ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সড়ক ও নগর ভবন অবরোধ ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২৬ নভেম্বর ২০২১

সড়ক ও নগর ভবন অবরোধ ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় পল্টন মডেল থানায় একটি মামলা হয়েছে। নিহতের বাবা শাহ আলম ডিএসসিসির গাড়িচালক রাসেল খানের (২৭) বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন আইনে মামলাটি করেন। এদিকে নাঈমের মৃত্যুর ঘটনায় বৃহস্পতিবারও রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেছে নটর ডেমসহ বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। ১০ দফা দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ডিএসসিসি মূল ফটক আটকেও বিক্ষোভ করেছেন। পরে মেয়রের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে আন্দোলন স্থগিত করেন তারা। এদিকে পুলিশ জানিয়েছে, নাঈমকে চাপা দেয়া ঘাতক গাড়িটি চালাচ্ছিল পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাসেল খান। তাকে দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডেও নিয়েছে পুলিশ। গত বুধবার সকালে গুলিস্তান মোড়ে ডিএসসিসির ময়লাবাহী গাড়িচাপায় নিহত হন নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান। ওই দিনই সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন শুরু করেন নিহতের সহপাঠীরা। বৃহস্পতিবার আরও জোরালোভাবে আন্দোলনে নামেন তারা। দুপুরে প্রথমে মতিঝিল পরে গুলিস্তান জিপিও পয়েন্ট মোড় অবরোধ করেন নটর ডেম, মতিঝিল আইডিয়াল, উদয়ন, কবি নজরুল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও ধানম-ি ল্যাবরেটরি কলেজের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সহপাঠী নাঈম হত্যার বিচার দাবি করে বেলা সোয়া ২টা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে। এতে সচিবালয়ের চতুর্দিক, পল্টন, পুরো গুলিস্তান এলাকা, কাকরাইল, হাইকোর্ট মোড়, ফুলবাড়িয়া, পুলিশ সদর দফতর, বঙ্গমার্কেট এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীরা যানবাহন কোন দিকেই মুভ করতে দেয়নি। ফলে একই স্থানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি দাঁড় করিয়ে বসে থাকতে হয়েছে বাস শ্রমিকদের। অন্যদিকে, যাত্রীদের বাস থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। বেলা সোয়া দুটার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মাইকে মিছিল দিতে দিতে ডিএসসিসির দিকে অগ্রসর হয়। শিক্ষার্থীদের কারও হাতে সাদা কাগজে আঁকা গাড়ির চাকায় রক্তের দাগ এর স্কেচ সংবলিত পোস্টার, কারও হাতে বিভিন্ন স্লোগান লেখা ব্যানার, কেউ গায়ের শার্ট খুলে আকাশে ওড়াচ্ছেন, কেউবা নিজের শার্টে লাল কালি দিয়ে লিখেছেন ‘নাঈমের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত’। এভাবে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিতে দিতে ডিএসসিসির মূল ফটকের সামনে গিয়ে অবস্থান নেন তারা। সেখানেও বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। ‘সুষ্ঠু বিচার কেন নাই, প্রশাসন জবাব চাই; ধিক ধিক ধিক্কার, প্রশাসন ধিক্কার; আমার ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব চাই; আমার ভাই কবরে, খুনী কেন বাইরে; উই ওয়ান্ট জাস্টিস; আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না; এমন স্লোগান দিতে থাকে শিক্ষার্থীরা। আড়াইটার দিকে শিক্ষার্থীরা তিন দফা দাবি তুলে। এর মধ্যে পাঁচ মিনিটের মধ্যে মেয়রকে নগর ভবন থেকে এসে তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। শিক্ষার্থীদের মূল ফটকে যেতে দেখেই ফটক বন্ধ করে দেয় সেখানকার আনসার সদস্যরা। ডিএসসিসির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী নগর ভবন থেকে বেরিয়ে আসেন। নগর ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজ অফিস রুম থেকে বের হয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেখছেন, নিজেরা নিজেরা কানাঘুষা করছেন। অনেককে নিজ কক্ষের জানালা খুলে সেখান থেকে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেছে, কেউ কেউ ভবনের ছাদেও উঠে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের স্লোগান শুছেন। এ সময় নগর ভবনে কাজে আসা অনেককে গেট থেকে ফিরে যেতে দেখা গেছে। শিক্ষার্থী রোহান মাইকে মেয়রের উদ্দেশে বলেন, আপনি এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলুন। না হয় আমরা এখান থেকে যাব না। আপনি এটা প্রমাণ করুন যে, আপনি নগরপিতা আর আমরা আপনার সন্তানের মতো। অন্তত নাঈমের ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত বিচার করে এটা প্রমাণ করুন। না হয় আপনি পদত্যাগ করুন। এ সময় শিক্ষার্থীরা ডিএসসিসি ময়লার গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু হওয়া নাঈম হাসানের নামে গুলিস্তান মোড়ে একটি ফুটওভার ব্রিজ করার দাবিও জানায়। