ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ মহা মনীষীগণের অলৌকিকত্ব

প্রকাশিত: ২১:১৫, ২৬ নভেম্বর ২০২১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ মহা মনীষীগণের অলৌকিকত্ব

বিচিত্র এ বসুন্ধরা। অমোঘ নিয়ম আর অন্তহীন রহস্যের গতিধারা প্রতিনিয়ত এখানে প্রবহমান। সূর্য উঠে আবার অস্ত যায়, জোৎ¯œা রাতে বসে তারার মেলা। প্রাকৃতিক নিয়মের এক মনোমুগ্ধকর নিত্যকার দৃশ্য। আবার হঠাৎ ঘটে যায় কোন এক অবিশ্বাস্য ঘটনা- রক্ত বৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ কিংবা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুপাত। এগুলো আল্লাহরই খেলা, তাঁরই খুদরত, তাঁরই পরীক্ষা। এর দ্বারা মানুষ সতর্ক হয়, হিসেবী হয়, তাঁর প্রতি ভয় ও ভক্তিতে ঝুঁকে পড়ে। সুরা ইয়াসিনে বলা হয়েছে : যখন আল্লাহ কোন কিছু ইচ্ছে করেন শুধু বলেন- কুন বা হয়ে যাও! আর তখন তা হয়ে যায়।’-এ হচ্ছে আল্লাহর মহিমা। যুগে যুগে মানুষকে ভ্রান্তি আর অন্যায় থেকে ফিরিয়ে এনে আল্লাহর ইবাদতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আল্লাহ কতিপয় নিষ্পাপ শ্রেষ্ঠ মানুষ ও সাধকদের দিয়েছেন অলৌকিক ক্ষমতা। তাদের পদধূলিতে মরুভূমি হয় মরুদ্যান, কঠিন জমিন হয় সবুজ, উর্বর। এসব সসীমের মাঝে আল্লাহর অসীমত্বের কিঞ্চিৎ স্বাদ পায় ¯্রষ্টা-প্রেমিক মজনু দল। নবী রাসূলগণের হাতে এ শক্তি ছিল মু’জেজা নামে। আর ওলী-আবদালদের হাতে এ শক্তি ‘কারামত’ নামে স্বীকৃত। দেদার মুসলিম মহামনীষী ও আধ্যাত্ম্য-সাধক পুরুষের জীবন এসব গৌরবময় বৈচিত্র্যে ভরা। এসব পবিত্র অলৌকিকত্ব না হলে কূটবুদ্ধি, তাগুতি শক্তি জাদু, ইস্তিদরাজের খপ্পরে পড়ে সরল প্রাণ বনি আদম প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত হতো। মু’জেজা ও কারামত দুটিরই একই অর্থ। পরওয়ার দিগার খোদা তায়ালার পক্ষ থেকে হঠাৎ কোন আশ্চর্যজনক ঘটনা প্রকাশ পেলে তাকে আমরা কুদরত বলি। নবী রাসূল (আঃ) গণের পক্ষ থেকে কোন অলৌকিক বিষয় প্রকাশিত থাকলে তাকে বলি আমরা মু’জেজা। আর আউলিয়া কেরামদের পক্ষ থেকে প্রকাশিত অলৌকিক বিষয়গুলোকে কারামত বলা হয়। আজ আমরা এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে ‘কারামত’-এর সত্যতা, প্রয়োজনীয়তা এবং উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করব। যে মু’মিন বান্দা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সত্তা ও গুণাবলীর পরিচয় পেয়ে যথাসম্ভব ইবাদতে নিমগ্ন থাকে এবং গুনাহ ও ভোগবিলাস হতে দূরে থাকে তাকে ওলী বলে। ওলীর কারামত অর্থ তার দ্বারা নবুয়াতের দাবি ব্যতীত চিরন্তর প্রথার বিপরীত কোন বিষয় প্রকাশ পাওয়া। যেমন অকাল খাদ্যসামগ্রী উপস্থিত করা, জড় বস্তুর বাক্য