে চলছে গাড়িগুলো। তবে সিটি কর্পোরেশনের পরিবহন সেক্টর বলছে, এর মধ্যে কিছু গাড়ি নিলামে বিক্রি করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিবন্ধিত চালক ছাড়া ডিএসসিসির বাকি গাড়িগুলো চলে অদক্ষ ও অনিবন্ধিত চালক দিয়ে। কখনও কখনও আবার ক্লিনারদেরও দেখা যায় চালকের ভূমিকায়। বুধবার নাঈমকে চাপা দেয়া গাড়িটিও চালাচ্ছিল পরিচ্ছন্নতাকর্মী। ফলে সংস্থার গাড়িগুলো দিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। ডিএসসিসির ময়লার গাড়ি বেপরোয়া গতিতে চালানোর অভিযোগ বহু পুরনো। বারবার দুর্ঘটনা ঘটালেও প্রতিকারে ব্যবস্থা নেয়নি নগর সংস্থা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক ড. মোঃ হাদিউজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, সিটি কর্পোরেশনের অনেক গাড়ির হেডলাইট, ইন্ডিকেটর, রং দেখেই বোঝা যায় এর ফেটনেস নাই। এসব গাড়ির ত্রুটি থাকতেই পারে। এ থেকে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আবার অনেক চালক সরকারী গাড়ি চালাচ্ছে ভেবে অস্থির থাকে। এ কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে। তবে এসব ক্ষেত্রে চালককে রোড সেফটি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। তাছাড়া গাড়ি কে চালাচ্ছে সেক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি থাকার দরকার। বেশ কয়েকদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, সিটি কর্পোরেশনের ময়লার অনেক গাড়ি চালাচ্ছে কিশোর। যার নেই লাইসেন্স কিংবা গাড়ি চালানোর কোন অনুমতিপত্র। এমন বেশ কয়েকজন চালকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তারা প্রথমে কথা বলতে রাজি হননি। পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রাজি হন। তারা বলছেন, কাগজপত্র সবসময় অফিসে থাকে। কেননা এগুলো সিটি করপোরেশনের গাড়ি। এক চালক জানালেন, সিটি করপোরেশনের গাড়ি দেখে কেউ চেক করেন না। তাই কাগজপত্রের প্রয়োজন হয় না। ট্রাফিক বিভাগের দাবি, সিটি করপোরেশনের অধীনে থাকায় এসব গাড়ি কিংবা চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন না তারা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মোঃ মুনিবুর রহমান বলেন, প্রতিটি দুর্ঘটনার পর আমরা সংশ্লিষ্ট এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করি। জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব হচ্ছে চালকদের সচেতন করা এবং আমাদের সঙ্গে সমন্বয় করা। কিন্তু তাদের এসব ক্ষেত্রে ডেকেও তেমন পাওয়া যায় না। সিটি কর্পোরেশন এবং পুলিশ বিভাগ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এই দুই সংস্থার মধ্যে সমন্বয় না থাকলে সেবা দেয়া সম্ভব নয়। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যেসব গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটায় সেগুলো যেহেতু একটি সরকারী সংস্থার, সেহেতু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তো একটু দায়বদ্ধতা থেকেই যায়। তবে এ বিষয়ে যদি সিটি কর্পোরেশন অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা নেয় তাহলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।
×