ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পুনরুদ্ধারের পথে অর্থনীতি

প্রকাশিত: ২১:১৫, ২৬ নভেম্বর ২০২১

পুনরুদ্ধারের পথে অর্থনীতি

ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে পৃথিবী। দেশে করোনার প্রকোপ কমে আসায় চাঙ্গা হচ্ছে অর্থনীতি। আর সুস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মমুখী হচ্ছে মানুষ। মানুষের কর্মচঞ্চলতার জন্য ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতির চাকা। করোনা মহামারীকালে যে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছিল তা আজ ফিরে পেয়েছে পুরনো চাঞ্চল্য। অর্থনীতির পুনরুজ্জীবিতার দরুন বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশ্বব্যাপী মাথাপিছু আয়। মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের জিডিপি এখন ৪০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি যা ২০৩৫ সাল নাগাদ ১ হাজার দুই শ’ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। উন্নত বিশ্বের কাছে এ রকম বিস্ময়কর বা নাটকীয় উত্থানের মূলে রয়েছে বিনিয়োগবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্ব। আজ ৯৯.৯৯ ভাগ লোক বিদ্যুত সুবিধা পাচ্ছে, রাস্তা-ঘাট, পুল-ব্রিজ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে, স্বাক্ষরতার হারও প্রায় ৭৪ শতাংশে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। মানুষের আয়ুষ্কাল ৭৩ বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই মুহূর্তে আমাদের মাথাপিছু আয় ২৫৫৪ মার্কিন ডলার। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা আগামী ২০৪১ সালে মাথাপিছু আয় হবে ১২৫০০ ডলার এবং দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোঠায়। সরকারের দূরদর্শী নেতৃত্বে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ চলমান। বাংলাদেশের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্ভাবনা দিন দিন অগ্রসরমান। এ জন্য বাংলাদেশকে এখন বলা হচ্ছে ‘রাইজ অব বেঙ্গল টাইগার।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি পরিসংখ্যান অনুযায়ী আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আমদানি ৪৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে আমদানিতে এক হাজার ২৬৭ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছিল, চলতি অর্থবছরে যা বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৮৭৩ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অর্থনৈতিক কর্মকা-ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক রফতানিতেও অর্থবছরের প্রথম চার মাসে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে রেকর্ড পণ্য রফতানির পর অক্টোবরেও তা আরও বেড়েছে। শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিড পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রয়াদেশ বাড়তে থাকায় ভবিষ্যতে আরও ভাল করবে রফতানি খাত। ইপিবির তথ্য বলছে, অক্টোবরে ৪৭২ কোটি ৭০ লাখ ৫০ হাজার ডলার সমমূল্যের পণ্য রফতানি হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেশি। ২০২০ সালের অক্টোবরে আয় এসেছিল ২৯৪ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। সেপ্টেম্বরেও একক মাসে রেকর্ড পরিমাণ ৪১৬ কোটি ৫৪ লাখ ডলার সমমূল্যের পণ্য রফতানি হয়েছিল, প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস শেষে রফতানি আয় হয়েছে এক হাজার ৫৭৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রবৃদ্ধি ২২ দশমিক ৬২ শতাংশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশ দুই ধাপ এগিয়ে ৪১তম অবস্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে ১৯৩টি দেশের মধ্যে যা বিগত বছর ছিল ৪৩তম। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপির পরিমাণ ৮২৯ বিলিয়ন ডলার যা ২০২০ সালে ছিল ৭২০ বিলিয়ন ডলার। অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনীতির দিক থেকে অন্যান্য দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিক এন্ড বিজনেস রিসোর্সের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ৩৬তম, ২০২৮ সালের মধ্যে ২৭তম এবং ২০৩৩ সালের মধ্যে ২৪তম অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিতি লাভ করবে। ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকে বাংলাদেশে অবস্থান ৩০তম। করোনার কারণে ২০২১ অর্থবছরের বড় একটা সময় ব্যাংকিং কার্যক্রম সীমিত ছিল। তারপরও আগের বছরের তুলনায় এ খাত থেকে সরকারের আয় বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। ব্যাংক হিসাব খোলা, ঋণ প্রদান, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, ঋণের হিসাব, আমদানি-রফতানিসহ ব্যাংকের সবধরনের সার্ভিস চার্জ থেকে সরকার ১৫ শতাংশ ভ্যাট পায়। এ ছাড়া ব্যাংকের কেনাকাটায়ও দিতে হয় উৎসে ভ্যাট। এনবিআরের তথ্য বলছে, ২০২১ অর্থবছরে ব্যাংকের এসব চার্জের ওপর ২ হাজার ২৫১ কোটি টাকা ভ্যাট পেয়েছে সরকার। আগের বছর এ খাতে আদায়কৃত ভ্যাট ছিল ১ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। যেসকল দেশগুলো করোনা মহামারীর সময়ও তাদের অর্থনৈতিক সূচক ধরে রাখতে পেরেছে তারা মহামারী পরবর্তী সময়ে আরও ভাল করেছে। তবে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যে টিকা প্রদানে বৈষম্যের কারণে অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরুর ক্ষেত্রে ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে দেশগুলোকে। বাংলাদেশে ধীর গতিতে হলেও টিকা