শ্রবণ করা, কোন ভবিষ্যত বিপদ সম্পর্কে মানুষকে পূর্বে অবগত করানো ইত্যাদি। হযরত ঈসা (আঃ)-এর মা মরিয়াম (আ.) কোন নবী ছিলেন না। কিন্তু তার সামনে হযরত যাকারিয়া (আঃ) অকাল খাদ্য দেখতে পেয়েছিলেন। কুরআনুল কারীমের তথ্য অনুযায়ী- কুল্লামা দাখালা আলাইহা যাকারিয়্যাল মিহরাবা ওয়াজাদা ইন্দাহা রিজকা অর্থাৎ যাকারিয়া (আঃ) যখনই মরিয়ামের ইবাদতখানায় যেতেন তার সামনে অকাল খাদ্য রক্ষিত রয়েছে দেখতে পেতেন। তখন আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন হে মরিয়াম! এ জিনিস তোমার কাছে কোথা হতে আসল? মরিয়াম জানালেন: হুয়া মিন ইন্দিল্লাহ- এ তো আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা।’ সাহাবী আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। উসাইদ ইবনে হুজাইর এবং আব্বাস বিন বাশার (রাঃ) নবী করিম (সাঃ) এর নিকট নিজের কোন ব্যাপারে কথা বলা অবস্থায় কিছু রাত হয়ে যায়। রাতটি ছিল খুব অন্ধকার। তাদের উভয়ের হাতে ছিল লাঠি। তারা যখন বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন তখন একজনের লাঠি আলোকিত হয়ে উঠল। এক পর্যায়ে উভয়ের রাস্তা যখন পৃথক হলো, তখন দ্বিতীয় জনের লাঠিও আলোকময় হয়ে গেল এবং সেই আলোতেই তারা নিজ নিজ ঘরে পৌঁছে গেলেন।-(বুখারী)। একদা হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) জনৈক কাফেরের দেয়া বিষের বোতল অজ্ঞাতসারে নিঃশেষে পান করে ফেলেন অথচ তার কোন ক্ষতি হয়নি। সেই বিষ এমন সুতীব্র ছিল যে, তার এক ফোঁটা কোন প্রাণীর দেহে পড়লে মারা যেত। মোট কথা সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন হতে দেদার কারামত বা অলৌকিকত্ব প্রকাশিত হওয়ার ঘটনা অতিবিশ্বস্ত সূত্রে বর্ণিত রয়েছে। পরবর্তীকালে বড় পীর শেখ মহীউদ্দীন আবদুল কাদের জ্বিলানী (রহঃ)-এর কারামত তো সর্বজনবিদিত। যেমন একবার একটি চিল বড়পীরের মজলিশের ওপর দিয়ে চিৎকার করতে করতে উড়ে যাচ্ছিল। এর চিৎকারে মজলিশের লোকেরা বিরক্ত হয়ে ওঠে, বড়পীর তখন বাতাসের দিকে লক্ষ্য করে বললেন, এ চিলটির মাথা ছিঁড়ে ফেল। তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই চিলটি দ্বিখ-িত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তা দেখে তিনি নিজের আসন থেকে নেমে আসলেন, চিলটিকে ধরলেন এবং এর শরীরে হাত ফিরিয়ে বললেন বিসমিল্লাহহির রাহমানির রাহীম’। তৎক্ষণাৎ চিলটি জীবিত হয়ে উঠে গেল।