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মেয়র তাপস শিক্ষার্থীর উদ্দেশে বলেন, ডিএসসিসির নিজস্ব অর্থায়নেই গুলিস্তান মোড়ে একটি ফুটওভার ব্রিজ করে দেয়া হবে। পরে বিকেল সোয়া ৪টার দিকে নগর ভবনের মূল ফটকে এসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। এ সময় তিনি শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দেন। একইসঙ্গে তিনি শিক্ষার্থী নাঈমের মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির শাস্তি নিশ্চিত করা হবে বলেও জানান। পরে মেয়রের আশ্বাসে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নগর ভবনের মূল ফটক ছেড়ে চলে যায়। ফলে প্রায় আড়াই ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর নগর ভবনের সামনের রাস্তায় পুনরায় যান চলাচল শুরু হয়। এর আগে ১০ দফা দাবি পূরণে ৪৮ ঘণ্টা সময় দেয় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে দাবি পূরণ না হলে ফের সড়কে নামার ঘোষণা দিয়েছে তারা। দাবিগুলো হলো- যথাযথ তদন্ত করে আমার ভাইয়ের (শিক্ষার্থী নাঈম) হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া, জেলা শহরের বিভিন্ন রুটে শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের জন্য বাস সার্ভিস চালু, স্কুল-কলেজের সামনে হর্ন ও ওভারস্পিডিংয়ের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে জরিমানা ও প্রশাসনের কাছে হস্তান্তরের অধিকার দেয়া, সব শিক্ষার্থীর হাফ পাস নিশ্চিত করা, প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে একাধিক স্পিডব্রেকার নির্মাণ, শহরের প্রতিটি অচল ট্রাফিক লাইটের সংস্করণ এবং সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা, ট্রাফিক আইনের সঠিক প্রয়োগ, জেব্রা ক্রসিংয়ে পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত করা, চলন্ত বাসে যাত্রী ওঠানামা করালে প্রত্যেক বাসকে আইনের আওতায় আনা এবং সর্বোপরি নিরাপদ সড়ক আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করা। এদিকে দুপুরের দিকে নাঈমের মৃত্যুর ঘটনায় নিরাপদ সড়ক ও প্রকৃত ঘাতককে গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন ভিকারুন নিসা, সরকারী বিজ্ঞান কলেজ ও হলিক্রসের শিক্ষার্থীরা। আর ফার্মগেটের সড়কে বিক্ষোভ করেছে সরকারী বিজ্ঞান কলেজ ও হলিক্রসের শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাদের বিভিন্ন স্লোগান দিতে শোনা যায়। তাদের হাতে বিভিন্ন দাবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড রয়েছে। এতে ফার্মগেট, জাহাঙ্গীর গেট, মহাখালী, খেজুর বাগান, কাওরান বাজারসহ আশপাশের এলাকায়ও তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। অনার্সের পরীক্ষা শেষ করে অনেক শিক্ষার্থীকে বাস থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা যায়। এদের অনেককে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতেও দেখা গেছে। মামলা, ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর ॥ বুধবার সকালে এ ঘটনার পর ওইদিন রাতেই পল্টন থানায় সড়ক পরিবহন আইনে নিহতের বাবা শাহ আলম ডিএসসিসির গাড়িচালক রাসেল খানের (২৭) বিরুদ্ধে মামলাটি করেন। এই মামায় রাসেলকে গ্রেফতারের পর আদালতে হাজির করা হয়। পল্টন থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক আনিছুর রহমান আসামিকে আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ঢাকার অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে রিমান্ডের আদেশ দেন। গাড়িটি চালাচ্ছিল পরিচ্ছন্নতাকর্মী ॥ নাঈমকে চাপা দেয়া ডিএসসিসি ময়লাবাহী গাড়িচালক রাসেল খান আসলে একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী, সে প্রকৃত চালক মোঃ হারুনের কাছ থেকে চাবি নিয়ে সায়েদাবাদ থেকে গাড়িটি নিয়ে ওইদিন বের হয়েছিল বলে জানিয়েছেন মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) আঃ আহাদ। বৃহস্পতিবার দুপুরে পল্টন মডেল থানার সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। আঃ আহাদ বলেন, আমরা গাড়ির কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেছি। গাড়িটির মূল চালক হারুন। দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় টহল পুলিশ ও পথচারীরা চালক রাসেল খান ও গাড়ির ভেতরে থাকা পরিচ্ছন্নতাকর্মী গোলাম রব্বানী ও বেলালকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আওয়ামী লীগের অফিসের পূর্ব প্রান্ত থেকে আটক করে। সেখান থেকে পুলিশ তাদের হেফাজতে নেয় এবং ময়লার গাড়িটি জব্দ করে। গাড়িটির প্রকৃত চালক হরুনকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, রাসেল সিটি কর্পোরেশনের কেউ নন। সে সিটি কর্পোরেশনের কিছু কাজ করে। তার আত্মীয়-স্বজন সিটি কর্পোরেশনে চাকরি করে, সেই সূত্র ধরে সে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করত। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সে এর আগেও গাড়িটি চালিয়েছে এবং গাড়ির চাবি হারুনই তাকে দিয়েছিল।
×