প্রদান কর্মসূচী শুরু হওয়ার দরুন সর্বস্তরের জনগণ টিকা পাচ্ছে যার ফলে দেশের মানুষ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকা-ে লিপ্ত হচ্ছে। যার কারণে চাঙ্গা হয়ে উঠছে দেশের অর্থনীতি। করোনা মহামারীতে চাকরিচ্যুত হয়েছে বহু মানুষ। এদিকে বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়াও বন্ধ ছিল। এই পরিস্থিতির উত্তরণ দেখা গেছে করোনা মহামারী পরবর্তী সময়ে। ধীরে ধীরে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়োগ দিতে শুরু করেছে জনবল। এ কারণেও বেকারত্বের মাত্রা হ্রাস পেতে শুরু করেছে এবং আয় উপার্জনক্ষম লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনৈতিক কর্মকা- চাঙ্গা হওয়ায় কর্মসংস্থানের বন্ধ দুয়ারও খুলছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে থেমে থাকা সরকারী নিয়োগ প্রক্রিয়াও চালু হয়েছে। করোনা পরবর্তী সময়কালে বিশ্বের সকল শক্তিশালী দেশ আপ্রাণ চেষ্টা করছে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অগ্রগতির জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতিতে প্রথম স্থানে রয়েছে এবং দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির পরিমাণ ২০.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। বিশ্বের দশটি অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশের মধ্যে চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সর্বাধিক লক্ষণীয়। চীনের বার্ষিক জিডিপির পরিমাণ প্রায় ১৪.২ ট্রিলিয়ন ডলার। বিশ্ববাণিজ্য, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ, বিদেশী বিনিয়োগ অন্তঃপ্রবাহ ইত্যাদিতে চীন এখন বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকে চীন বিশ্বে প্রথম। বিশ্বের অন্যান্য শক্তিধর দেশ যেমনÑ জাপান, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশগুলোতেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার করোনা পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাপান তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে এবং এর জিডিপির পরিমাণ ৪.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। ভারতও দুই ধাপ এগিয়ে ৫ম স্থানে রয়েছে। গার্মেন্টস আর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্বের দাবিদার। সাউথ এশিয়ান ইকোনমিকস বাউন্স ব্যাক বাট ফেস ফ্রাজিল রিকভারি নামক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে, ২০২১ অর্থবছরে দক্ষিণ এশিয়ার মোট দেশজ উৎপাদনের গড় বৃদ্ধি ৭.২% হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় মালদ্বীপের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান হবে বলেও আশা করা যায়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হবে ৫.১%। বাংলাদেশ সরকার চলতি অর্থবছরে ৬.১% এবং আগামী অর্থবছরে ৭.২% প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। টিকা প্রদান কর্মসূচীর ক্ষেত্রে সাফল্য অর্থনৈতিক সফলতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। টেকসই উন্নয়ন, অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ও উর্ধগতি সূচকের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে এখন একটি মর্যাদাপূর্ণ দেশ ও উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। করোনাকালীন ক্রমাগত প্রবৃদ্ধি দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বর্তমান সরকার প্রেক্ষিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ধরে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে যার সুফল জনগণ প্রতিনিয়ত পাচ্ছে। সবুজ-শ্যামল উর্বর এ দেশে নতুন নতুন বিনিয়োগ দেশের প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি নানা সূচকে উন্নয়ন সাধিত করবে। মানুষের জীবনযাত্রার মানের আমূল পরিবর্তন ঘটার পাশাপাশি সৃষ্টি হচ্ছে বিপুল কর্মসংস্থানের। অনুর্বর পতিত জমি ভরাট করে গড়ে তোলা এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে উন্নত দেশ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেবে। এ ছাড়াও পর্যটন সেক্টরের উন্নয়নের জন্য সরকার ৩টি এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন তৈরি করছে যেখানে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে সৌদি আরব, সিঙ্গাপুরসহ নানা দেশ। এতে করে পর্যটনের উন্নয়নের পাশাপাশি সৃষ্টি হবে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থানের। আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সি ফিচ সম্প্রতি বাংলাদেশের রেটিং আগের মতো ‘বিবি মাইনাস’ বজায় রেখেছে বলে মন্তব্য করেছে। গত ৮ নবেম্বর প্রকাশিত পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের কোভিড পূর্ববর্তী প্রবৃদ্ধির তথ্য তুলে ধরে মহামারী পরবর্তী সময়ে জিডিপি অনেক ভাল হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। আগামী বছর ২০২২ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে তা ৭ দশমিক ২ শতাংশ হবে বলে আভাস প্রতিষ্ঠানটির। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এই সাফল্যের পেছনে সরকারের প্রধান ভূমিকা রয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এই সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পারলে দেশের সমৃদ্ধি আরও ত্বরান্বিত হবে। দেশের অর্থনীতিকে আরও এগিয়ে নেয়ার জন্য সকলকে কাজ করতে হবে সমান তালে। লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম এ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×