-(তাজকেরাহ ৪/৪২)। এভাবে আজ পর্যন্ত অসংখ্য সত্যিকারের হকপন্থী ওলি-বুজুর্গের কাছ থেকে কারামত প্রকাশিত হচ্ছে। আধ্যাত্ম্য পুরুষদের এক অপূর্ব বৈচিত্র্যময় সম্পদ এবং অন্যতম জীবন বৈশিষ্ট্য। মু’তাজিলা ও শিয়া সম্প্রদায় ওলীদের কারামত স্বীকার করে না। মু’তাজিলাদের মতে, ওলী দ্বারা কারামত প্রকাশ পেলে তাতে ও নবীতে কোন রূপ পার্থক্য থাকে না। শিয়াদের দাবি হলো- হযরত আলীর (রাঃ) পরে আর কোন নবী নেই। আরেকটি সমস্যা হলো, কারামত ও ইস্তিদরাজের মধ্যে (এক প্রকার জাদু) সাধারণ মানুষ পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে না। এজন্য সমাজে বিভ্রান্তি দেখা দেয় কোন কোন সময়। অনেকে ফাসেক লোকদের অলৌকিক কার্যকলাপ দেখে ধোঁকায় পড়ে যায় ও তা কারামত ধারণায় তাদেরকে ওলী ধারণা করে ভ-দের অনুগামী হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, আমাদের এও স্মরণ রাখতে হবে যে, ওলি হওয়া না হওয়া কারামত প্রকাশের ওপর নির্ভর করে না। ওলি হন পরম খোদায়ী সাধনা এবং ক্রমাগত আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে। প্রকৃত ‘ওলি আল্লাহ’ গণ কখনও কোন মানুষের সেবা ও ধন্যবাদ পাওয়ার আশা রাখে না। তারা সবার উর্ধে স্থান দেন করুণাময় আল্লাহ তায়ালার রেজামন্দি। তাই তাদের চলাফেরা হয় নীরব ও চাহিদাবিমুখ। এমন হাজার হাজার ওলি আছেন, যাদের দ্বারা কখনও কারামত প্রকাশ পায় না। কেউ কেউ তা সভয়ে এড়িয়ে চলেন যেন তাদের দ্বারা কোন কারামত প্রকাশ না পায়। আর যাদের মাধ্যমে তা প্রকাশিত হয় তা নিতান্ত সাধারণ যা সাগরেদদের ধর্মের দিকে অনুরাগ এবং খোদা তায়ালার শ্রেষ্ঠত্ব বড়ত্ব ও মহত্ত্ব সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল করে তোলার জন্য। আল্লাহ তায়ালা ফেরেস্তা বা নবীগণকে ওহী বা ইলহাম দিয়ে কতক গায়েব বিষয় জানিয়ে দিয়েছেন, তা অভ্রান্ত। এরূপ ওলিগণকে তিনি কাশ্ফ বা ইলহামযোগে কোন কোন গায়েবের বিষয় জানিয়ে দেন যা তারা অনুধাবন করতে থাকেন। ওলি আবদালদের দোয়া প্রায়ই কবুল হয়ে থাকে। কিন্তু তারা আল্লাহর মর্জি আছে বুঝতে পারলেই দোয়া করে থাকেন। যে বিষয়ে আল্লাহ গাফুরুর রাহীমের মর্জি নাই মনে করেন তারা সেখানে আল্লাহর ভয়ে তার নামও নেন না। পরিশেষে বলতে চাই, মু’জেজা কারামত ইত্যাদি শক্তি এবং সত্যতা সম্পর্কে যেমন আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে, তেমনি এসবের নামে অপাত্র থেকে যেসব ধূ¤্রজাল সমাজে ছড়িয়ে দেয়া হয় সে ব্যাপারেও সজাগ, সজ্ঞান থাকতে হবে। তাহলেই কেবল ইসলামের এ আধ্যাত্মিক স্বর্গীয় পথটি মানুষদের ক্রমাগত আকর্ষণ সৃষ্টি করবে। এ কলামে মু’জেজা এবং কারামত সম্পর্কিত যে সব আলোচনা অবতারণা আমরা করেছি তা বিশেষ করে নি¤েœাক্ত গ্রন্থাবলীর আলোকেই করা; যেমন-আকাঈদে নাসাফী, শারিহ মাওয়াকিফ, কাসাসুল আম্বিয়া, তাজকেরাতুল আউলিয়া, ইসলামের ইতিহাস- ড. মাহমুদুল হাসান, ইসলামী আকীদা, মা’আরিফুল কোরআন, সাহাবা চরিত ইত্যাদি। লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব [email protected]
×